বন্দর টার্মিনাল পরিচালনা কেন বিদেশিদের হাতে
কথা ছিল সংস্কার হবে। যে সংস্কারে দেশ, দেশের মানুষ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ ইত্যাদি গুরুত্ব পাবে। যে সংস্কারে ভবিষ্যতে কোনো স্বৈরশাসক জন্ম নেবার সুযোগ পাবে না। ক্ষমতায় ভারসাম্য আসবে। পুলিশ মানবিক হবে। আইন-বিচার-প্রশাসন জনবান্ধব হবে। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে।
কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারের আলাপ অনেকটাই জটিল হয়ে গেছে। সংস্কার বলতে কেবল জুলাই সনদের আলোচনা গুরুত্ব পাচ্ছে। এদিকে বাতাসে কেবল গুজব আর গুজব। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় রহস্যময় আগুন দাউ দাউ করে জ্বলেছে। বাতাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। এদিকে সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার ঠিকাদারে পরিণত হয়েছে বলে জোর উঠেছে। এর আগে ট্রাম্প প্রশাসনের পালটা শুল্ক সুবিধা কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ গোপন চুক্তি (নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট) করে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পরও এই চুক্তির বিন্দু-বিসর্গ সরকার প্রকাশ করেনি। এখন বন্দর নিয়ে নানা রকম কানাঘুষা চলছে। কিন্তু কেন? একটি নির্দলীয় সরকারের কিসের স্বার্থ? কার ভয়? কেন লুকোছাপা করে দীর্ঘমেয়াদি নানান চুক্তিতে যাচ্ছে?
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মেরুদণ্ড হলো তার বন্দরগুলো। বিশেষত চট্টগ্রাম ও ঢাকার বন্দর টার্মিনালগুলো দেশের জন্য শুধু পণ্যপথ নয়, কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দরজা। তাই এসব বন্দরের কার্যক্রম ও পরিচালনার স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। সম্প্রতি বন্দর টার্মিনাল পরিচালনার জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তাতে সচেতনমহলে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
একটি দেশের জাতীয় সম্পদ বলতে আমরা সাধারণত ভাবি খনিজসম্পদ, বনাঞ্চল বা জলসম্পদ। কিন্তু আধুনিক যুগে আর্থিক ও ভৌগোলিক পরিপ্রেক্ষিতে বন্দরগুলোও একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ। বাংলাদেশের মতো একটি অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত উন্নয়নশীল এবং সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের দেশ যখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দ্বার খুলে দেয়, তখন বন্দরগুলো কেবল পণ্য ওঠানামার স্থান নয়, এটি দেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের দৃষ্টান্ত।
উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই বন্দরের সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ পরিচালনা না থাকলে কল্পনাও করা যায় না দেশের অর্থনীতির কেমন দিক পরিবর্তন হবে। আর এসব বন্দরের দখল বা পরিচালনা যদি কোনো অপরিচিত বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দীর্ঘমেয়াদি সময়ের জন্য চলে যায়, তাহলে আমাদের স্বার্থ রক্ষা কীভাবে হবে?
সরকারের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে যে, আগামী ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে বাংলাদেশের সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর টার্মিনাল- যেমন পতেঙ্গা, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ইত্যাদির পরিচালনা ৩০ বছরের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেয়া হবে; কিন্তু এই সিদ্ধান্তে রয়েছে এক প্রবল গোপনীয়তা। চুক্তির খসড়া বা শর্তাবলি একেবারেই জনসম্মুখে আসেনি।
এটি নিয়ে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, তা যথার্থ। কারণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি হলো গণতান্ত্রিক শাসনের মৌলিক স্তম্ভ। আমাদের দেশে যখন হাজার হাজার বন্দর শ্রমিক-কর্মচারী তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন, তখন তাদের চাকরি নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট না করে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া একদমই যৌক্তিক নয়। এই চুক্তিতে কি তাদের অধিকার রক্ষা করা হয়েছে? কি ধরনের শর্তাবলি রয়েছে? এগুলো প্রকাশিত না হলে জনগণের বিশ্বাস অর্জন করা অসম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতের খ্যাতনামা বন্দরগুলোর ক্ষেত্রে সরকার ও বন্দর কর্তৃপক্ষ যে নিয়মিত গণমাধ্যম ও জনসাধারণের জন্য তথ্য প্রকাশ করে, সেখানে যে গোপনীয়তা ও অস্বচ্ছতা নেই, তাই সে দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা নিয়ে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও সহযোগিতা অনেক বেশি।
একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে ৩০ বছরের মতো দীর্ঘমেয়াদি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কতটা নৈতিক বা সাংবিধানিক, তা প্রশ্নাতীত। এই ধরনের সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
আমাদের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও চুক্তি নির্বাচিত সরকারের অধীনে আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের পোর্টস অথরিটি বা জাপানের বন্দরের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনা চুক্তি নেয়া হলেও সেখানে জনগণের অংশগ্রহণ ও জবাবদিহির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশের বন্দরগুলো কেবল অর্থনৈতিক অবকাঠামো নয়, এগুলো জাতির পরিচয়। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে এই সম্পদ তুলে দেয়া হলে দেশীয় নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তায় ভয়ংকর ধাক্কা আসতে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের বিষয়গুলো ভূ-রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠে। যেমন, ভেনেজুয়েলার তেলক্ষেত্র বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার কারণে সে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছিল।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে না, তা হবে জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর এক গুরুতর আঘাত। কিছু দিন আগে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, বন্দর, সেন্টমার্টিন কিংবা করিডোর দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক, যা নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া উচিত; কিন্তু যখন বন্দরগুলোর ব্যবস্থাপনার ভার বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তর করা হচ্ছে, তখন জনমনে তৈরি হচ্ছে ভয়- ‘সেন্টমার্টিন’ বা ‘করিডোর’ ও কী একই পথে যাবে?
বন্দরগুলোতে যারা প্রতিদিন কাজ করেন, তাদের অধিকারের প্রশ্ন প্রায় অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিতে যদি শ্রমিক-কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত না করা হয়, তাহলে একটি দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রায় কতটা প্রভাব পড়বে, তা সহজেই বোঝা যায়। এই চুক্তি সম্পাদনের সময় জনসাধারণের অবগতির অভাবে দেশের শ্রমিক সমাজের উদ্বেগ ও অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের উন্নত দেশে বন্দরের ব্যবস্থাপনায় যারা কাজ করেন, তাদের অধিকারের সুরক্ষা ও বেতন-ভাতা নিয়ন্ত্রণ কঠোর বিধিনিষেধে থাকে। সেখানে স্বচ্ছতা ও শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশেও একই মান বজায় রাখা উচিত।
দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্বচ্ছতা অপরিহার্য। বন্দর টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়ে সরকারের গোপনীয়তার কারণে জনমনে অসন্তোষ ও সন্দেহ বেড়েই চলছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জনগণ সচেতন থাকে, সেখানে এই ধরনের গোপনীয়তা জাতির জন্য ক্ষতিকর।
আমাদের গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের এখনই এগিয়ে আসা উচিত- এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশ নিয়ে সরকারের ওপর গঠনমূলক চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে চুক্তির খসড়া জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় এবং জনগণের মতামত নেওয়া যায়। এতে শুধু স্বচ্ছতাই নয়, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষাও নিশ্চিত হবে।
একটি রাষ্ট্র যখন তার কৌশলগত অবকাঠামো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়, তখন সেটি কেবল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত থাকে না- তা হয়ে ওঠে ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষায় চাপ প্রয়োগ করে, যার প্রভাব পড়ে আমাদের নীতি, সিদ্ধান্ত এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার ওপর।
বিশ্বের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে, বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র বা টেলিযোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিদেশি নিয়ন্ত্রণ বাড়লে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ঝুঁকিতে পড়ে। বাংলাদেশেও যদি সেই প্রবণতা দেখা দেয়, তা হবে একদিকে অনির্বাচিত সরকারের দায়িত্বহীনতা, অন্যদিকে দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের প্রতি স্পষ্ট অবহেলা।
সরকারের উচিত অবিলম্বে চুক্তির খসড়া প্রকাশ করা, শ্রমিকদের চাকরি ও অধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া, এবং বন্দর পরিচালনার নীতিমালা স্পষ্টভাবে জানানো। জাতীয় সম্পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত পরিচালনায় জনগণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই গণতান্ত্রিক ও টেকসই পথ।
বাংলাদেশের বন্দরগুলো শুধু অর্থনৈতিক অবকাঠামো নয়- এগুলো আমাদের জাতীয় গর্ব, সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এই সম্পদের নিয়ন্ত্রণ স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক না হলে, দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি চুক্তি আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় আঘাত হানবে এবং জনগণের আস্থা ভঙ্গ করবে।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে