Views Bangladesh Logo

বিজয়ের মাসে বাংলাদেশ: মৌলবাদী উত্থান কিংবা বিজয়ের চেতনার নবজাগরণ

ডিসেম্বর এলেই বাংলাদেশের হৃদয়ে এক অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে—বিজয়, শোক আর গৌরব মিলেমিশে তৈরি হয় এক অপ্রতিরোধ্য আবেগ। ১৯৭১-এর বিজয় শুধু একটি যুদ্ধের সমাপ্তি নয়, বরং ছিল এক জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জয়, এক সভ্যতার মুক্তি। প্রতি বছর ডিসেম্বর তাই আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের গল্প, শত বাধা পেরিয়ে জন্ম নেওয়া একটি লাল-সবুজ পতাকার গর্ব। তবে বর্তমান বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে—বিজয়ের ৫৩ বছর পর আমরা কি সেই চেতনা ঠিকভাবে ধারণ করতে পারছি? নাকি সময়ের স্রোতে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় এবং সামাজিক বিভাজনে সেই আলো ক্ষীণ হয়ে আসছে? কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনা যেন এ প্রশ্নটিকে আরও তীব্র করে তুলেছে।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে মৌলবাদী ও উগ্র গোষ্ঠীগুলো যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে, তা শুধু উদ্বেগের নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও পরিচয়ের প্রশ্নে নতুন সংকট তৈরি করছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাঙালির সাংস্কৃতিক ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকে হামলা, মুক্তিযুদ্ধের এবং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর, বাউল-শিল্পীদের ওপর হামলা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উগ্রবাদের উত্থান— সব মিলিয়ে যেন এক ভৌতিক পুনরাবৃত্তি।

মৌলবাদিতাকে মৌলবাদীরা যতই নিরীহ বলে বোঝানোর চেষ্টা করুক, আদৌ কি তাই! যদি বলা হয়, মৌলবাদিতা আর মাস্তানি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, তাহলে উভয় পক্ষই তেড়ে আসবে মারতে। তবে তখন একটা প্রমাণ হাতেনাতে পাওয়া যাবে যে এই ধারণাটা মোটেই মিথ্যে নয়। দুটোই বিপজ্জনক, দুটোই জাতির জন্য ক্ষতিকর।

আমেরিকায় মৌলবাদের তৎপরতা শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। হতাশায় উদারনীতি ও আধুনিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল কিছু মানুষ, যারা বলতে চেয়েছিল মোক্ষ রয়েছে বাইবেলে প্রত্যাগমনে। বিবর্তনবাদ পড়ানো যাবে না বিদ্যালয়ে, এ দাবিও তুলেছিল তারা। কিন্তু এই মৌলবাদের সঙ্গে মৌলিক পার্থক্য আছে আমাদের দেশের মৌলবাদের। এখানে সে নিরীহ নয়, আদালতে যায় না। বরং তেড়ে আসে। মৌলবাদ যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তার প্রমাণ মিলেছে একাত্তরে; তখন সে ঘাতক হয়েছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায়।

দূর্ভাগ্যবশত, এদেশেই মৌলবাদীদের তৎপরতা আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে মাস্তানদের দৌরাত্ম। এ নিয়ে চিন্তিত অনেকেই, উদ্বিগ্ন ভীষণভাবে। গালমন্দও কম হচ্ছে না। কিন্তু এরা থামছে না, বরং যেন শক্তিশালীই হচ্ছে ক্রমাগত।

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয় মেহেরপুরের মুজিবনগরে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়েছিল। সেই সরকারের শপথ নেওয়ার স্থান বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে গড়ে তোলা হয় মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স। গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর ভাঙচুর হয় সেখানকার ছোট-বড় তিন শতাধিক ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরে যুদ্ধের বর্ণনা-সংবলিত ছোট ছোট ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকটি ভেঙে নিয়ে যায়। ১৫ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও সংস্কার কাজ হয়নি। মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার দেওয়া জীবিত দুজন ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিমুদ্দিন শেখ। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলো যারা ভাঙল, তারা বুঝল না– তারা কী ভাঙল!

খুলনায় শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য, ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বুলডোজার দিয়ে। এছাড়াও, কুষ্টিয়া থেকে সিলেট, রাজধানী থেকে জেলা—অসংখ্য স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্মারকে হামলার ঘটনা দেখা গেছে।

মুক্তিযোদ্ধা আজিমুদ্দিন শেখসহ সকল মুক্তিযোদ্ধাদেরই আক্ষেপের আরও অনেক কিছুই আছে! কারন, শুধু ভাস্কর্য ধ্বংসেই এই অবমাননা থেমে আছে ভাবলে ভুল হবে ভীষণ। একাত্তরে বিজয়ের পর তারা কি কোনদিন ভেবেছিলেন, ডিসেম্বর মাসের শুরু হবে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' স্লোগানে। তবে, এ ঘটনাই ঘটেছে চট্টগ্রামের সাউথ সন্দ্বীপ হাই স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে !

সারাদেশে এখন হরহামেশাই কারও অনুসারীকে আঘাত করা হচ্ছে, কারও গান থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও তরুণদের ভয় দেখানো হচ্ছে যেন তারা যেকোনো প্রগতিশীল চর্চা থেকে দূরে থাকে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশও কি খুব স্বাভাবিক? ক্যাম্পাসগুলোতে এমন কিছু গোষ্ঠীর দাপট বাড়ছে যারা মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করতে চাইছে প্রকাশ্যেই। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক রিপোর্টগুলোও প্রায়ই সতর্ক করছে এই বলে যে, বাংলাদেশে মৌলবাদী উপাদানগুলো দ্রুত সংগঠিত হচ্ছে এবং তারা সুযোগ পেলেই ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সমাজকে বিভক্ত করতে চাচ্ছে।

মৌলবাদীরা বলে ধর্মের সাহায্যে সমাজে শৃঙ্খলা আনবে। তা যদি সম্ভব হতো তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা অমন বিশৃঙ্খল হতো না। বস্তুত মৌলবাদীদের আসল চেহারা যদি কেউ দেখতে চান একাত্তরের আলবদরদের মধ্যে তা দেখতে পাবেন, যে চেহারা পাকিস্তানি সৈন্যদের তুলনায়ও জঘন্য ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে, আওয়ামী শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধকে পারিবারিক অর্জনের অপচেষ্টার কারনে তরুনদের একটা অংশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী করে তুলেছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি। তারা হীন কৌশলো চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টা করেছে।

তবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শক্তি সবসময়ই এর তরুণ প্রজন্ম। ১৯৭১-এ তরুণরা অস্ত্র হাতে দেশের জন্য জীবন দিয়েছিল, ১৯৯০-এর গণআন্দোলনে সামরিক শাসনের পতন ঘটিয়েছিল, আর ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানেও তারা প্রমাণ করেছে— বাংলাদেশ মাথা নত করবে না। গণঅভ্যুত্থানের সময় রাস্তায় নেমে আসা লাখো তরুণের চোখে ছিল মুক্তিযুদ্ধের আগুনের মতোই দীপ্তি। ‘বিজয়ের চেতনা’ বা ‘স্বাধীনতার মূল্য’— এসব শব্দ তখন আর ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ ছিল না; তা হয়ে উঠেছিল তাদের আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি।

যেখানে মৌলবাদী অপশক্তি মানুষকে ভয় দেখাতে চেয়েছে, সেখানে এখনো তরুণরা দাঁড়িয়ে বলছে— বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক, প্রগতিশীল রাষ্ট্র; যেটি কোনো ধর্মের অপব্যবহারকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। যেখানে উগ্রবাদীরা ভাস্কর্য ভেঙ্গে চলেছে, সেখানে তরুণরা মোমবাতি জ্বালিয়ে ভগ্ন ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়েছে। যেখানে সংগীত থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে তরুণেরা আবার গেয়ে উঠেছে স্বাধীনতার জয়গান। এই নতুন প্রজন্মই প্রমাণ করেছে— বিজয়ের চেতনা শেষ হয়ে যায়নি; ওটা আমাদের রক্তেই রয়েছে। শুধু প্রয়োজন তাকে সঠিক পথে ধারণ করা, তাকে রক্ষা করা।

ডিসেম্বর আমাদের শুধু স্মরণ করায় না, এটা আমাদের শপথ করায়। আমরা কি এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে মৌলবাদ মাথা তুললে তরুণরা একসাথে দাঁড়িয়ে বলবে— “না, এটা আমার বাংলাদেশ নয়”? সংস্কৃতি, মানবতা, ভাষা, শিল্প, মুক্তচিন্তা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, বাংলাদেশ।

বিজয়ের মাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার মূল্য শুধু ১৯৭১-এর যুদ্ধেই নেই; আজকের প্রতিদিনের লড়াইটাও সে যুদ্ধেরই ধারাবাহিকতা। মৌলবাদী উত্থান যতই ভয়াবহ হোক, তরুণদের নতুন জাগরণ দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ বিপদের মুখে থেমে যায় না। এখনকার বিজয়ের যেটুকু চেতনা আছে পুরোটাই বিশুদ্ধ, চাপিয়ে দেয়া নয়। দেশের ভবিষ্যৎ এখনও আলোর পথেই, যদি আমরা সবাই মিলে সেই বিজয়ের, স্বাধীনতার চেতনাকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করি।

এই ডিসেম্বর তাই শুধু স্মৃতির নয়— এটা সতর্কতার, প্রতিরোধের এবং নতুন করে জেগে ওঠার মাস।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ