Views Bangladesh Logo

অপরাধের জালে বন্দি বগুড়া

Masum   Hossain

মাসুম হোসেন

দীতে মিলল অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের লাশ। কিশোরী মেয়েকে ৪২ বছরের ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে না দেওয়ায় বাবাকে পিটিয়ে হত্যা। আসামিকে ধরতে গিয়ে ছুরিকাঘাতের শিকার হন দুই পুলিশ সদস্য। কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ে জীবন বাঁচাতে ঈদের দিনে কোরবানির পশু নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় এক পরিবার। থেমে নেই চুরি, অপহরণ ও ছুরিকাঘাতের ঘটনাও। একের পর এক অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এমনকি আদালত প্রাঙ্গণেও নেই নিরাপত্তা। সবমিলে যেন অপরাধের জালে বন্দি হয়ে পড়েছে বগুড়া।

গত ১৪ জুন বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় শাকিল মিয়া নামের এক যুবককে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ রয়েছে, শাকিলের কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন চিহ্নিত সন্ত্রাসী জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক জিতু ইসলাম। শাকিল তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে পিটিয়ে হত্যা করেন জিতু ও তার সহযোগীরা।

এ ঘটনার পর জিতুকে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। নিহত শাকিল ও অভিযুক্ত জিতু বগুড়া শহরের শিববাটি এলাকার বাসিন্দা। একই দিন (১৪ জুন) বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া এলাকায় বিদ্যুৎ শেখ নামের আরও এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা হয়। গত ১৫ জুন মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি মুরাদুন্নবী নিশানকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে ছুরিকাঘাতের শিকার হন দুই পুলিশ সদস্য। নিশান বগুড়া সদরের শিকারপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার বাড়িতেই পুলিশ সদস্যদের ছুরিকাঘাত করা হয়।

পুলিশ জানায়, খবর পেয়ে নিশানকে গ্রেপ্তার করতে তার বাড়িতে অভিযানে গিয়েছিলেন বগুড়ার উপশহর পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এটিএসআই) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও কনস্টেবল মানিকুজ্জামান। অভিযানের এক পর্যায়ে এই দুই পুলিশ সদস্যকে ছুরিকাঘাত করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান নিশান। পরবর্তী ১৯ জুন নিশানকে গ্রেফতার করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

গত ৭ জুন ঈদুল আযহার দিন কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ে জবাই করা কুরবানির পশু সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় এক পরিবার। বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকায় তাদের বাড়িতে হামলা চালায় মালতিনগর এলাকার রতন গ্রুপের সদস্যরা। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিলে ঘটনাস্থলে পুলিশ এলেও কোনো সুরাহা মেলেনি। বরং পুলিশ পাহারায় তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচান। এ ঘটনার তিনদিন পর ওই পরিবারের সদস্যরা বাড়ি ফেরেন।

জানা গেছে, রতন গ্রুপের এক সদস্য বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এতে এক পথচারীকে (ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য) মোটরসাইকেলটির ধাক্কা লাগে। এসময় তিনি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে সাবধানে মোটরসাইকেল চালাতে বলেন। আর এতেই ক্ষিপ্ত হন রতন গ্রুপের ওই সদস্য। পরবর্তীতে কিশোর গ্যাং ওই বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে।

রতন গ্রুপের ভয়ে ভুক্তভোগী পরিবারটি আইনের আশ্রয় নেওয়ার সাহসও পাননি। এমনকি ঘটনাটি গোপন রাখতে চেয়েছিলেন হামলার শিকার হওয়া ওই পরিবার। গত ২ জুন বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায় ছুরিকাঘাতের শিকার হয়ে খুন হন সাইফুল ইসলাম নামের এক যুবক। অজ্ঞাত এক রিকশাচালক রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরই হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

সাইফুল চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাইফুলের পরিবারের পক্ষ থেকে শাজাহানপুর থানায় মামলা করা হয়েছে। গত ২১ জুন করতোয়া নদীর বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বেজোড়া এলাকা থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এখন পর্যন্ত সেই যুবকের পরিচয় পাওয়া যায়নি বলে জানান শাজাহানপুর থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম।

জানতে চাইলে বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) হোসাইন মুহাম্মদ রায়হান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, 'বগুড়া একটা জনবহুল এলাকা। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে অনেক খুনের ঘটনা ঘটে এই শহরে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে কোনো সংঘর্ষ বা দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান থেকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যেন না ঘটে সেদিকে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। পুলিশ উপস্থিত আছে এমন কোনো স্থানে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে না।'

বগুড়া শহরের চার নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও সাবেক যুবলীগ নেতা বগুড়ার চিহ্নিত সন্ত্রাসী আব্দুল মতিনকে গ্রেপ্তারের পর গত ২২ জুন বগুড়ার আদালতে নেওয়া হয়। সেখানে তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। সেইসাথে তাকে দেখতে আসা তার শ্যালক মিল্লাতও মবের শিকার হন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সামনেই মিল্লাতকে মারধর করা হয়। পরবর্তীতে তাকে (মিল্লাত) হেফাজতে নেয় পুলিশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা হোসাইন মুহাম্মদ রায়হান বলেন, 'আদালত প্রাঙ্গণে হামলার শিকার ব্যক্তিদের আমি নিজে রক্ষা করেছি। কিন্তু এরপরেও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়।' এর আগে, গত ৫ মে বগুড়া হোমিওপ্যাথিক কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এস এম মিল্লাত হোসেনকে মারধরের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে দেয়া হয়। মিল্লাত স্বাধীনতা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক পরিষদের বগুড়া জেলার সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক।

মব তৈরি করে তাকে (মিল্লাত) মারধর করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী। অভিযোগ রয়েছে, বগুড়ায় মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আইনগতভাবে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেইসাথে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও খুনসহ নানা অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে বগুড়া।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ