রাজনীতিতে শিষ্টাচারবহির্ভূত স্লোগান কেন?
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য রাজনৈতিক স্লোগানে দু-একটা অপ্রীতিকর শব্দ ব্যবহার হয় সবসময়ই। যেমন, ‘অমুকের গালে গালে জুতা মারো তালে তালে’। বেশ পরিচিত স্লোগান; কিন্তু এখন, বাংলাদেশে এমন কিছু অশ্লীল রাজনৈতিক স্লোগান শুরু হয়েছে যা খুবই অরুচিকর-অশ্লীল। ভদ্রলোকরা সেগুলো শুনে কানে আঙুল দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক অনেক ওটিটি-ফিল্মে দেখা যায় গালাগালির সময় ‘টুট টুট’ একটা শব্দ দিয়ে অশ্লীল শব্দগুলো মিউট করে দেয়া হয়। ‘টুট টুট’ শব্দ শুনলেই দর্শক বুঝতে পারছেন অশ্লীল গালাগালি হচ্ছে। সম্প্রতি টেলিভিশনের খবরেও দেখা গেল রাজনৈতিক স্লোগানের জায়গায় ‘টুট টুট’ ব্যবহার করতে। এমন কিছু অশ্লীল স্লোগান এখন ব্যবহার হচ্ছে যা শোনাও যায় না, লেখাও যায় না।
স্লোগানে গালির প্রথম উপস্থিতি দেখা যায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে। সারা পৃথিবীর জেন-জিরা নিজেদের প্রকাশভঙ্গির প্রক্রিয়ায় মাঝেমধ্যে গালি ব্যবহার করে। আগের জেনারেশনের জন্য বিষয়টি অবশ্যই অস্বস্তিকর। তবে অন্য সৃজনশীল স্লোগানের পাশাপাশি প্রকাশভঙ্গিতে খানিকটা গালির ব্যবহার বাড়তি ক্রোধ প্রকাশে সহায়ক হয়। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘন ঘন এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি আর লুকিয়ে রাখা মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে নেই; বরং তা অস্বস্তিকর থেকে বিরক্তিকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
স্লোগান সময়কে তুলে ধরে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে কালজয়ী নানান স্লোগানের জন্ম হয়েছে। গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে এমন সব স্লোগানের জন্ম হয় যা ছাত্র-জনতাকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে রাজপথে নেমে আসতে। এসব স্লোগানের মধ্যে ছিল- ‘লাখো শহীদের দামে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’, ‘কে এসেছে কে এসেছে, পুলিশ এসেছে, কী করছে কী করছে, স্বৈরাচারের পা চাটছে’, ‘এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়’, ‘এক দফা এক দাবি, স্বৈরাচার তুই কবে যাবি’, ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’- এই স্লোগানগুলোর জন্ম হয়েছে এ আন্দোলন থেকেই।
কিন্তু সাম্প্রতিক এই অশ্লীল স্লোগানের কারণে আমাদের গর্বের ইতিহাস সব ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতি যখন অশ্লীল স্লোগাননির্ভর হয়ে পড়ে তখন সেখানে আদর্শের স্থান দখল করে বিদ্বেষ-যুক্তির জায়গা নেয় গালিগালাজ। সতর্ক করে তারা বলেছেন, এমন স্লোগান সামাজিক অনিয়ম ও সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এসব অশ্লীল স্লোগানের বেশিরভাগই শুরু হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে। তাতেও অভিভাবকসহ দেশের সুশীল নাগরিকরা হতাশ- দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছেলেমেয়েরা যদি এরকম অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করেন তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এসব স্লোগান দেখে শিশু-কিশোররাও প্রভাবিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কর্মকর্তারাও উদ্বিগ্ন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্লোগানের বিষয়টি রাজনৈতিক দলের নীতিগত সিদ্ধান্তের মধ্যে পড়ে। রাজনৈতিক অঙ্গনে অশ্লীল বা অশোভন স্লোগানের বিষয়টি আসলে রাজনীতির সংঘাতময় সংস্কৃতিরই অংশ। রাজনৈতিক সহিংসতার প্রভাব ভাষার ওপর পড়ে। অশ্লীল স্লোগান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও তা বন্ধের জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতে অশ্লীল স্লোগান বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোসহ সরকারের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নেয়া জরুরি। শিষ্টাচার পারিবারিক সৌজন্যকেও প্রকাশ করে। কোনো ক্ষোভ ও জোশের বশে মুখ দিয়ে একটা বাজে কথা বেরিয়ে গেলে, বিশেষ করে তা জনসম্মুখে এবং ক্যামেরার সামনে প্রকাশ হয়ে গেলে তা নিজেরই মানসম্মান খোয়া যায় এটা বুঝতে হবে। অশ্লীল গালাগালির মধ্যে গৌরব নেই, লজ্জা আছে- এই লজ্জাবোধ যেন সবার মধ্যে কাজ করে সেটাই আমাদের কাম্য।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে