চিপ যুদ্ধের গল্প: পর্ব-১৬
অ্যাপল সিলিকন
স্টিভ জবসের হাতে গড়া অ্যাপলের কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এমন সব পণ্য, যা দেখতে সুন্দর, স্পর্শে আরামদায়ক এবং কাজে নিখুঁত। তাদের এই ‘দেখা, অনুভূতি ও কাজের মান’ নিয়ে অ্যাপল বরাবরই ছিল ভীষণ যত্নশীল। কিন্তু খুব কম লোকই জানেন যে আইফোন, আইপ্যাড ও ম্যাককে চালিত করা সেই অতি ক্ষুদ্র চিপগুলো অ্যাপল নিজেই ডিজাইন করে। বস্তুত, টিএসএমসির নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে যে 'ফ্যাবলেস বিপ্লব' হয়েছিল, অ্যাপল ছিল সেই সেমিকন্ডন্ডাক্টর দুনিয়ার অন্যতম প্রধান বিজয়ী।
২০০৭ সালে যখন প্রথম আইফোন বাজারে আসে, অ্যাপল তখন নিজস্ব আইওএস সফটওয়্যার ব্যবহার করলেও, প্রসেসরসহ এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আসত অন্য কোম্পানি থেকে; যেমন: স্যামসাং-এর প্রধান প্রসেসর, ইন্টেলের মেমরি, ওলফসনের অডিও প্রসেসর, ইনফিনিয়নের মোবাইল মডেম, সিএসআরের ব্লুটুথ চিপ এবং স্কাইওয়ার্কসের সিগন্যাল অ্যাম্প্লিফায়ার। আইফোন নিঃসন্দেহে ছিল একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার, কিন্তু তার আসল 'হৃদয়' (সিলিকন) তখনো পুরোপুরি অ্যাপলের নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
তবে এই পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে শুরু করে। ২০০৮ সালে অ্যাপল PA Semi নামে সিলিকন ভ্যালির একটি ছোট কোম্পানি কিনে নেয়, যারা কম শক্তিতে চালিত প্রসেসর তৈরি করত। এই অধিগ্রহণের ফলে অ্যাপল হাতে পায় এক দক্ষ চিপ ডিজাইন টিম। এরপরই তারা বিশ্বজুড়ে সেরা চিপ প্রকৌশলীদের নিয়োগ দেওয়া শুরু করে এবং সিলিকন ভ্যালি, ইসরায়েল ও জার্মানিতে অত্যাধুনিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে।
ঠিক দুই বছর পর, অ্যাপল বাজারে আনল তাদের প্রথম নিজস্ব চিপ A4, যা ব্যবহৃত হলো iPhone 4 এবং প্রথম iPad-এ। এমন জটিল চিপ তৈরির জন্য বিশাল বিনিয়োগ করতে হলেও, এর ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। অ্যাপল নিশ্চিত করল হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের নিখুঁত সমন্বয় ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। এই 'ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশন' হয়ে উঠল অ্যাপলের শক্তির উৎস।
২০১১ সালের মধ্যে, প্রথম আইফোন আসার মাত্র চার বছরের মাথায়, অ্যাপল একাই বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোন ব্যবসার মুনাফার ৬০ শতাংশের বেশি দখল করে নেয়। নকিয়া ও ব্ল্যাকবেরির মতো পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়ল, আর বাকিরা কম দামের বাজারে নিজেদের টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকল। পরবর্তীতে অ্যাপল AirPods-এর মতো পণ্যের জন্যও নিজস্ব চিপ তৈরি শুরু করে, যা তাদের পুরো ইকোসিস্টেমকে আরও শক্তিশালী করে তুলল।
অ্যাপল কিন্তু নিজে কোনো চিপ বা ডিভাইস তৈরি করে না। তারা নির্ভর করে এক সুবিশাল বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের ওপর। অ্যাপলের পণ্য মূলত চীনে সংযোজন করা হয়, সেখানে ফক্সকন ও উইস্ট্রন নামের তাইওয়ানি কোম্পানিগুলোর লক্ষাধিক কর্মী কাজ করে। চীনের উপকূলীয় শহর ডংগুয়ান ও জেংজোউ এখন বিশ্বের প্রধান ইলেকট্রনিক্স তৈরির কেন্দ্র। যদিও বর্তমানে ভিয়েতনাম ও ভারতেও কিছু অ্যাপল পণ্য সংযোজন হয়।
২০১০ সালের দিকে, বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত চিপ বানানোর ক্ষমতা ছিল মাত্র তিনটি কোম্পানির হাতে: তাইওয়ানের টিএসএমসি, দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং এবং যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবালফাউন্ড্রিস। ইন্টেল তখনো পিসি চিপে শীর্ষে থাকলেও, অন্য কোম্পানির জন্য চিপ তৈরি করত না। এর ফলে তৈরি হয় এক নতুন ধরনের বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন।
পিসির মতো, স্মার্টফোনও মূলত চীনে সংযোজন হয়, কিন্তু এর মূল্যবান অংশ আসে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান ও কোরিয়া থেকে। পার্থক্য হলো, স্মার্টফোনে নেটওয়ার্ক, ওয়াইফাই, ব্লুটুথ, ক্যামেরা, মোশন সেন্সর, অডিও, ব্যাটারি ও মেমরির জন্য থাকে অনেক বেশি চিপ। এই চিপগুলিই ফোন তৈরির মোট খরচের বড় একটি অংশ। সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন প্রযুক্তি যত উন্নত হয়েছে, এর বড় অংশই চলে গেছে পূর্ব এশিয়ায়। যেমন, অ্যাপলের A-সিরিজ চিপ ক্যালিফোর্নিয়ায় ডিজাইন করা হলেও, তৈরি হয় তাইওয়ানে। পরে তা পাঠানো হয় চীনে, যেখানে এই চিপকে যুক্ত করে তৈরি হয় চূড়ান্ত আইফোন।
২০১০-এর দশকে টিএসএমসি হয়ে ওঠে অ্যাপলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। অ্যাপল পুরোপুরি টিএসএমসির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, কারণ অ্যাপলের চাহিদা মেটানোর মতো প্রযুক্তি বা উৎপাদন ক্ষমতা আর কোনো কোম্পানির ছিল না। প্রতিটি আইফোনের গায়ে লেখা থাকে ‘Designed by Apple in California. Assembled in China’। কিন্তু আসলে সত্যিটা হলো, আইফোনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ক্যালিফোর্নিয়ায় ডিজাইন করা হয়, চীনে সংযোজন করা হয়, কিন্তু তৈরি করা যায় কেবল তাইওয়ানে।
আমেরিকার ডিজাইন, তাইওয়ানের উৎপাদন, আর চীনের সংযোজন - এই তিনের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বৈশ্বিক কাঠামো। আর এর ঠিক মাঝখানে এক অনন্য ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে অ্যাপল।
(ক্রিস মিলারের সাড়াজাগানো বই ‘চিপ ওয়ার’-এর ৩৮তম অধ্যায় “অ্যাপল সিলিকন” থেকে পরিবর্তিত ও সংক্ষেপিত অনুলিখন)
লেখক পরিচিতি:
মাহমুদ হোসেন, বুয়েটের একজন স্নাতক, বাংলাদেশের টেলিকম ও আইসিটি খাতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের মোবাইল প্রযুক্তি প্রচলনের সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিটিআরসি’র কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, এর আগে তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে