দেশের রাজনীতিবিদরা কেন গণমানুষের সংস্কৃতির স্তর উন্নত করতে চায় না?
এটা সবাই বলবেন যে, সংস্কৃতির মান উঠছে না বটে, তবে নামছে কিন্তু ঠিকই। ওদিকে আবার সংস্কৃতির কথা যে বলা হয় না তা নয়, তবে তেমন গুরুত্ব দিয়ে বলা হয় না যেভাবে বলা দরকার। আসলে সংস্কৃতি কিন্তু সভ্যতার চেয়েও বড় এবং গভীর। সংস্কৃতি বড় তার বিস্তৃতির দিক থেকে। কারণ সংস্কৃতির ভেতর অনেক কিছু, প্রায় সবকিছুই থাকে। অর্থনীতিই থাকে ভিত্তিতে; কিন্তু ভূগোল, মানবিক সম্পর্ক, প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ, শিক্ষা, খাদ্যাভ্যাস, শিল্প-সাহিত্য কোনো কিছুই বাদ থাকে না। সভ্যতাও কিন্তু সংস্কৃতিরই অংশ। এককথায় সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়। এ পরিচয় অন্য যে কোনো পরিচয়ের তুলনাতে অধিক বিশ্বাসযোগ্য। শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়ে থাকে, প্রকৃত মেরুদণ্ড কিন্তু শিক্ষা নয়, সংস্কৃতিই। শিক্ষা নিজেই সংস্কৃতির অংশ হওয়ার দাবিদার।
এটাও তো দেখা যায় যে, সভ্যতার মৃত্যুর পরেও সংস্কৃতির স্মারকগুলো বেঁচে থাকে। তারা রয়ে যায় ইতিহাসে, ঐতিহ্যে, সাহিত্যে, স্থাপত্যে, সঙ্গীতে, লোককাহিনিতে, এমনকি রূপকথাতেও। সেদিক থেকে সংস্কৃতির সঙ্গে সভ্যতা যে পাল্লা দিয়ে পারবে তা মোটেই নয়। সংস্কৃতির আবার গভীরও। কেননা মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ধর্ম ও বিজ্ঞানচিন্তা, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, আইন-কানুন, বলা যায় মূল্যবোধের নিজস্বতাও সংস্কৃতির ভেতরেই প্রবহমান থাকে। বললে বোধ করি ভুল হবে না যে, সংস্কৃতি ও সভ্যতার নির্যাস বটে। মানুষ যে একই সঙ্গে সামাজিক ও বুদ্ধিমান প্রাণী তার সে পরিচয়টা সংস্কৃতি যে ভাবে ধারণ করে অন্যকিছু সেভাবে পারে না। সভ্যতা হচ্ছে ব্যবহার্য; সংস্কৃতি মানুষের অন্তরে বাহিরে অবস্থিত।
কিন্তু মুখে -যাই বলি না কেন, সংস্কৃতিকে আমরা বাংলাদেশের মানুষরা, গুরুত্ব দিতে অভ্যস্ত নই। রাজনীতিকরাই তো রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন, এবং রাষ্ট্র কর্তৃত্ব করে সমাজের ওপর; দেখা যায় যে রাজনীতিকরা সবকিছুর কথাই বলেন, কিন্তু সংস্কৃতির ব্যাপারে সরব হন না। প্রশ্ন উঠবে এর কারণ কি? একটা কারণ এমন হতে পারে যে, রাজনীতিকরা নান্দনিক অর্থে যাকে সংস্কৃতি বলা হয় তার বিশেষ চর্চা করেন না। সাহিত্য ভালোবাসেন না, গানেও তেমন উৎসাহ নেই, শিল্পকলার নিদর্শন গৃহের শোভাবর্ধনে কাজে লাগালেও তার সমঝদারিত্বে পারঙ্গম নন। তাদের অনেকেরই রুচি প্রশংসনীয় নয়। রাজনীতিকদের ভাষা ব্যবহার বহুসময়েই আওয়াজপ্রধান হয়, কখনো কখনো অশালীনও।
সংস্কৃতিতে রাজনীতিকদের উৎসাহহীনতা এবং তাদের সাংস্কৃতিক রুচির দুর্বলতার আরেকটা কারণ হয়তো জ্ঞানের অভাব। সংস্কৃতি কিন্তু জ্ঞানেরও সক্রিয়তার দ্বারা পুষ্ট হয়। জ্ঞানের মূল্য এখন পৃথিবীজুড়েই কমতির দিকে। জ্ঞানের চাইতে প্রযুক্তির মূল্য অধিক। সাহিত্যেও উৎসাহ কমে আসছে দেখা যায়। নোবেল পুরস্কার তো সেরা সম্মান, কিন্তু সম্প্রতি একবছর এমন হয়েছে যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে একজন সংগীত রচয়িতা ও চর্চাকারীকে, পুরস্কার গ্রহণে যার নিজেরই সংকোচ ছিল। আরেক বছর তো পুরস্কার দেওয়া বন্ধই ছিল, ব্যবস্থাপকদের ভেতর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। তবে বিশ্বে যাই ঘটুক, আমাদের অবস্থা যে ভালো নয় তা তো মানতেই হবে।
দৈনিক পত্রিকায় এক সময়ে সাহিত্যের পাতা বেশ আগ্রহের সৃষ্টি করত, এখন পাতার আয়তন আগের তুলনায় খাটো হয়ে এসেছে, পাতার প্রতি পাঠকের আকর্ষণ যে বেড়েছে তাও নয়। নিয়মিত প্রকাশিত কোনো মাসিক পত্রিকা এখন বাংলাদেশে নেই। সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর অনেক পাঠক ছিল, সে সব পত্রিকা একে একে মারা গেছে। এরকম দশা এদেশে আগে কখনো দেখা যায়নি। ভাবাও যায়নি। পুস্তক প্রকাশিত হয়, কিন্তু পুস্তকের সমালোচনা কদাচিৎ চোখে পড়ে। এসমস্তই সংস্কৃতির ব্যাপারে রাজনীতিকদের উৎসাহহীনতার সঙ্গে যুক্ত। সংস্কৃতির উন্নয়নে তারা না আগ্রহী, না উৎসাহদাতা; তাদের অধিকাংশই বরং খুশি মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনা উন্নত হচ্ছে না দেখে। রাজনীতির মূলধারায় যারা ছিলেন এবং এখনো রয়েছেন, অর্থাৎ জাতীয়তাবাদীরা, তাদের উৎসাহ লুণ্ঠনে এবং সম্পদ পাচারে; তারা উন্নয়নের বড় বড় পরিকল্পনা নিতে উৎসাহী, কারণ তাতে যাতে বড় বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা যায়। দুর্নীতিকেই নীতি করে ফেলেছেন। অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে, এঁরা ছিলেন এবং এখনো আছেন, পুঁজিবাদের অন্ধকার দিকের পথযাত্রী।
পুঁজিবাদের একটা আলোর দিক ছিল- যেমন, স্বদেশের প্রতি অনুরাগ, উৎপাদনে বিনিয়োগ, জ্ঞানের-চর্চা, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি পক্ষপাত। পুঁজিবাদের আলোর দিকটাকে গ্রহণ করবেন এমন অন্তর্গত শক্তি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রশাসকরা রাখেন না। জ্ঞানের চর্চায় এবং সংস্কৃতির বিকাশে জাতীয়তাবাদীদের প্রতিপক্ষ সমাজতন্ত্রীদের উৎসাহ থাকার কথা; সেটা অবশ্যই ছিল; কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা আলোর চর্চা করবেন কী ভাবে, জাতীয়তাবাদীদের নানাবিধ নিষ্পেষণে তারা তো মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারেননি। সমাজতন্ত্রীদেরকে দমন করাটাই ছিল জাতীয়তাবাদীদের স্বআরোপিত প্রধান কর্তব্য। সে কর্তব্য পালন থেকে তারা বিন্দু পরিমাণও বিচ্যুত হননি। সমাজতন্ত্রীদের তারা প্রলুব্ধ করে কাছে টানতে চেয়েছেন, না-পারলে জেল জুলুম হত্যার মধ্য দিয়ে নিঃশেষ করে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। পুঁজিবাদী সংস্কৃতির মুনাফালিপ্সা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদিতাকে তারা ধারণ করেছেন; এবং সন্দেহ কী যে এই জিনিসগুলো সংস্কৃতির সুস্থ চর্চার মিত্র নয়, শত্রু বটে।
রাজনীতির পুঁজিপন্থি নেতারা এটা চানও না যে জনমানুষের সংস্কৃতির স্তর উন্নত হোক। কারণ তারা চান না জনগণ সচেতন থাকুক। সাংস্কৃতিক মানের উন্নয়নের বড় দিকটা হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরা সেটা চাইবেন কেন? তারা বরং চাইবেন জনগণ অজ্ঞতার ও প্রতিবাদহীনতার অন্ধকারেই নিমজ্জিত থাকুক। আলোর দিকে না গিয়ে, প্রশ্ন না করে তারা মেনে নিতে শিখুক। জনগণের মেরুদণ্ড শক্ত না হয়ে দুর্বল হোক।
তাই তো দেখা যায় আমাদের রাষ্ট্র জনশিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য যে, ৩২ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই, আর এটাও জানা গেছে যে, গত ২২ বছর ধরে শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দের হার একই জায়গাতে অনড় রয়ে গেছে, দক্ষিণ এশিয়াতে যেটি সর্বনিম্ন এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেল; এতে নিবন্ধিতদের ভেতর থেকে চার লক্ষের বেশি পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত থেকেছে। কারণ নাকি অভিভাবকদের আর্থিক অসংগতি, জীবিকার প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের কর্মে যোগদান ও কর্মের সন্ধানে বিদেশগমন, এবং অল্পবয়সে মেয়েদের বিবাহ। অথচ রাষ্ট্রনায়করা বলেন, অন্যরাও যে বলেন না তা নয় যে, শিক্ষাই আমাদের ভরসা, কারণ আমাদের বিশাল জনসংখ্যাকে যদি কাঁধের বোঝা হিসেবে না রেখে সৃষ্টিশীল সম্পদে পরিণত করতে হয় তাহলে শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
দুই বছরের ব্যবধানে খোদ ঢাকা শহরেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৪ শতাংশ কমেছে। এর বিপরীতে কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী নিশ্চয়ই লাফিয়ে লাফিয়ে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীও বেড়েছে। অর্থাৎ সমাজের দুভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়াটা অব্যাহত রয়েছে- একদিকে ধনী, অন্যদিকে দরিদ্র। মধ্যবিত্তের একাংশ (অতি ক্ষুদ্র, অবশ্যই) ওপরের দিকে উঠছে, বড় অংশ নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে, যার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি কিন্ডারগার্টেনের সমৃদ্ধিতে, কওমি মাদ্রাসার অভূতপূর্ব নীরব বৃদ্ধিতে এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্ধিষ্ণু দুর্দশায়। ছবিটা নতুন নয়, কিন্তু বিভাজনের মাত্রার এই অগ্রগতি এখন আগের তুলনায় অনেক অধিক।
ওদিকে তিনধারার শিক্ষা তো রয়েছেই। তিন ধারার এক ধারা মাদ্রাসা শিক্ষা, তার ভেতরেও একাধিক ধারা রয়েছে; এমনকি মূল যে ধারা- বাংলা মাধ্যম, সেখানেও ইংলিশ ভার্সন নামে একটি নতুন উৎপাতের আবির্ভাব ঘটেছে। কথা ছিল সর্বস্তরে শিক্ষার ধারা হবে এক এবং অভিন্ন এবং তার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। প্রাথমিক পর্যায়ে, অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত, মাতৃভাষা ছাড়া অন্যভাষা শেখার দরকার নেই; প্রাথমিক পার হয়ে শিক্ষার্থীরা বিদেশি একটি ভাষা শিখবে (প্রধানত ইংরেজি) এমনটাই ছিল ধারণা। সে-সব স্বপ্ন এখন ভগ্নস্তূপ বৈ নয়।
শিক্ষা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করছে না, বরং শ্রেণি বিভাজনকেই আরও গভীর এবং ব্যাপক করে একটি অভিন্ন সংস্কৃতি সৃষ্টির সম্ভাবনাকে প্রতিহত করে চলেছে। কিন্ডারগার্টেন ব্যবসা হিসেবেও খারাপ নয়। আর কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে তো তেমন একটা খরচই নেই, মসজিদকে ব্যবহার করলেই চলে। কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি তৈরিও কঠিন নয়। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদেরকে বেতনভাতা হিসেবে যা দেওয়া হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা যে দাবি করবেন এমন সাহস রাখেন না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা বলেছেন যে, সম্পদের অপ্রতুলতার জন্য শিক্ষকদেরকে তারা প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারছেন না। কথাটা দুদিক থেকেই সঠিক। শিক্ষকরা মর্যাদা পাচ্ছেন না, এবং তাদের জন্য বরাদ্দও সংকীর্ণ; কিন্তু এই বাস্তবতা কোনো রাজনৈতিক ভূমিকম্পের দরুন সৃষ্টি হয়নি; এটি ঘটেছে উন্নয়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ও ধারাবাহিকতায়। রাষ্ট্র যাঁরা চালান তারা সাধারণ মানুষের শিক্ষা নিয়ে মোটেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নন, তাদের চিন্তা নিজেদের সন্তানদেরকে কেমন করে ইংরেজি মাধ্যম পড়াবেন এবং কত দ্রুত বিদেশে পাঠানো যায় তা নিয়ে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে