বিষণ্ন পৃথিবীর মহাকাব্য রচয়িতার হাতে সাহিত্যের নোবেল
সাধারণ পাঠকদের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে মাথা ঘামানো অনেকটা ‘আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর’ রাখার মতো। তারপরও দেখি এখনো অনেকে সাহিত্যে কে নোবেল পুরস্কার পেলেন, তা নিয়ে মাথা ঘামায়। এর সুনির্দিষ্ট কারণও আছে। সাহিত্য তো আসলে আমাদের জীবনেরই কথা। মানুষের হাসি-কান্না, ভালোবাসা-বিরহ, আশা-নিরাশা- সবকিছুর প্রতিবিম্ব লক্ষ করা যায় সাহিত্যের পাতায়। তাই মননশীল ব্যক্তির কাছে সাহিত্য শুধু বিনোদন নয়- এ এক গভীর জীবনচর্চা; কিন্তু আজকের যুগে, যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার নেশায় অন্য সবকিছুর গুরুত্ব অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের খবর রাখে- এমন মানুষ আজ হাতেগোনা। তবে প্রতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর হঠাৎ করেই সেই আগ্রহ ফিরে আসে- কে পেলেন, কেন পেলেন, তিনি কী লিখেছেন- এসব নিয়ে চারদিকে শুরু হয় আলোচনা, বিশ্লেষণ আর নতুন কৌতূহল। সেই দিক থেকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার এখনও সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা।
আর নোবেল পুরস্কার নিঃসন্দেহে সাহিত্য জগতের অন্যতম সেরা স্বীকৃতি। যদিও ইতিহাসে এমন অনেক মহৎ সাহিত্যিক আছেন, যারা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এই সম্মান পাননি। যেমন- আধুনিক গদ্যের বিপ্লবী কারিগর জেমস জয়েস, দার্শনিক কল্পনার জাদুকর হোর্হে লুইস বোর্হেস, আফ্রিকার মৌলিক কণ্ঠস্বর চিনুয়া আচেবে, আর ভাষাশিল্পের চৌকস রূপকার ভ্লাদিমির নাবোকফ।
এশিয়াতেও রয়েছেন এমন অনেক নক্ষত্র- মুনশি প্রেমচাঁদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হারুকি মুরাকামি বা ইন্তিজার হুসেইন- যাদের রচনা দেশ ও ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছেছে বিশ্বসাহিত্যের দরজায়। তারা নোবেল না পেলেও পেয়েছেন পাঠকের নিবিড় ভালোবাসা, সময়ের শ্রদ্ধা আর সাহিত্যিক ইতিহাসে অমর আসন।
এ বছর ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়-এর নামও জোর আলোচনায় ছিল। তার ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ তাকে বুকার এনে দিয়েছিল, আর তার লেখায় রাজনীতি, সমাজ ও মানবাধিকার নিয়ে যে গভীর চিন্তা প্রতিফলিত হয়, তা তাকে পুরস্কারের খুব কাছে নিয়ে এসেছিল। তালিকায় আরও ছিলেন অমিতাভ ঘোষ-এর মতো দিকপাল লেখক।
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন হাঙ্গেরির বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। সুইডিশ একাডেমি তাকে সম্মানিত করেছে এই মন্তব্যের ভিত্তিতে: ‘প্রলয়ের ভয়াবহতার মাঝেও যিনি শিল্পের শক্তিতে মানবতার স্বপ্নকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।’
২০১৪ সালে ম্যান বুকার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন ক্রাসনাহোরকাই, যা তার সাহিত্যিক মর্যাদাকে আরও উঁচুতে তুলে ধরেছিল। সমালোচকরা তাকে চেনেন দীর্ঘ, জটিল ও দার্শনিক গদ্যের লেখক হিসেবে। তার রচনায় মানুষের অন্তর্জগৎ, নিঃসঙ্গতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অস্তিত্বের সংকট তীব্রভাবে প্রকাশ পায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘স্যাটানটাঙ্গো’ তাকে বিশ্বসাহিত্যে পরিচিত করে তোলে। প্রায় ১৮০০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে একটি কৃষি সমবায় গ্রামের জীবনের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে বিভ্রম, আশা ও নৈতিক জড়তার এক প্রতীকী চিত্র। লেখকের একটি বিখ্যাত লাইন: ‘এভরিথিং হ্যাজ টার্নড টু মাড, ইনসাইড অ্যান্ড আউট।’ এই বাক্য যেন কেবল মাটির অবস্থা নয়, মানুষের ভেতরের স্থবিরতারও প্রতীক।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার শ্বাসরুদ্ধকর দীর্ঘ বাক্যরীতি। তার গদ্য যেন একটি চিন্তা-স্রোত, যা একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িয়ে অনন্ত প্রবাহে এগিয়ে চলে। যেমন ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’-এর প্রথম অধ্যায়ে তিনি তার চরিত্রটির মানসিক জট তুলে ধরেন এক অসাধারণ দীর্ঘ বাক্যে। সেই বাক্যে প্রকাশিত হয় ৪৪ বছর বয়সী এক মানুষের আত্ম-সচেতনতার এক ভয়াবহ উপলব্ধি- সে এতদিন ধরে যা বুঝেছে বলে ভেবেছিল, তার কিছুই আসলে বোঝেনি। এই উপলব্ধি তার মাথায় এক ভয়ংকর ধাঁধা তৈরি করে, যা পৃথিবীর ধাঁধা ও নিজের ধাঁধা হিসেবে একাকার হয়ে যায়। ‘কারণ তার জন্মদিনে সে একা ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে চায়নি, এবং সত্যি বলতে হঠাৎ করেই তাকে যেন বজ্রপাতের মতো আঘাত করল এই উপলব্ধি- হায় ঈশ্বর, সে কিছুই বোঝে না, একদম কিছুই না, কোনো কিছুরই অর্থ সে ধরতে পারে না- এ এক ভয়ংকর উপলব্ধি, সে বলল, বিশেষ করে যেভাবে এটা তার কাছে এল, এমন নিস্তরঙ্গ, এমন তুচ্ছ, এমন হাস্যকরভাবে নগণ্য আকারে, কিন্তু এইটিই আসল ব্যাপার, সে বলল- যে চুয়াল্লিশ বছর বয়সে এসে সে বুঝতে পারল, কী অগাধ বোকামির মধ্যে সে ডুবে ছিল, কী ফাঁকা, একেবারে নির্বোধভাবে সে পৃথিবীকে বোঝার চেষ্টা করেছিল এত বছর ধরে, কেননা, নদীর ধারে বসে তার মনে হলো, সে শুধু পৃথিবীটাকেই ভুল বুঝেনি, বরং কিছুই বোঝেনি- কোনো কিছুরই কিছু বোঝেনি, আর সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো, এই চুয়াল্লিশ বছর ধরে সে ভেবেছে যে সে বুঝেছে! অথচ বাস্তবে সে কিছুই বোঝেনি; এবং সেটাই তার জন্মদিনের সেই রাতে নদীর ধারে একা বসে থাকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক, কারণ এখন সে যে বুঝল যে সে বোঝেনি, সেটি মানে নয় যে সে এখন বুঝেছে- কারণ নিজের অজ্ঞতার বিষয়ে সচেতন হওয়া কোনো নতুন জ্ঞান নয় যা পুরোনো জ্ঞানের জায়গায় বসানো যায়; বরং এটি এক ভয়ংকর ধাঁধা, যা মাথায় আসা মাত্রই সে পৃথিবী নিয়ে ভাবতে শুরু করলে, আর সে সেই সন্ধ্যায় প্রবলভাবে তা ভেবে নিজেকে প্রায় যন্ত্রণা দিচ্ছিল, বোঝার জন্য লড়ছিল, কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছিল, কারণ ধাঁধাটা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল, এবং তখন তার মনে হচ্ছিল- এই পৃথিবীর ধাঁধা, যা বোঝার জন্য সে মরিয়া, আসলে একই সঙ্গে নিজের ধাঁধাও, সে নিজে আর পৃথিবী- এরা আসলে এক এবং অভিন্ন; এটাই ছিল এখন পর্যন্ত তার পাওয়া সিদ্ধান্ত, এবং সে তখনো তা ছাড়েনি, যখন দুদিন পর সে টের পেল, তার মাথায় যেন কিছু একটা ঘটছে।’ (ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার, প্রথম অধ্যায় পৃষ্ঠা-৩-৫)। এই দীর্ঘ রচনাশৈলী তার মনের বিশৃঙ্খলা, বোধের জটিলতা আর অস্তিত্বের শূন্যতাকে যেন মূর্ত করে তোলে।
তিনি আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘হি ওয়াজ থিংকিং এন্ডলেসলি, উইথ সেন্টেন্স দ্যাট হ্যাড নো অ্যান্ড।’- যেন তার নিজের লেখারই প্রতিচ্ছবি। তার ভাষা কখনো কঠিন, কখনো মন্ত্রমুগ্ধকর। প্রতিটি বাক্যে তিনি মনস্তত্ত্ব, বেদনা ও অর্থহীনতার অভিজ্ঞতা মিশিয়ে দেন, যা পাঠককে এক অচেনা বাস্তবতায় টেনে নেয়।
‘দ্য মেলানকলি অব রেজিসট্যান্স’ উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন এক শহরের মানসিক ভাঙন- যেখানে এক বিশাল তিমির আগমনে আতঙ্কে মানুষ হয়ে ওঠে অযৌক্তিক, ক্রুদ্ধ ও ভীত। তিনি লিখেছেন: ‘পিপল ক্যাননট এন্ডিউর দ্য মনোটনি অব পিস, সো দে ইনভেন্ট ক্যাটাস্ট্রফিস।’ এই কথায় প্রকাশ পায় আধুনিক মানুষের আত্মবিনাশী প্রবণতা, যা তার প্রায় সব লেখায় ফিরে আসে।
তার উপন্যাস ‘সিয়োবো দেয়ার বিলো’-এর সূচনায় তিনি লিখেছেন: ‘অ্যাট দ্য কামো রিভার, আ হোয়াইট হেরন ওয়েটস- অ্যান্ড দ্য ওয়েটিং ইটসেল্ফ ইজ ইটার্নিটি।’ এই ‘অপেক্ষা’ ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাহিত্যজগতের কেন্দ্রীয় রূপক- সময় যেন থেমে যায়; কিন্তু তবুও অস্তিত্বের এক অর্থ জন্ম নেয়। সেখানে তিনি আরও লেখেন: ‘আর্ট ইজ নাথিং বাট দ্য এন্ডলেস প্রিপারেশন ফর অ্যান এনকাউন্টার দ্যাট মে নেভার কাম।’ এই বাক্য যেন শিল্পসৃষ্টির সবচেয়ে সৎ স্বীকারোক্তি- শিল্পী জানেন না তার সাধনা কবে, কীভাবে বা কার কাছে পৌঁছাবে।
ক্রাসনাহোরকাই প্রভাবিত হয়েছেন কাফকা, থমাস বার্নহার্ড ও স্যামুয়েল বেকেটের মতো লেখকদের কাছ থেকে। তবে তিনি কেবল হতাশার অন্ধকারে থেমে থাকেন না; বরং সেই অন্ধকারে খোঁজেন এক আধ্যাত্মিক আলোর আভাস। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন: ‘মাই বুকস আর অ্যাবাউট দ্য অ্যান্ড অব এভরিথিং, বাট ইন দ্যাট অ্যান্ড, দেয়ার ইজ স্টিল দ্য লগিং ফর গ্রেস।’
তিনি যেন আমাদের শেখান- শিল্পের উদ্দেশ্য মহিমা নয়, নিঃস্বতা। তার রচনায় প্রশ্ন জাগে, মানুষ যদি নিজেকে হারাতে ভয় না পেত, তবে হয়তো সে সত্যিকারের মুক্ত হতো। তার কলমে মানবতা কখনো নায়ক নয়, বরং পথহারানো এক আত্মা, যে আলো খোঁজে অন্ধকারের ভিতর। তিনি লিখেছেন: ‘উই লিভ ইন রুইনস, বাট উই মাস্ট স্টিল সিং অব দ্য পসিবিলিটি অব বিউটি।।’ এ যেন নোবেল কমিটির প্রশংসা-বাক্যের প্রতিধ্বনি- শিল্পের সেই শক্তি, যা ধ্বংসের মধ্যেও মানব আত্মাকে টিকিয়ে রাখে।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের প্রভাব গদ্যের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে চলচ্চিত্র ও সংগীতেও। তিনি একাধিক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন- যেমন ড্যামনেশন, ওয়ের্কমিস্টার হারমোনিজ, দ্য তুরিন হর্স- যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে অর্থহীনতার ভয়, মানবিক নিঃসঙ্গতা ও নৈতিক ভাঙন। সুইডিশ একাডেমি তাকে বর্ণনা করেছে: ‘আ ভিশনারি অথর হুজ প্রোজ হ্যাজ রিঅ্যাফার্মড দ্য পাওয়ার অব আর্ট অ্যামিড গ্লোবাল ডেভাস্টেশন।’
এই পুরস্কার শুধু একজন লেখকের ব্যক্তিগত অর্জন নয়; এটি সাহিত্যপ্রেমী পৃথিবীর এক যৌথ আনন্দ। কারণ সত্যিকারের সাহিত্য কোনো দেশের, ভাষার বা সংস্কৃতির সীমায় আবদ্ধ থাকে না- তা ছড়িয়ে পড়ে মানবতার গভীরে।
বাঙালি পাঠকের কাছে লাসলো ক্রাসনাহোরকাই হয়তো নতুন নাম, কিন্তু তার লেখার মানবিক সুরে আমরা খুঁজে পাই অস্তিত্বের আনন্দ কিংবা অন্ধকারের মধ্যে আলো। তার রচনায় সময় থেমে থাকে, কিন্তু মানুষ থামে না- সে এখনো জীবনের অর্থের খোঁজে এগিয়ে চলে, আর শিল্প হয়ে ওঠে তার একমাত্র সঙ্গী।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট
তথ্যসূত্র:
• Interview with Krasznahorkai. (2015, March 14). The Paris Review. Retrieved from https://www.theparisreview.org
• Krasznahorkai, L. (1985). Satantango (G. Szirtes, Trans.). New Directions.
• Krasznahorkai, L. (1989). The Melancholy of Resistance (G. Szirtes, Trans.). New Directions.
• Krasznahorkai, L. (2013). Seiobo There Below (O. Mulzet, Trans.). New Directions.
• Krasznahorkai, L. (1999). War & War (G. Szirtes, Trans.) New Directions
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে