গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন কেন?
বাংলাদেশে এখন গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতি-উদযাপন পর্ব চলছে। নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে গত বছরের অভূতপূর্ব অগ্নিঝরা সময়ের; কিন্তু দুঃখের সঙ্গে এ-কথাও বলতে হয়, যতটা উজ্জ্বলতার সঙ্গে এই গণ-অভ্যুত্থানকে স্মরণ করা দরকার ছিল ততটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। এর কারণ মানুষের মনে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা। এই নিরাপত্তাহীনতা কেবল দৈনন্দিন জীবনের চলাফেরা নিয়ে নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। একদিকে আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে জনজীবনের নিরাপত্তা, অন্যদিকে অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও ভবিষ্যতের নিরাপত্তাহীনাতায় ভুগছেন দেশের নাগরিকরা।
বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়গুলোর একটি হয়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। দেশের নানা প্রান্তে মব লিঞ্চিং, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, শিশু নির্যাতন, রাজনৈতিক সহিংসতা ও গুম-খুনের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধীদের দাপট এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। সাম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা জাতীয়ভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। খোদ রাজধানীতে দিনে-দুপুরে মানুষ খুন হচ্ছে, ছিনতাইয়ে প্রাণ যাচ্ছে, নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আবার কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে হয়রানি, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাবের অভিযোগ উঠেছে।
এর মধ্যে দেশে বেশ কয়েকটি মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। মব সহিংসতার ঘটনা গত এক বছরে এত বেড়েছে যা মানুষকে খুব আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। এ অবস্থার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরাধ দমনে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার অভাব। বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি বহাল- সেটাই এখনো চলছে। আইনের শাসনের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া এবং সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয়ও দেশের মানুষকে এক প্রকার নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিচারব্যবস্থা যদি দুর্বল হয়, আইনের প্রয়োগ যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয় তবে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে- যা বর্তমানে ঘটছে। এছাড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দমন-পীড়নের সংস্কৃতি ও বিরোধী মত দমনেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে সাধারণ অপরাধ দমন থেকে দৃষ্টি সরে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন নিশ্চিত করা। অপরাধী যে-ই হোক, রাজনৈতিক পরিচয় না দেখে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। সর্বোপরি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এ সংকট কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব। রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে, নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় জনআস্থা হারিয়ে আইনের প্রতি অবিশ্বাস এবং শেষপর্যন্ত সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি হবে। যার খেসারত দিতে হবে সবাইকে।
গণ-অভ্যুত্থানের পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেন নিয়ন্ত্রণ করা গেল না তা অত্যন্ত হতাশাজনক। অন্তর্বর্তী সরকার প্রায়ই বলে থাকে, এর কারণ গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশ সহযোগিতা করেনি; কিন্তু এখনো যদি পুলিশকে তার দায়িত্বে ফিরিয়ে না আনা যায় তার ব্যর্থতার দায়ভার অন্তর্বর্তী সরকারকেই নিতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে