Views Bangladesh Logo

অ্যামাজনকে সাক্ষী রেখে জলবায়ু সুরক্ষার লড়াইয়ে বিশ্বনেতারা

অ্যামাজনের বিস্তৃত সবুজ অরণ্য ঘিরে ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর বেলেমে চলছে জাতিসংঘের ৩০তম জলবায়ু সম্মেলন—কপ৩০। যখন বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন মানবজীবনের জন্য স্পষ্ট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন রাষ্ট্রপ্রধান থেকে বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ থেকে তরুণ কর্মী—সবাই হাজির হয়েছেন একই প্রশ্ন নিয়ে: আমরা কি সত্যিই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারছি?

গত বছরের কপ২৯–এর (বাকু, আজারবাইজান) ঘোষিত ‘বাকু টু বেলেম রোডম্যাপ’ অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তায় প্রতিবছর অন্তত ১.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এবার বেলেমে আলোচকরা সেই বিশাল প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার পথ খুঁজতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা উদ্বোধনী ভাষণে ঘোষণা করেছেন ‘ট্রপিকাল ফরেস্ট ফরএভার ফ্যাসিলিটি (টিএফএফএফ)’-এর পরিকল্পনা। এর উদ্দেশ্য—১২৫ বিলিয়ন ডলারের একটি বিশেষ তহবিল গঠন করে ক্রান্তীয় বন রক্ষায় দেশগুলোকে উৎসাহিত করা। যদিও সম্মেলনের মধ্যবর্তী পর্যায়ে প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি মিলেছে, তা এখনো লক্ষ্যের তুলনায় অনেক কম।

প্রযুক্তি, আইসিটি ও এআই: জলবায়ু এজেন্ডার নতুন যুগ
এবারের কপের বিশেষত্ব—প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে (এআই) জলবায়ু সমাধানের মূল অক্ষে তুলে আনা। আগের কপগুলোয় প্রযুক্তির উপস্থিতি সীমিত ছিল, কিন্তু বেলেমে তা মূলধারায় উঠে এসেছে।

সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক সূচিতে ‘বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’কে অন্যতম থিম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উদ্বোধন হয়েছে গ্রিন ডিজিটাল অ্যাকশন (জিডিএ) হাব—যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সবুজ ডিজিটাল সমাধান, তথ্যভান্ডার ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।

আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সংস্থা আইটিইউ-এর সহযোগিতায় চালু হয়েছে এআই ক্লাইমেট ইন্সটিটিউট (এআইসিআই), যা উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রশিক্ষণ, ওপেনসোর্স ডেটাসেট এবং কম-শক্তি খরচের এআই মডেল তৈরি করবে।

কৃষিখাতে ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বিল–মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এক ওপেনসোর্স এআই ভাষা মডেল এবং ‘এইম অব স্কেল’ নামের পূর্বাভাস ব্যবস্থা তৈরির ঘোষণা দিয়েছে—যা ২০২৮ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ১০ কোটি কৃষককে সহায়তা করবে।

গায়ানা তাদের এআইভিত্তিক বন পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি প্রদর্শন করেছে, যেখানে রিয়েল-টাইম সেন্সর ও উপগ্রহ তথ্য ব্যবহার করে বনস্বাস্থ্য নিরীক্ষণ করা হচ্ছে।

কেন এ প্রযুক্তিকেন্দ্রিক উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ আজ সম্পূর্ণ তথ্যনির্ভর। কৃষি, পানি, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ পূর্বাভাস—সব ক্ষেত্রেই তথ্য, সেন্সর, উপগ্রহ ও এআই এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি এক ধরনের ‘লিপ-ফ্রগিং সুযোগ’—অর্থাৎ পুরনো অবকাঠামো ছাড়াই সরাসরি আধুনিক প্রযুক্তির যুগে প্রবেশের সুযোগ।

বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এআই–ভিত্তিক আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা, উপকূল পর্যবেক্ষণ ও কৃষিউৎপাদন পূর্বাভাস বড় পরিবর্তন আনতে পারে।

তবে সতর্কতাও রয়েছে—ডিজিটাল বিভাজন এখনো বড় বাস্তবতা। প্রযুক্তির কার্বন ফুটপ্রিন্ট ও শক্তি ব্যয়ও জটিল প্রশ্ন। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নির্ভরতার ঝুঁকিও রয়েছে। তাই কপ৩০–এ ওপেনসোর্স, দক্ষ মানবসম্পদ এবং প্রযুক্তির সর্বজনীন ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্য

বাংলাদেশসহ উপকূলীয় ও জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য বেলেমে চলমান আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন কাঠামো তৈরি হচ্ছে কি না এবং বেসরকারি খাতকে অংশ নিতে উৎসাহিত করতে ঝুঁকি ভাগাভাগির কোন পদ্ধতি গড়ে উঠছে—এসব বিষয়ে নজর রাখা এখন দেশের জন্য খুবই জরুরি।

একইভাবে, টিএফএফএফ–এর শাসনব্যবস্থায় স্থানীয় সম্প্রদায় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষিত থাকছে কি না, তাও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ আন্তর্জাতিক বন–অর্থায়নে এসব অধিকার নিশ্চিত না হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

প্রযুক্তি–নির্ভর অভিযোজন প্রকল্পেও নজরদারি জরুরি—কারণ ঘোষিত অর্থ বাস্তবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষের কাছে কতটা পৌঁছাচ্ছে, তা নিশ্চিত করাই শেষ পর্যন্ত কার্যকারিতা নির্ধারণ করবে।

১৩ নভেম্বর পর্যন্ত আলোচনায় অংশ নেওয়া দেশগুলো এখনো চূড়ান্ত অর্থায়নের ঘোষণা ও বন–অর্থায়ন প্রস্তাবে ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। আগামী সপ্তাহে মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠক এবং সমঝোতার পর্বেই এসব সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে।

অন্যদিকে বেলেম শহরে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও নাগরিক আন্দোলনকারীরা নদীপথে বিক্ষোভ ফ্লোটিলা এবং মানববন্ধনের মাধ্যমে ‘বাস্তব পদক্ষেপ’-এর দাবি জানাচ্ছেন। তাদের বার্তা—ঘোষণা নয়, এখন প্রয়োজন কার্যকর ব্যবস্থা।

সব মিলিয়ে, কপ৩০–কে ঘিরে বেলেমে অর্থায়ন, অধিকার, প্রযুক্তি এবং টিকে থাকার লড়াই একসঙ্গে চলছে। এই চারটি উপাদান কতটা সমন্বিতভাবে এগিয়ে যায়, তা–ই শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করবে টেকসই ভবিষ্যতের পথ। আর এই পুরো প্রক্রিয়ার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে পৃথিবীর ফুসফুস—অ্যামাজন।

আল-আমীন দেওয়ান
, কপ৩০, বেলেম, ব্রাজিল থেকে

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ