Views Bangladesh Logo

কেন শান্তির খোঁজে এখনো সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে গাজা

০ অক্টোবর গাজায় আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এটাকেই দ্রুত ‘শান্তি পরিকল্পনা’ বলে খবর প্রকাশ করতে শুরু করে। তারা জানায়, এই চুক্তির তদারকির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কায়রো যাবেন। পরে ইসরায়েল গিয়ে নেসেটে (ইসরায়েলি সংসদে) বক্তব্য দেবেন। সংবাদমাধ্যমগুলো আরও জানায়, গাজার ওপর বিমান হামলা বন্ধ হয়েছে।

বোমা হামলা সত্যিই বন্ধ হয়েছে; কিন্তু আমাদের ভোগান্তি এখনো চলছে। আমাদের দুর্ভোগ এখনো শেষ হয়নি। আমরা এখনো অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছি। ইসরায়েল এখনো আমাদের আকাশপথ, স্থলপথ ও সমুদ্রপথ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে। এখনো অসুস্থ ও আহত ফিলিস্তিনিদের বাইরে যাওয়া আটকে দিচ্ছে। সাংবাদিক, যুদ্ধাপরাধ তদন্তকারী ও মানবাধিকারকর্মীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। তারা এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে কোন খাবার, কোন ওষুধ এবং কোন জরুরি পণ্য গাজায় ঢুকতে পারবে কি পারবে না।

১৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই অবরোধ চলছে আমাদের ওপর। যা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তিন বছর বয়স থেকে আমি অবরোধের মধ্যে বড় হয়েছি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অধিবাসীদের নিশ্চয়ই তা করতে হয় না। তাহলে এ কেমন শান্তি যা আমাদের সেই মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করছে?
যুদ্ধবিরতি ও তথাকথিত ‘শান্তি পরিকল্পনা’র খবর একটি আরও গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ওপর ছায়া ফেলে দিয়েছে। ইসরায়েল আন্তর্জাতিক জলসীমায় আরেকটি ত্রাণবাহী নৌবহরে হামলা চালিয়ে। ১৪৫ জনকে অপহরণ করেছে। যা আন্তর্জাতিক আইনে একটি বড় অপরাধ। এর মাত্র কয়েকদিন আগে, ইসরায়েল ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’তে হামলা চালিয়ে গাজার দিকে যাত্রা করা ৪৫০ জনেরও বেশি মানুষকে আটক করেছিল।

এই নৌবহরগুলো শুধু মানবিক সহায়তাই বহন করছিল না, এগুলো ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বাধীনতার আশাও বহন করছিল। এগুলো বহন করছিল প্রকৃত শান্তির স্বপ্ন- এক এমন শান্তি, যেখানে ফিলিস্তিনিরা আর অবরুদ্ধ, দখলকৃত ও গৃহহীন থাকবে না।

অনেকে এই স্বাধীন নৌবহরগুলোকে সমালোচনা করছেন। বলছেন যে, এতে কোনো কাজ হবে না। এগুলো সবসময়ই আটকে দেয়া হয়। যতবার তারা যাত্রা করবে ততবারই আটকে দেয়া হবে। তাই আমিও শুরুতে এই মানবাধিকার কর্মীদের আন্দোলনের দিকে ততটা মনোযোগ দেইনি। আমি খুবই হতাশ ছিলাম সব কিছু নিয়ে। এমন কি এই যুদ্ধের শেষ দেখার আশাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম।

কিন্তু সবকিছু বদলে গেল যখন ব্রাজিলের সাংবাদিক জিওভান্না ভিয়াল আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। গাজামুখী সুমুদ ফ্লোটিলায় যাত্রা করার আগে তিনি আমার গল্প নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখেন। এরপর তিনি সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট দেন, ‘আমরা যাত্রা করছি সারার জন্য।’

তার এই কথা আর সাহস আমার মনে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। এরপর থেকে আমি ফ্লোটিলা সম্পর্কিত সব খবরে চোখ রাখতাম, তাদের প্রতি মুহূর্তের পদক্ষেপের দিকে আশাবাদ নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। আমার আত্মীয়স্বজনকে বলতাম, বন্ধুদের সঙ্গে তাদের কথা শেয়ার করতাম। যারাই শুনতে চাইত তাদের বলতাম, এই আন্দোলন কতটা অসাধারণ। আমি সবসময়ই ভাবতাম, অবিচারে ভরা এই পৃথিবীতে এখনো কিছু মানুষ আছেন যারা তাদের জীবন, সবকিছু ছেড়ে এমন মানুষদের জন্য ঝুঁকি নিতে রাজি, যাদের তারা কখনো দেখেননি। যে জায়গায় তারা কখনো যাননি, জীবন বাজি রেখে তারা সেখানেও যেতে পারেন।

আমি জিওভান্নার সঙ্গে সবসময়ই যোগাযোগ রাখছিলাম। গাজার পথে যাত্রার সময় তিনি আমাকে লিখেছিলেন: ‘আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব।’

এই অন্ধকার সময়ের মধ্যেও তিনি যেন আলোর এক রশ্মি হয়ে উঠেছিলেন। গত দুই বছরের মধ্যে এই প্রথমবার আমি অনুভব করলাম- আমাদের কথা কেউ শুনছে। কেউ আমাদের দেখছে। গাজার পক্ষে বিশ্বের যারা লড়ছেন, সুমুদ ফ্লোটিলা ছিল এই আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অভিযান। এটি কেবল নৌকার সংখ্যা, যাত্রীদের সংখ্যা বা ত্রাণসামগ্রীর পরিমাণের দিক দিয়ে বিচার করা যাবে না। গাজাকে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরার এক বিশাল, মহৎ প্রচেষ্টা এটি। যেন বিশ্ব আর আমাদের ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে না পারে তারই জন্য ছিল এই নৌবহরের যাত্রা।

ফ্লোটিলার অফিসিয়াল ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে একটি পোস্টে লেখা ছিল: ‘সব চোখ গাজার দিকে।’ এই কথাটি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। এক বিভীষিকাময় রাতে, যখন গাজা শহরের আকাশে বোমার বিকট শব্দ থামছিলই না, তখনই আমি এটি পড়েছিলাম। ইসরায়েলের নিষ্ঠুর হামলা থেকে বাঁচার জন্য ওই রাতের পরই আমাকে আমার ঘর ছেড়ে পালাতে হয়েছিল।

ইসরায়েল ফ্লোটিলা আটকে দিয়েছে। এই নৌযাত্রীদের গালিগালাজ করেছে। মানবাধিকারকর্মীদের আটক করে জোরপূর্বক দেশে ফিরিয়ে দিয়েছে। ত্রাণসামগ্রী জব্দ করেছে। ইসরায়েলি বাহিনী হয়তো এই নৌকাগুলোকে আমাদের তীরে পৌঁছাতে দেয়নি; কিন্তু এই নৌকাগুলো যে বার্তা বহন করছিল তা তো ঠিকই আমাদের কাছে পৌঁছেছে। শান্তির বার্তা তারা ব্যর্থ করতে পারেনি। স্বাধীনতার ডাক ঠিকই পৌঁছে গেছে আমাদের কানে। এ এমন এক বার্তা, যার জন্য আমরা দুবছর ধরে অপেক্ষা করছিলাম। নৌকাগুলো থামিয়ে দেয়া হয়েছে; কিন্তু তাদের মানবিকতার বাণী ঠিকই আমাদের কাছে পৌঁছেছে।

এই নৌবহরে যারা ছিলেন তাদের সবার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ । প্রতিটি মানুষকে শ্রদ্ধা। তাদের সবার সঙ্গে যদি আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে পারতাম! যদি প্রত্যেককে আলাদা করে বলতে পারতাম, তাদের সাহস, তাদের উপস্থিতি, তাদের সংহতি প্রকাশ- কী গভীর অর্থ বহন করে নিয়ে এসেছে আমার জন্য। আমরা তাদের কোনোদিন ভুলব না। তাদের নাম, মুখ আর কণ্ঠ চিরকাল আমাদের হৃদয়ে গাঁথা থাকবে। যারা আমাদের দিকে যাত্রা করেছিল তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই: মনের অতল থেকে আপনাদের ধন্যবাদ। হৃদয়ের গভীর থেকে আপনাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা। আপনারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন- আমরা একা নই।

আর বিশ্ববাসীকেও জানাই, আমরা এখনো আশায় বুক বেঁধে আছি। আমরা এখনো আরেকটি নৌবহর আসার অপেক্ষায় আছি। তোমরা আমাদের কাছে এসো। এসে আমাদের মুক্ত করো এই কারাগার থেকে।
বোমাবর্ষণ এখন বন্ধ হয়েছে; কিন্তু আবার কবে শুরু হবে কে জানে! আশা করতে পারি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এটি আবার শুরু হবে না। আমাদের এখনো শান্তি নেই।

বিশ্বের সরকারগুলো আমাদের আশাহত করেছে; কিন্তু মানুষ আশাহীন করেনি। আমি জানি, স্বাধীন নৌবহর একদিন গাজার তীরে পৌঁছাবে। আর আমরা মুক্ত হব।

উপরের নিবন্ধটি গাজায় বসবাসকারী ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী সারা আওয়াদ লিখেছেন।

সূত্র: আল-জাজিরা

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ