চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-১৮
চীনের চিপ যুদ্ধ: শি জিনপিংয়ের আহবান থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তর
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস। সুইজারল্যান্ডের দাভোসের মঞ্চে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন বিশ্বের নেতাদের সামনে দাঁড়ালেন, তখন তাঁর কণ্ঠে ছিল শুধুই শান্তির বার্তা। সদ্য ক্ষমতা নেওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন 'আমেরিকা ফার্স্ট'-এর ডাক দিচ্ছেন, শি তখন বৈশ্বিক বাণিজ্যে 'পারস্পরিক লাভের' কথা বললেন - গণমাধ্যম তাঁকে দিল 'গ্লোবালাইজেশনের রক্ষক' খেতাব। কিন্তু সেই আপাত শান্ত এবং উদার ঘোষণার আড়ালে ভেতরে ভেতরে চলছিল এক ভিন্ন পরিকল্পনা।
দাভোসের বক্তৃতার কিছুদিন আগেই বেইজিংয়ে বসে শি জিনপিং এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন হুয়াওয়ের রেন ঝেংফেই, আলিবাবার জ্যাক মা সহ চীনের প্রযুক্তি জগতের মহারথীরা। প্রেসিডেন্ট তাঁদের এক স্পষ্ট নির্দেশ দেন: “চীনকে যত দ্রুত সম্ভব মূল প্রযুক্তিতে সাফল্য অর্জন করতে হবে।” এই 'মূল প্রযুক্তি' আর কিছু নয়, তা ছিল সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ, যা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র থেকে শুরু করে সাধারণ গ্যাজেট, সবকিছুর প্রাণ।
চীনের বিদেশি চিপের ওপর নির্ভরতা ছিল বিশাল। যদিও তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় চিপ ক্রেতা, তবুও বৈশ্বিক উৎপাদনে চীনের অংশ ছিল মাত্র ৬%। সেখানে একা যুক্তরাষ্ট্র ৩৯%, দক্ষিণ কোরিয়া ১৬% ও তাইওয়ান ১২% দখলে রেখেছিল। চিপ ডিজাইনের সফটওয়্যারে চীনের অংশ ছিল ১% এরও কম, যে খাতটি পুরোপুরি আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে। ফলে চীনে তৈরি প্রায় সব উন্নত চিপই নির্ভর করত আমেরিকা, জাপান, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের প্রযুক্তির ওপর।
এই নির্ভরতা ছিল এক বিরাট কাঁটা। ২০১৭ সালে চীনের চিপ আমদানি খরচ ছিল ২৬০ বিলিয়ন ডলার, যা তেল বা বিমান আমদানির চেয়েও বেশি! শি আশঙ্কা করলেন, নিজস্ব চিপ তৈরি করতে না পারলে চীনের প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা উভয়ই বিদেশের ওপর নির্ভরশীল থেকে যাবে।
এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি বদলাতে চীন ঘোষণা করল ঐতিহাসিক পরিকল্পনা: 'মেইড ইন চায়না ২০২৫'। লক্ষ্য ছিল, ২০১৫ সালে চিপে যে ৮৫% আমদানিনির্ভরতা ছিল, তা ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০%-এ নামিয়ে আনা। অর্থাৎ, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে মিশে যাওয়া নয়, বরং নিজস্ব সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলে তা থেকে স্বাধীন হওয়া।
এই স্বপ্নকে বাস্তব করতে ২০১৪ সালে গঠন করা হয় 'বিগ ফান্ড'। অর্থ মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো থেকে শত শত বিলিয়ন ডলার ঢালা হয় চিপ প্রকল্পে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের অতিরিক্ত উদ্যোগ ও অদক্ষতার কারণে অনেক অপচয়ও হলো। চীনের নিজস্ব সবচেয়ে বড় চিপ প্রস্তুতকারক SMIC সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও তাইওয়ানের TSMC-এর চেয়ে প্রযুক্তিতে বহু পিছিয়ে রইল। বিপুল ভর্তুকি সত্ত্বেও আমলাতন্ত্রের জটিলতায় তারা প্রতিযোগিতায় দুর্বল হতে থাকে।
চীনের এই স্বনির্ভর হওয়ার প্রচেষ্টা এশিয়ার রপ্তানি অর্থনীতিকে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো ছিল। কারণ ২০১৭ সালে তাইওয়ানের ৩৬%, ফিলিপাইনের ২১% এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ১৫% রপ্তানিই ছিল সেমিকন্ডাক্টর-নির্ভর। চীনের এই রূপান্তর পুরো বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থাকেই নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত।
যখন নিজস্ব উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত ফল আসছিল না, চীন তখন নিল দ্বিতীয় কৌশল – ‘টেকনোলজি ট্রান্সফার’ বা প্রযুক্তি হস্তান্তর। চুরি না করে, এবার তারা বিদেশি কোম্পানিগুলোকে প্রলুব্ধ বা চাপ দিতে শুরু করল যাতে তারা চীনের বাজারে প্রবেশের অনুমতির বিনিময়ে তাদের চিপ ডিজাইন ও প্রযুক্তি শেয়ার করে।
এখানেই একে একে বাজিমাত করল চীন:
• আইবিএম: মার্কিন নিরাপত্তা কম্পিউটিংয়ের প্রতীক আইবিএম চীনের বাজার ২০% হারানোর পর সম্পর্ক ঠিক করতে এগিয়ে আসে। তারা তাদের বিখ্যাত ‘পাওয়ার চিপ’ প্রযুক্তি চীনা অংশীদারদের সঙ্গে শেয়ার করার প্রস্তাব দেয়। এর ফলে আইবিএম বাজার ফিরে পায়, আর চীন লাভ করে সার্ভার চিপ তৈরির জ্ঞান।
• কোয়ালকম: স্মার্টফোন চিপ নির্মাতা কোয়ালকম চীনে অতিরিক্ত মূল্য নেওয়ার অভিযোগে তদন্তাধীন ছিল। সমঝোতার অংশ হিসেবে তারা চীনা সরকারের সঙ্গে একটি যৌথ কোম্পানি গঠন করে সার্ভার চিপ বানানোর জন্য। প্রকল্পটি ব্যর্থ হলেও এর প্রকৌশলীরা ও অভিজ্ঞতা পরে Phytium নামের আরেক চীনা সামরিক-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চলে যায়।
• এএমডি ও x86: সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটায় আর্থিক সংকটে থাকা এএমডি। ২০১৬ সালে তারা মালয়েশিয়া ও চীনে তাদের প্যাকেজিং প্ল্যান্টের ৮৫% শেয়ার বিক্রি করে এবং x86 প্রযুক্তির পরিবর্তিত সংস্করণ লাইসেন্স দেয় এক চীনা সরকারি কনসোর্টিয়ামকে। এই প্রযুক্তি চলে যায় প্রতিরক্ষা প্রকল্পে যুক্ত চীনা কোম্পানি Sugon-এর হাতে। যদিও ২০১৯ সালে Sugon নিষিদ্ধ হয়, কিন্তু তাদের বোর্ডে AMD চিপ পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ততদিনে চীনের হাতে।
• Arm হোল্ডিংস: জাপানের সফটব্যাংক কর্তৃক অধিগ্রহণের পর ব্রিটিশ কোম্পানি Arm (যার ডিজাইন বিশ্বের প্রায় সব স্মার্টফোনে ব্যবহৃত) তাদের চীনা শাখার ৫১% শেয়ার নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয়। কোম্পানির কর্মকর্তারাই পরে স্বীকার করেন যে, এই চুক্তির ফলে চীনা অংশীদাররা সামরিক ও নজরদারি প্রকল্পের জন্য নিজস্ব চিপ তৈরির সুযোগ পেয়েছিল।
আইবিএম, কোয়ালকম, এএমডি, Arm - প্রত্যেকেই নিজেদের স্বার্থে কাজ করেছিল। কেউ চেয়েছিল চীনা বাজারে ঢুকতে, কেউ টিকে থাকতে, কেউ লাভ তুলতে। কিন্তু তাদের এসব ‘যৌক্তিক’ সিদ্ধান্তের সমষ্টিগত ফল চীনের প্রযুক্তিগত উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছে। মাত্র এক দশকের মধ্যে চীন লাইসেন্স ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে x86, Arm আর্কিটেকচার, উন্নত সার্ভার চিপ ডিজাইন এবং উৎপাদন জ্ঞান অর্জন করে, যার বেশিরভাগই এসেছে চুক্তিভিত্তিক লেনদেনের মাধ্যমে, চুরি করে নয়।
শি জিনপিংয়ের 'মূল প্রযুক্তির দুর্গে আক্রমণের' আহবান তাই শেষ পর্যন্ত পরিণত হলো এক বাস্তব কৌশলে। দাভোসের সেই শান্ত বক্তৃতা শেষ পর্যন্ত একুশ শতকের ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণকারী এক বিশ্বব্যাপী সেমিকন্ডাক্টর প্রতিযোগিতায় রূপ নিল।
(ক্রিস মিলারের সাড়াজাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ৪৩তম ও ৪৪তম অধ্যায় “কল ফোর্থ দ্য অ্যাসল্ট” ও “টেকনোলজি ট্র্যান্সফার” থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)
লেখক পরিচিতি:
মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসি’র কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে