মাদক নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন দেরিতে কেন?
কক্সবাজার ও কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে মাদকের হটস্পট। মিয়ানমার থেকে প্রায় প্রতিদিনই ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথসহ (আইস) নানা প্রচলিত-অপ্রচলিত মাদক ঢুকছে কক্সবাজার দিয়ে। আর তা ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা দেশে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এমনিতেই বাংলাদেশের জন্য এক ভয়াবহ, তার সঙ্গে তাদের মাধ্যমে যে মাদক ঢুকছে তা আরেক বিষফোড়া হয়ে দেখা দিচ্ছে দিন দিন। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ঘিরে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের অবাধ বিস্তার শুধু স্থানীয় সমাজকেই বিপর্যস্ত করছে না বরং দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে।
দীর্ঘদিন ধরে এই মাদক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা হলেও কার্যকরী কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি এতদিন। আজ রোববার (১৭ আগস্ট) সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কক্সবাজার ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প মাদকমুক্ত করতে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ জন্য গত ২২ জুলাই ১৫ সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করেছে। টাস্কফোর্সের প্রধান করা হয়েছে কক্সবাজারের ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ মিনহাজুল আলমকে। গত বৃহস্পতিবার টাস্কফোর্সের প্রথম বৈঠক হয়। এত তিন মাসের মধ্যে মাদক নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান অগ্রগতি আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ; কিন্তু এর সঙ্গে এ কথাও বলতে হয়, মাদক নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠনে এত দেরি হলো কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য মতে, টেকনাফের ১১টি পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে দেশে ইয়াবা ঢুকছে। বাংলাদেশে ইয়াবা চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে বিবেচনা করেই মিয়ানমার সরকার আরাকানের বাংলাদেশ সীমান্তের পাশাপাশি ৩৭টি কারখানা স্থাপন করেছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৮৬ লাখের বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে। দেশের অসংখ্য তরুণ-যুবক আজ মাদকাসক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা উঠে উঠেছে। পারিবারিক অশান্তি ছাড়াও বহু অপরাধের মূল কারণ মাদক। মাদক চোরাচালানে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়। মাদকাসক্ত সন্তান মুহূর্তে তছনছ করে দিচ্ছে সাজানো-গোছানো পরিবার।
এই পরিস্থিতিতে কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো বাংলাদেশের জন্য এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। দিন দিন এই পরিস্থিতি আরও আতঙ্কজনক হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত এবং রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি। সীমান্ত কেন্দ্রিক একাধিক সূত্র বলছে, সশস্ত্র এ গোষ্ঠী তাদের অর্থের বড় জোগান পাচ্ছে ইয়াবা কারবার থেকে। জান্তা সরকারের কাছ থেকে রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর, সেখানকার ইয়াবা তৈরির কারখানা আরাকান আর্মির দখলে চলে যায়। রোহিঙ্গাদের অনেককে ব্যবহার করে পুরোনো ইয়াবা কারবার এগিয়ে নিচ্ছে তারা।
কক্সবাজারের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান এবং মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এখানে মাদক চোরাচালান রোধ করা চরমভাবে জটিল। সীমান্ত পাহারা, শরণার্থী ক্যাম্পে অস্থিরতা, দারিদ্র্য ও অরক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠী- সবকিছু মিলে মাদক সিন্ডিকেটের জন্য এটি উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে । এ বাস্তবতা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে সামলানো সম্ভব নয়। তাই সেনা, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে গঠিত কার্যকর টাস্কফোর্সই হতে পারে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত সমাধান।
বিগত দিনে কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ফল না পাওয়ার বিষয়টি টাস্কফোর্স এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করেছেন, অতীতের দুর্বলতা কোথায় ছিল সেদিকে নজর দিয়ে, দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সঠিক মিশন, ভিশন, পরিকল্পনা, স্ট্র্যাটেজি সেট করছেন। মাদক নিয়ে সাধারণ মানুষ ও সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, সহস্রব, যোগাযোগ প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা রেখেই এগিয়ে যাবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। স্থানীয়দের বড় অংশের দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে মাদকের অব্যাহত খড়ক থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না বলে তারা মনে করেন। বহু শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন এর সঙ্গে কমবেশি জড়িয়ে গেছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় রাজনীতিকদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। অনেক নেতা ও তাদের স্বজন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ইয়াবা কারবারে জড়িত।
আবার সীমান্ত এলাকায় বিকল্প দূরে থাক, কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। তাই টাস্কফোর্সের কার্যক্রম যেন কেবল অভিযান ও গ্রেপ্তারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। এর পাশাপাশি কয়েকটি বিষয় সমান গুরুত্ব পাওয়া দরকার: রোহিঙ্গা শিবিরে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা, স্থানীয় তরুণদের বিকল্প জীবিকা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ, সীমান্তে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি (ড্রোন, সিসিটিভি, স্ক্যানার) বৃদ্ধি, মাদক কারবারের পেছনের মূল অর্থায়নকারীদের আইনের আওতায় আনা। তবে, এ-কথাও স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, যতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থাকবে ততদিন এই বিপদ ঘাড়ের ওপর থাকবেই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে