Views Bangladesh Logo

নেপালের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে কেন বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে?

Mohshin  Habib

মহসীন হাবিব

হিমালয়ের পাদদেশের দেশ নেপাল। আয়তনে বাংলাদেশের সমান, লোকসংখ্যা তিন কোটির কিছু বেশি। ছোট দেশ বলা হলেও একে ছোট দেশ বলা যায় না। তবুও ছোট দেশ বলা হয় অর্থনীতির আকারের কারণে। মূলত কৃষি, রেমিট্যান্স এবং পর্যটননির্ভর অর্থনীতি। তবে নেপালের ভূরাজনৈতিক অবস্থান একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভীষণ স্পর্শকাতর। নেপালের দুই পাশে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ ও বড় সামরিক শক্তির দেশ চীন এবং ভারত। নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা বরাবরই অম্ল-মধুর। নেপালে বিভিন্ন সময় ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কেও পরিবর্তন এসেছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গেও নেপালের সম্পর্কও ওঠানামা করেছে।

রাজনৈতিকভাবে দীর্ঘদিন ধরেই নেপালে একটি ভোলাটাইল অবস্থা বিরাজ করছিল। বিশেষ করে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্রের অবসানের পর ১৩ বার সরকার পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু ৮-৯ তারিখের জেন-জি প্রজন্মের হঠাৎ ভয়াবহ সহিংসতা, জ্বালাও পোড়াও, অতঃপর সরকার পতন, প্রধানমন্ত্রীর পালিয়ে যাওয়া ৭ দিন আগেও ছিল অপ্রত্যাশিত।

এই অপ্যত্যাশিত ঘটনার অনেক কিছুই হিসাবে মিলছে না, বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষকও মেলাতে পারছেন না। মাত্র ১০ দিন আগে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি যোগ দিয়েছিলেন চীনে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের মিটিংয়ে। সেখানে কে পি শর্মার সঙ্গে পৃথকভাবে একান্তে আলোচনায় বসেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং। এত নেতার ভিড়ে নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়ে দুই পরাশক্তির প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ অনেকের কাছেই কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। তাহলে কি তারা দুজনই কে পি শর্মাকে কোনো মেসেজ দিয়েছিলেন, যা তিনি আন্দাজ করতে পারেননি? তিনি সেই মেসেজ অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই সবকিছু হাতছাড়া হয়ে গেল? এখনই বলা মুশকিল।

দেশ-বিদেশে, এমনকি আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থী তথা জেন-জি আন্দোলন ও শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। বারবার উঠে আসছে বাংলাদেশের নাম, সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা চলছে। বহু সাদৃশ্য আছে দুই আন্দোলন এবং সরকার পতনে, কথা সত্য। দুটোই ছিল অল্প সময়ের আন্দোলন এবং তরুণ প্রজন্মোর নেতৃত্বে। বাংলাদেশে আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল কোটাবিরোধী প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। প্রাথমিকভাবে আন্দোলনকারীরা কেউ ঘুণাক্ষরেও সরকার পদত্যাগের কথা চিন্তা করেনি এবং উচ্চারণ করেনি। ঘটনাক্রমে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি, মৃত্যু এবং সরকারের শক্ত অবস্থান তাদের দাবিকে এক দফায় পরিণত করে এবং শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান।

ঠিক নেপালেও আরো সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থী এবং তরুণ সমাজ। আন্দোলনের এক পর্যায়ে দ্রুত যোগ হয় দুর্নীতি প্রসঙ্গ। অতঃপর প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে হামলা, পার্লামেন্ট তছনছ ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, নেপাল সরকার ফেসবুকসহ কয়েকটি সাইট বন্ধ করেছিল রাজনৈতিক মতকে চেপে ধরার জন্য নয়। সেখানে টিকটকসহ আরও কয়েকটি অ্যাপস চালু ছিল এবং আছে। নেপাল সরকার ফেসবুকসহ বেশ কয়েকটি সোশ্যাল মিডিয়া রাজস্ব না দেওয়ায় বন্ধ করেছিল; কিন্তু আন্দোলনকারীরা সে কথা শুনতে বা বুঝতে চায়নি।

বাংলাদেশে যেমন সেনাবাহিনী ও পুলিশ শেষ দিনগুলোতে হাত গুটিয়ে ফেলেছিল, নেপালেও তাই ঘটেছে। নেপালের পুলিশ ও সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর কঠোর হওয়া থেকে বিরত ছিল। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমদিকে নেপালের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে। কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহার করেনি। কিন্তু সেই সময় ১৯ জন নেপালির কী করে মৃত্যু হলো তা এখনো রহস্যে আবৃত।

নেপালের ব্যাপারে আরও কিছু ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। কে পি শর্মা পালিয়ে কোথায় গেলেন? প্রথমে সংবাদ প্রকাশ পায় তিনি দুবাই চলে যাচ্ছেন। কিন্তু দুবাই যেতে তাকে কোনো ফ্লাইট ধরতে হবে যা দেখা যায়নি। আরেকটি সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে যে তিনি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে লুকিয়ে আছেন। সেটাও স্পষ্ট নয়। তবে তার হয় ভারত অথবা চিনে চলেও যাওয়াই হতো দস্তুর এবং সম্ভাব্য গন্তব্য; কিন্তু ভারতের কাছে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় চাননি বলে জানা গেছে। জানা যাবে হয়তো আরো কিছুদিন পর।

কোনো কোনো মহল নেপালের এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের ব্যাপারে ডিপ স্টেটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। ভারতের অনেক গণমাধ্যম, এমনকি দায়িত্বশীল গণমাধ্যমও বলছে, ভারতের চারপাশে ডিপ স্টেট ভারতবিরোধী শক্তির উত্থান ঘটাচ্ছে ভারতকে দুর্বল করার লক্ষ্যে। ট্যারিফ প্রশ্নে এবং রাশিয়া থেকে স্বল্পমূল্যে জ্বালানি ক্রয়ের অভিযোগে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শীতল হয়ে উঠেছে। ভারত ‘কোয়াড এবং ব্রিকস কোন পথে যাই’ এমন একটি দোটানায় পড়েছে। তাহলে কী কোনো বাইরের শক্তির ভারতকে চাপে ফেলানোর কৌশলের অংশ? এসব প্রশ্ন ভারতীয়দের।

সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের চেয়ারম্যান। পশ্চিমাদের কাছে কমিউনিস্ট পার্টি মানেই শত্রু, এক্ষেত্রে তাদের কোনো আপস নেই। সুতরাং আন্দোলনের সুযোগ যদি পশ্চিমা ডিপ স্টেট নিয়ে থাকে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এই পটপরিবর্তনের ফলে নেপালের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতের নেপাল কারা শাসন করবে, শাসনব্যবস্থা কী হবে তা একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ঠিক বাংলাদেশে যেমন অনিশ্চয়তা চলমান।

মহসীন হাবিব: সাংবাদিক, আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ