চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-৩
তাইওয়ান ও এশিয়ায় সেমিকন্ডাক্টর বিপ্লবের সূচনা
সালটা ১৯৬৮। মার্কিন টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস কোম্পানির দুই শীর্ষ কর্মকর্তা- মার্ক শেফার্ড ও মরিস চ্যাং- উড়ে এলেন তাইওয়ানের মাটিতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই: চিপ অ্যাসেম্বলির জন্য একটি নতুন কারখানা স্থাপনের উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করা। তাইওয়ানের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী কে টি লি-এর সঙ্গে তাদের বৈঠকটি অবশ্য মসৃণ ছিল না।
মেধাস্বত্ব আইনকে মন্ত্রী লি আখ্যা দিলেন ধনী দেশগুলোর এক সূক্ষ্ম চাল হিসেবে, যার মাধ্যমে তারা দরিদ্র দেশগুলোকে বশ করে রাখতে চায়; কিন্তু তাইওয়ানের সে সময়ে ছিল দুটি প্রকট সমস্যা- কর্মসংস্থান আর জাতীয় নিরাপত্তা। মন্ত্রী লি খুব দ্রুতই বুঝতে পারলেন, টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসের মতো একটি বিশাল মার্কিন সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেই এই দ্বৈত সমস্যার সমাধান সম্ভব। তখন আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তাই তাইওয়ানের মতো মিত্রদেশগুলোর প্রতি তাদের সমর্থন নড়বড়ে।
অন্যদিকে, সদ্য পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালানো চীনের ভয়ে তাইওয়ান তখন কাঁপছে। এমন এক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন তাইওয়ানের জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। মন্ত্রী লি এক সুদূরপ্রসারী ছক কষলেন- তাইওয়ানকে আমেরিকার অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করতে হবে, আর সেমিকন্ডাক্টরই হবে সেই স্বপ্নপূরণের সিংহদ্বার। তাইওয়ানে ছিল দক্ষ প্রকৌশলী, শ্রমিকের কম মজুরি এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির এক অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা।
মরিস চ্যাং টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসকে তাইওয়ানে প্ল্যান্ট স্থাপনে রাজি করাতে সক্ষম হলেন। মরিস চীনে জন্মগ্রহণ করলেও, তাইওয়ানে সেটাই ছিল তার প্রথম আগমন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তার দুই তাইওয়ানিজ বন্ধু তাকে বোঝালেন যে, তাইওয়ান ব্যবসার জন্য এক অসাধারণ ক্ষেত্র। এদিকে, মন্ত্রী লিয়ের মনেও টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টসকে নিয়ে ভাবনা বদলাতে শুরু করে। তিনি উপলব্ধি করলেন, একটি চিপ কারখানা তাইওয়ানের অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে পারে।
১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস তাইওয়ানে কারখানা স্থাপনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। এর ঠিক এক বছর পর, ১৯৬৯ সালের আগস্টে কারখানাটি চালু হয়। ১৯৮০ সালের মধ্যে তারা একশ কোটি চিপ উৎপাদন করে এক অভাবনীয় মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলে। তাইওয়ানের এই চোখ ধাঁধানো সাফল্য দেখে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ফিলিপাইনের মতো অন্যান্য এশীয় দেশেও আশার আলো জ্বলে ওঠে।
তারাও সানন্দ্যে চিপ কোম্পানিগুলোকে নিজেদের দেশে স্বাগত জানায়, কারণ তাদেরও কর্মসংস্থান বাড়ানো জরুরি ছিল। সে সময়ে সিঙ্গাপুরের অবিসংবাদিত নেতা লি কুয়ান ইউ তার দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি ও বেকারত্ব কমাতে নিরলস চেষ্টা করছিলেন। ফলস্বরূপ, টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস এবং ন্যাশনাল সেমিকন্ডাক্টর দ্রুতই সিঙ্গাপুরে তাদের কারখানা স্থাপন করে।
১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে এসে, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার কর্মী আমেরিকান কোম্পানির জন্য চিপ উৎপাদনে নিয়োজিত হয়। তারা কৃষিকাজ ছেড়ে এসব কারখানায় ভালো বেতনে কাজ শুরু করে, যা এই অঞ্চলে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও এনে দেয়। ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে, সিঙ্গাপুরের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলেকট্রনিক্স খাতের অবদান ছিল ৭ শতাংশের বেশি, এবং দেশটির মোট কারখানা চাকরির এক-চতুর্থাংশই ছিল এই খাতে।
এর সিংহভাগই এসেছিল সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের অবদান থেকে। মালয়েশিয়াতেও শহরগুলোতে (পেনাং, কুয়ালালামপুর) একের পর এক চিপ ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠে। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে, দেশটির ১৫ শতাংশ কৃষিজীবী মানুষ শহরে পাড়ি জমান, আর এই চিপ কারখানাগুলো তাদের জন্য নতুন কাজের দিগন্ত উন্মোচন করে। এতে বেকারত্ব কমার পাশাপাশি সমাজে এক নতুন স্থিতিশীলতা তৈরি হয়।
আমেরিকা ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহার করলেও, এই নতুন সাপ্লাই চেইন এশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও নিবিড় করে তোলে। এশিয়ার দেশগুলো কমিউনিজমের দিকে না ঝুঁকে বরং আমেরিকার সঙ্গে আরও গভীরভাবে অর্থনৈতিকভাবে জড়িয়ে পড়ে।
১৯৭৭ সালে মার্ক শেফার্ড আবারও তাইওয়ান সফর করেন এবং কে টি লির সঙ্গে দেখা করেন। এবার মার্কের মুখে ছিল আনন্দের হাসি। তিনি লিকে বললেন, ‘তাইওয়ান কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে আছে ঠিকই; কিন্তু এর অর্থনৈতিক শক্তি এই ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে পারবে। টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস এখানে থাকবে এবং আরও বড় হবে।’ আজও টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস তাইওয়ানে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, তাইওয়ান সিলিকন ভ্যালির এক অবিচ্ছেদ্য অংশীদার হয়ে ওঠে এবং বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিপ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
বর্তমান বিশ্বে চিপস কেবল একটি প্রযুক্তিগত পণ্য নয়, এটি ভূরাজনৈতিক কৌশল এবং রাষ্ট্রনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এশিয়া এই শিল্পের হাত ধরে পেল বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আমেরিকা পেল সস্তায় উচ্চমানের পণ্য উৎপাদনের সুযোগ। আর তাইওয়ান পেল এমন এক অর্থনৈতিক শক্তি, যা তাদের জাতীয় নিরাপত্তায় অনবদ্য ভূমিকা রাখছে।
(ক্রিস মিলারের সাড়া জাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর দ্বাদশ অধ্যায় (‘সাপ্লাই চেইন স্টেটক্র্যাফট’) থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)।
লেখক পরিচিতি: মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে