হঠাৎ কেন নেপালে তরুণদের রক্তাক্ত বিক্ষোভ, রহস্য কী?
হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত নেপাল ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য সুপরিচিত হলেও রাষ্ট্র হিসেবে এর যাত্রাপথ মোটেও মসৃণ নয়। স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি নানা রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গেছে। কখনো রাজতন্ত্র, কখনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, আবার কখনো সামরিক প্রভাব- নানা ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে। ২০০৮ সালে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার পর নেপালবাসী এক নতুন ভবিষ্যতের আশায় বুক বেঁধেছিল। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, বহু বছরের অস্থিরতার পর এবার দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে, দুর্নীতি কমবে, উন্নয়ন হবে সমভাবে সবার জন্য, আর রাষ্ট্র পরিচালনায় আসবে স্বচ্ছতা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র-যুব বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে অন্তত উনিশজনের মৃত্যু প্রমাণ করেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এখনো নেপালের দৈনন্দিন বাস্তবতার অংশ। যে প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করতে অভ্যস্ত, সেই প্রজন্মকে সরকার যখন হঠাৎ করে মুখবন্ধ করে দিতে চাইল, তখন তা তরুণদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ৪ আগস্ট ২০২৫-এ নেপাল সরকার হঠাৎই ঘোষণা করে যে, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, এক্স (টুইটার) সহ ২৬টি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর ব্যবহার করা যাবে না। সরকারের যুক্তি ছিল, এগুলো নেপালে সরকারি নিবন্ধন ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে, আর জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন; কিন্তু সাধারণ মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, একে গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেছে।
ঘোষণার কয়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সোমবার সকালে হাজার হাজার ছাত্র-যুব রাজধানী কাঠমান্ডুতে সংসদ ভবনের সামনে জমায়েত হন। শুরুতে বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ, স্লোগান ও মিছিলে সীমাবদ্ধ; কিন্তু সংসদ ভবনের ব্যারিকেড অতিক্রমের চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী তারা কেবল আকাশে গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেন, পুলিশের গুলি ছিল সরাসরি বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে। ফলস্বরূপ মৃত্যু হয় অন্তত ১৯ জনের, আহত হয় আরও অনেক। এক বিক্ষোভকারীর বয়ানে উঠে আসে হৃদয়বিদারক দৃশ্য- তার বন্ধুকে চোখের সামনে মাথায় গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখা।
অনেকে বলছেন, এই আন্দোলনের সূত্রপাত যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা, কিন্তু এর গভীরে আছে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ ও হতাশা। নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। সরকারি প্রকল্পে স্বচ্ছতার অভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার, সম্পদের অপচয় এবং দলীয় স্বার্থসিদ্ধির প্রবণতা তরুণদের আস্থা হারাতে বাধ্য করেছে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে। বেকারত্ব, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, আর অভ্যন্তরীণ বাজারে সুযোগ-সুবিধার অভাব মানুষকে আরও ক্ষুব্ধ করেছে।
তরুণ প্রজন্মের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধুই বিনোদনের জায়গা নয়; বরং এটি হয়ে উঠেছে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্র, মত প্রকাশের মঞ্চ এবং গণতান্ত্রিক চর্চার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সরকার যখন এটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন তারা এটিকে মৌলিক অধিকারের হরণ হিসেবে গ্রহণ করে। অনেক তরুণ মনে করছে, এটি কেবল যোগাযোগ মাধ্যম নয়, বরং তাদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার এক রাজনৈতিক কৌশল। এর সঙ্গে যখন দুর্নীতি, বৈষম্য ও রাজনৈতিক অস্থিরতার হতাশা যুক্ত হলো, তখন আন্দোলন দ্রুত বিস্ফোরিত রূপ নিল।
নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন কিছু নয়। প্রায়ই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, দলীয় দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদি কোনো নীতি বাস্তবায়িত হয় না। এর ফলে তরুণ প্রজন্ম ক্রমশ রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা হারিয়েছে। তাদের কাছে মনে হচ্ছে, বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশের সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম। যে কারণে তারা নিজেরাই রাস্তায় নেমে অবস্থান জানাতে চাইছে।
বিক্ষোভ শুরুতে শান্তিপূর্ণ থাকলেও পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ আন্দোলনকে সহিংস রূপ দেয়। কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট এমনকি সরাসরি গুলি চালানো সরকারের ভাবমূর্তিকে আরও দুর্বল করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমন করতে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগ জনগণের কাছে সরকারের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে দুটি বড় ভুল চোখে পড়ে। প্রথমত, সরকার আন্দোলনের মূল কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেনি, বরং সেটিকে কেবল আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে দেখেছে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারি করে জনগণের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে, যা উল্টো ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
২০০৮ সালে রাজতন্ত্রের অবসান এবং প্রজাতন্ত্রের সূচনা ছিল নেপালের ইতিহাসে এক বড় মাইলফলক। নতুন সংবিধান, বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং নাগরিক স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি মানুষকে আশাবাদী করেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সরকারগুলো বারবার ভেঙে যাচ্ছে, সাংবিধানিক দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে গণতন্ত্রের যে মূল্যবোধগুলো রক্ষা করার কথা ছিল- স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনগণের অংশগ্রহণ- সেগুলো আজও কার্যকর হয়নি।
আজকের প্রজন্ম বুঝতে পারছে, নির্বাচিত সরকার জনগণের সেবায় নিয়োজিত নয়; বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যেকোনো পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করছে না। তাই তারা গণতন্ত্রের আসল রূপ ফিরিয়ে আনার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। তাদের আন্দোলনের কেন্দ্রে আছে দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান, সমঅধিকারের দাবি এবং মুক্ত মতপ্রকাশের অধিকার।
নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা কেবল অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং এর প্রভাব গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ওপর পড়তে পারে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নেপাল ভারতের সঙ্গে যেমন কৌশলগতভাবে যুক্ত, তেমনি চীনও দেশটিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নেপালে অস্থিরতা দুই প্রতিবেশী পরাশক্তির কৌশলগত প্রতিযোগিতাকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা ও পুলিশি দমন-পীড়নের মতো ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নেপালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ। বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে আসা রেমিট্যান্স নেপালের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভরসা; কিন্তু যদি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে সেই অর্থনৈতিক ভিত্তিও টলে যেতে পারে।
বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসার সামনে দুটি পথ খোলা। একদিকে আছে দমন-পীড়নের পথ, যেখানে সরকার আরও কঠোর অবস্থান নেবে, আন্দোলন দমন করতে শক্তি প্রয়োগ করবে। এতে সহিংসতা বাড়তে পারে, গণতন্ত্র দুর্বল হবে এবং দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা নেপালের ভবিষ্যতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলবে। অন্যদিকে আছে সংলাপ ও সংস্কারের পথ, যেখানে সরকার তরুণ সমাজের দাবি গুরুত্ব দিয়ে শুনবে, দুর্নীতি দমন করবে, স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে তুলবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার মাধ্যমে সরকার আবার আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে।
আজকের পরিস্থিতি প্রমাণ করছে, গণতন্ত্রের সারকথা শুধু নির্বাচন নয়। প্রকৃত গণতন্ত্র মানে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, শাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনা এবং নাগরিকদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়া। যখন সরকার এসব থেকে সরে যায়, তখন নাগরিকরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যারা ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে।
নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত, পুলিশের গুলিতে তরুণদের মৃত্যু এবং সরকারের জবাবদিহিতাহীন আচরণ সংকটকে আরও তীব্র করেছে। এখন দেখার বিষয় হলো, সরকার দমননীতির পথে এগোবে নাকি গণতান্ত্রিক সংলাপ ও সংস্কারের পথে হাঁটবে। যে ক্ষোভ এখন রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে, তা কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়; এটি দুর্নীতি, বৈষম্য এবং অকার্যকর শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের জমে থাকা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। যদি এই অসন্তোষ সঠিকভাবে সমাধান করা না হয়, তবে নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও গভীর হবে। আর যদি সংলাপ, সংস্কার ও জবাবদিহির পথে অগ্রসর হওয়া যায়, তবে নেপালের গণতন্ত্র আবারও নতুন করে প্রাণ পেতে পারে।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে