Views Bangladesh Logo

সমাজে নারীর অবস্থান: বেগম রোকেয়ার উপলব্ধি এখনও একইভাবে প্রাসঙ্গিক

কিছুদিন আগে বাংলাদেশে বেশ বড় মাত্রার একটা ভূমিকম্প হলো৷ ভূমিকম্পের আতঙ্ক, ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে অনেক নিউজ হলো। ভূমিকম্পের সংবাদ নিয়ে পুরো ফেসবুক সয়লাব। ঠিক তখন একজন মজা করে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিল, স্ট্যাটাসের বক্তব্যটা কিছুটা এরকম ছিল, ভূমিকম্প হলেও নারীদের মাথায় প্রথম চিন্তা আসে তার ওড়না কই! এই স্ট্যাটাসটি অনেক ভাইরাল হয় এবং অনেকে মজা করে নিজেদের ফেসবুক ওয়ালে শেয়ারও করে। আমি তখন অনেকটা আগ্রহ নিয়ে তাদের কমেন্ট বক্সে ঢুঁ মারি। আর কমেন্ট দেখে আমার চোখ তখন কপালে ওঠার জোগাড়!

একজন কমেন্টে লিখেছে এসব বেলেল্লাপনা নারীদের জন্যই দেশে ভূমিকম্প হইসে! কেউ লিখেছে ইশ! ঘরে থাকিস বলে কী সভ্য জামাকাপড় পরবি না? আবার একজন লিখেছে, এসব অসভ্য মেয়ে মানুষ মরে গেলেই পারে!

এর থেকে অনেক বাজে কমেন্টও ছিল যা এখানে লেখা যাচ্ছে না। এখন অনেকেই ভাবতে পারেন এগুলো হয়তো শুধু পুরুষরাই লিখেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো শুধু পুরুষ নয় বরং তাদের সঙ্গে সমান তালে তাল মিলিয়ে নারীরাও এসব কমেন্ট করেছে। একবিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান নারীর মানসিকতা এমন!

এই যে নারীদের অপমানের যে চিত্র আমরা দেখছি, নারীর প্রতি সমাজের যে বিরূপ অবস্থান দেখছি, সেই জাল ছিড়ে এদেশের মুসলমান নারীদের বের করার তাগিদ কিন্তু বহু আগেই একজন মহীয়সী নারী অনুভব করেছিলেন। তিনিই অনুধাবন করেছিলেন যে নারীর প্রতি সমাজের এই নেতিবাচক ধারণার মর্মমূলে আঘাত হানতে হলে একমাত্র পথ, শিক্ষা। নারী যতক্ষণ না অজ্ঞতার জাল ছিড়ে বের হয়ে আসতে পারবে, ততক্ষণ তার মুক্তি নাই। আজ এই মহীয়সী নারীর জন্ম এবং মৃত্যুদিন।

বেগম রোকেয়াকে বলা হয় মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত। রাজা রামমোহন রায় আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কল্যাণে হিন্দু নারীরা রক্ষা পেলেও মুসলিম নারীরা ছিল সবচেয়ে পিছিয়ে। তাঁরা ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন আর পুরুষের তৈরি করা ধর্মগ্রন্থগুলোর হাতে বন্দি। ঠিক তখন নারী মুক্তির আলোকবর্তিতা হিসেবে হাজির হলেন বেগম রোকেয়া। তার নারীবাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল নারীকে সমাজে একজন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। বেগম রোকেয়া যখন উপমহাদেশে নারীদের নিয়ে কাজ করা শুরু করলেন ঠিক তার আগে (১৮৪৮-১৯২০) সুদূর ইউরোপ আমেরিকায় ভল্টারিন ডি ক্লেইর, মার্গারেট সাঙ্গার, লুসি স্টোন প্রমুখদের হাত ধরে নারীবাদের প্রথম তরঙ্গের সূত্রপাত হয়। তবে এই নারীবাদী ঢেউ বেগম রোকেয়াকে ঠিক কতটা প্রভাবিত করেছিল তা আমার জানা নেই। তবে বইপত্র পড়ে যতটুক বুঝেছি বেগম রোকেয়ার নারীবাদ পাশ্চাত্য নারীবাদী চিন্তা চেতনা থেকে ভিন্নই ছিল। আর বেগম রোকেয়া যে সমাজের নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তাদের সাথে পাশ্চাত্য নারী সমাজের ছিল বিশাল ফারাক। তাই পশ্চিমা নারীবাদী দর্শনকে পুঁজি করে কাজ করার সুযোগও ছিলনা।

বেগম রোকেয়া শুরু থেকেই নারী পুরুষের অসমতার ঘাঁটিগুলোতে আঘাত করেছেন। আর প্রথম আঘাত ছিল শিক্ষার দুর্গে। শিক্ষাক্ষেত্রে অসমতা তিনি নিজের ব্যক্তিজীবনে দেখেছেন। তখন শিক্ষায় ছিল পুরুষের একক কর্তৃত্ব। নারীশিক্ষা সম্পর্কে পুরুষের ধারণা ছিল তারা ঘরের কাজ অর্থাৎ রান্নাবান্না, স্বামীর সেবাযত্ম করবে। যার ধরূণ নারীরা ছিল পিছিয়ে। আবার ধর্মের নামে পর্দার কঠোর নীতি তো ছিলই। এইজন্যই রোকেয়া লিখেছিলেন,

‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করে। আর সেই সব গ্রন্থের দোহাই দিয়া নারীদের অন্তঃপুরে আবদ্ধ করিয়া রাখে তারা।’

আর এসব আদেশপত্র দিয়ে পুরুষরা এখনও নারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এ যুগে খোদ কিছু নারীও এসব আদেশপত্র সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে তোড়জোড় চালাচ্ছে।
নারীরা সমাজে বিদ্যমান রীতিনীতির বাইরে কিছু করতে গেলেই তাদের কীভাবে টেনে নামানো যায় তাই হয়ে গেছে এখনকার সমাজের মুখ্য কাজ। আর নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা বেগম রোকেয়াও সময়ে সময়ে হয়ে যান কিছু সংখ্যক পুরুষ এবং নারীদের আঘাতের বস্তু। বেশিূিন নয়, এই একবছর আগেই শামসুন নাহার হলের এক শিক্ষার্থী বেগম রোকেয়ার একটি গ্রাফিতির চোখ ও মুখ কালো রঙের স্প্রে দিয়ে ঢেকে দেয়। এই ঘটনা নিয়ে তখন ব্যাপক তোলপাড় হয়৷ যে মানুষ নারীশিক্ষা আর নারীমুক্তির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, যার জন্য বর্তমান অবলা নারীরা কিছুটা হলেও স্বাধীন হয়ে চলাফেরা করতে পারছে, অর্থনীতি, ব্যবসা, শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করছে তাঁর মুখই কিনা আরেক নারী কালো রঙে ঢেকে দিল! এমন ঘটনা হয়তো বঙ্গদেশেই শুধু সম্ভব। ভাগ্যিস বেগম রোকেয়া ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন। নয়তো তিনি নারীর প্রতি নারীর এহেন বিদ্বেষ দেখে এমনি লজ্জায় মারা যেতেন!

বেগম রোকেয়া তার জীবদ্দশায় পাঁচখানা বই লিখেছেন। যার সবগুলোতেই নারী ছিল মুখ্য বিষয়। এমনকি মৃত্যুর আগের রাতেও ‘নারীর অধিকার’ শীর্ষক একটি লেখা লিখেছিলেন। এই যে নারীর উন্নতি, মুক্তি, শিক্ষা নিয়ে এত এত কিছু করলেন কিন্তু নারী আসলে মুক্তি পেয়েছে? রোকেয়ার নারীবাদ কী সত্যিই সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? নারী কী এখনো পুরুষতন্ত্রের শিকলে বন্দি না? তার থেকেও বড় প্রশ্ন এখন, নারীই কী নারীর বড় শত্রু হয়ে উঠছে না? এসব প্রশ্নের উত্তর সবাই জানে। উত্তর জানলেও সমাধান নেই। সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী উন্নতির চরম শিকড়ে উঠে গেলেও মনে হয় এই প্রশ্নগুলো থাকবে। ফলে এই এত বছর পরেও সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে বেগম রোকেয়ার উপলব্ধি এখনও একইভাবে প্রাসঙ্গিক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ