৯ বছরেও শেষ হয়নি হলি আর্টিসান হত্যা মামলার চূড়ান্ত বিচার
ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে ৯ বছর। এখনো চূড়ান্ত বিচার শেষ হয়নি চাঞ্চল্যকর হোলি আর্টিজান হত্যা মামলার। এ মামলায় আপিল, জেল আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর হাইকোর্টের দেয়া রায় চ্যালেঞ্জ করে করা আপিল বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। চলতি বছর জানুয়ারিতে কয়েকদফা কার্যতালিতায় আসলেও ফেব্রুয়ারি থেকে তাও আসছে না। এমন অবস্থায় এই শুনানি কবে শুরু হবে তা জানে না রাষ্ট্রপক্ষও।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এ বিষয়ে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে জঙ্গি হামলা চালিয়ে বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যার ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ দেশে জঙ্গির উপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর ওই ঘটনায় করা মামলায় জেএমবির ৭ সদস্যকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। এরপর আপিল হলেও এর শুনানি এখনো শুরু হয়নি। আপিল বিভাগে মামলার অত্যধিক চাপ এই শুনানি বিলম্বের অন্যতম কারণ। এমন অবস্থায় কবে নাগাদ চাঞ্চল্যকর হলি আর্টিসান হত্যা মামলার আপিল শুনানি শুরু হবে তা এখনই বলা মুশকিল।’
গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হামলা চালিয়ে বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির সদস্যরা। তাদের গুলিতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। পরে কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় ৫ জঙ্গি। এই ঘটনায় গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। তদন্ত শেষে ৮ আসামির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালত তার রায়ে ৭ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে খালাস দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো- হামলার মূল সমন্বয়ক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র্যাশ, ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ। প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। অন্যদিকে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলার অপর আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেন আদালত।
বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ রায়ের পর নিয়ম অনুসারে ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স ও খালাস চেয়ে করা আসামিদের জেল আপিল শুনানির জন্য মামলার নথিপত্র বিচারিক আদালত থেকে হাইকোর্টে আসে। বিচারিক আদালতের এসব নথির মধ্যে মামলার এজাহার, জব্দ তালিকা, চার্জশিট, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও রায়সহ মোট ২ হাজার ৩০৭ পৃষ্ঠার নথিপত্র হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় জমা করা হয়। এরপর বিচারিক আদালত থেকে আসা মামলাটির সব নথিপত্র একত্রিত করে আপিল শুনানির জন্য উত্থাপনের জন্য পেপারবুক তৈরি শেষে মামলাটি শুনানিতে ওঠে।
২০২৩ সালের শুরুর দিকে হাইকোর্টে মামলাটির ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। যা শেষ হয় একই বছরের ১১ অক্টোবর। পরে ৩০ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জেএমবির ৭ সদস্যকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের ১৭ জুন। ২২৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি পরে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। হাইকোর্টে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। পরে তারা নিয়মিত আপিল করেন আপিল বিভাগে। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা কমানোর বিষয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে- ‘এটা স্বীকৃত যে ঘটনার তারিখ ও সময়ে ঘটনাস্থলে ঘটনাটি ঘটানোর উদ্দেশ্যে আপিলকারীদের কেউ উপস্থিত ছিল না কিংবা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ঘটনাটি ঘটানোর জন্য কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। ফলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারার অভিযোগ এই আসামিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
বিচারিক আদালত ‘একই অভিপ্রায়ের’ বিষয়টি উল্লেখ করে আপিলকারীদের (সাত আসামি) সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন তা সঠিক নয় বলে আমরা মনে করি। আপিলকারী আসামিদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ওই আইনের ৬(২)(অ) ধারায় দণ্ড প্রদান (মৃত্যুদণ্ড) করা সঠিক হয়নি বলে রায়টি (বিচারিক আদালতের রায়) হস্তক্ষেপযোগ্য।’ রায়ে আদালত আরও বলেছেন, ‘আপিলকারী আসামিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ, বাছাই, নিয়োগ ও দীর্ঘদিন গোপন স্থানে রেখে শারীরিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ দেয়াসহ হত্যাকাণ্ডে প্ররোচিত করার কারণে ওই ৫ সন্ত্রাসী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সক্ষম হয়েছে বলে প্রসিকিউশন পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে আপিলকারী আসামিদের অপরাধের ক্ষেত্রে ৬(১)(ক)(আ) ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে বলে আমরা মনে করি।’ হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ‘বিচারিক আদালতের দেয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ রদ ও রহিত করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(আ) ধারায় দোষীসাব্যস্ত করে তাদের প্রত্যেককে (সাত আসামি) আমৃত্যু কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও ৫ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।
ওই মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন) এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন। ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন) নামঞ্জুর করে আসামিদের আপিল ও জেল আপিল খারিজ করে এ রায় দেয়া হয়। বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলায় রায়টি লেখেন। যার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি সহিদুল করিম। রায়ে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সাত জঙ্গিকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন হাইকোর্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে