গোপালগঞ্জে গুলি করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন?
বাংলাদেশের ৬৩টি জেলাও যদি আওয়ামী লীগশূন্য হয়ে যায়, তারপরও বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান এবং তার সমাধি যেখানে, সেই গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ থাকবে এবং বেশ শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে- এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। যে কারণে গোপালগঞ্জকে বলা হয় ‘আওয়ামী লীগের দুর্গ’। সেই দুর্গ বা ঘাঁটিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হলো, সেটি বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই ঘটনায় কার কতটুকু লাভ-ক্ষতি হলো, সেই অঙ্কও অনেকে কষছেন। তবে রাজনৈতিকভাবে যারাই লাভবান হোন না কেন, যারা নিহত হলেন তাদের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুপরিজনের চেয়ে বেশি ক্ষতি আর কারও হয়নি। আর যারা নিহত হলেন তারা এখন জাগতিক জীবনের সব লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে।
গত পয়লা জুলাই শুরু হওয়া ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’র অংশ হিসেবে বুধবার (১৬ জুলাই) ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘোষণা করে এনসিপি। দেশের অন্যান্য জেলায় কর্মসূচির নাম ‘জুলাই পদযাত্রা’ হলেও তারা গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রে কেন ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ বা গোপালগঞ্জ অভিযান নামকরণ করলো সেটি একটি বড় প্রশ্ন? কেননা এই নামকরণের মধ্য দিয়ে তারা যে সচেতনভাবে গোপালগঞ্জকে আলাদা করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই কর্মসূচির আগের দিন রাত সোয়া ১১টায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম লেখেন: ‘আগামীকাল ১৬ জুলাই মার্চ টু গোপালগঞ্জ।’ এদিন বিকালে এনসিপির উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেসবুকে লেখেন: ‘১৬ জুলাই মার্চ টু গোপালগঞ্জ!’ রাতে তিনি আরেকটি পোস্ট দিয়ে লেখেন: ‘বিপ্লবের সহযোদ্ধারা, ধূমকেতুর মতো ছুটে আসুন। আগামীকাল সকাল ১১টায় গোপালগঞ্জ শহরে দেখা হচ্ছে ইনশাআল্লাহ।’ ঘটনার দিন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে এনসিপির সিনিয়র নেতা আরিফুর রহমান তুহিন ফেসবুকে পোস্ট দেন: ‘পদযাত্রা অথবা বুলডোজার।’
প্রশ্ন হলো, পদযাত্রা অথবা বুলডোজার কেন? বুলডোজার দিয়ে তারা কী ভাঙার ইঙ্গিত করেছেন, সেটি অনেকের কাছেই পরিষ্কার। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার পর এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এনসিপি হয়তো গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর সমাধি গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা বলছে বা ইঙ্গিত করছে। ইঙ্গিতটা যদি এরকম হয় তাহলে গোপালগঞ্জের স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থক তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, এনসিপি কেন বুলডোজারের প্রসঙ্গ টানলো? কেউ কি তাদের এই ধরনের হার্ডলাইনে যেতে বাধ্য করলো বা পদযাত্রার বদলে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি নামকরণে উসকানি দিয়েছিল?
ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, যে জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে, সেই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী তরুণদের দল যখন বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার জন্মস্থান তথা আওয়ামী লীগের দুর্গ গোপালগঞ্জে কোনো কর্মসূচি নিয়ে যাবে, সেখানে যে সংঘাত বা হামলা-পাল্টা হামলা হবে- এটি অস্বাভাবিক নয়। এনসিপি নেতারাও এটা জানতেন যে, তাদের গোপালগঞ্জের কর্মসূচি দেশের অন্য এলাকাগুলোর মতো হবে না। সেখানে হামলা বা বড় ধরনের সংঘাত হতে পারে, এমন শঙ্কা যে তাদের মধ্যে ছিল না, তা বলা যাবে না। তারপরও তারা সেখানে কেন এই কর্মসূচি করতে গেলেন? নিজেদের সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য? পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা পাবেন এই ভরসায়?
৫ আগস্টের পরে সারা দেশে আওয়ামী লীগ কোণঠাসা; কিন্তু গোপালগঞ্জে তারা কী অবস্থায় আছে, সেটি পরীক্ষা করা, নাকি গোপালগঞ্জ যে আওয়ামী লীগের দুর্গ- এই মিথ ভেঙে দেয়া? এই মিথে ভেঙে দেয়াটাই বা কতটা জরুরি? কেননা, কোনো একটি দলের বিশেষ কোনো জেলায় অবস্থান শক্ত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। যেমন বগুড়াকে বলা হয় বিএনপির ঘাঁটি। রংপুরকে জাতীয় পার্টির। কোনো একটি জেলা নির্দিষ্ট একটি দলের ঘাঁটি হয়ে ওঠে নানা কারণে। সেটি যে সব সময় খারাপ এমনও নয়। আবার কেউ যদি সেই ঘাঁটি ভাঙতে চায়, সেখানে সংঘাত-সহিংসতা নয়, বরং যে দলের ঘাঁটি, তার চেয়ে উন্নত রাজনীতি দিয়ে জনগণের মন জয় করাটাই যৌক্তিক ও কাঙ্ক্ষিত। সুতরাং, এনসিপি যদি ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ না বলে অন্য জেলার মতো গোপালগঞ্জেও ‘জুলাই পদযাত্রা’ নামে কর্মসূচি করতো এবং সেখানে বুলডোজারের প্রসঙ্গটি না আনতো; যদি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে এই ধারণা তৈরি না হতো যে, তারা বঙ্গবন্ধুর সমাধি গুঁড়িয়ে দেবে (যে হুমকি ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙার পর থেকেই দেয়া হচ্ছিল)- তাহলে পরিস্থিতি এতটা সহিংস হয়ে উঠতো কি না, সন্দেহ আছে।
যদিও এর মধ্য দিয়ে এনসিপির সমাবেশে হামলা ও ভাঙচুরকে জায়েজ করা বা বৈধতা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং যে কোনো উসকানি সত্ত্বেও এনসিপি যদি শান্তিপূর্ণভাবে গোপালগঞ্জে সমাবেশ শেষ করে চলে যেতে পারত, সেটি গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের জন্য একটা সহনশীলতার পরিচয় হতো; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, দেশের রাজনীতি সেই সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গায় নেই।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, গোপালগঞ্জে সহিংসতায় ৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। প্রশ্ন হলো, সেখানে গুলি করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন এবং তারা কাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন?
ঘটনার পরদিন বৃহস্পতিবার গোপালগঞ্জ জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের প্রতিবেদনে ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে: ‘সেনাবাহিনী ও পুলিশ উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে বুঝানোর চেষ্টা করে; কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ করে। এছাড়া নাশকতাকারীরা গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারসহ অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় হামলা করে। এ সময় সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। উক্ত ঘটনায় প্রায় ৪৫ জন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক লোকজন আহত হন মর্মে জানা যায়।’
তারা যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছ্নে, সেটি পুলিশের বিবৃতিতে উল্লেখ নেই। তবে এটি নিশ্চিত করেছেন চিকিৎসক। গণমাধ্যমের খবর বলছে, বুধবার বিকালে তিনজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তারা গুলিবিদ্ধ ছিলেন। এছাড়া আরও ৯ জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। (প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০২৫)।
পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম দাবি করেছেন, গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেনি। তার ভাষায়: পুলিশ ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছে। লেথাল (প্রাণঘাতী অস্ত্র) কোনো কিছু ব্যবহার করেনি। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটু সময় লেগেছে। (খবরের কাগজ, ১৭ জুলাই ২০২৫)।
প্রশ্ন হচ্ছে, যদি তারা পুলিশের গুলিতে নিহত না হয়ে থাকেন তাহলে তাদের গুলি করল কে বা কারা? এ ঘটনায় হৃদয়বিদারক একটি ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। একজন মানুষের বুকে বুট চেপে রাখা, পুলিশের গাড়িতে একজন অচেতন তরুণকে ছুড়ে ফেলে দেয়া- এসব দৃশ্য কখনই, কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই দৃশ্যগুলের বিরুদ্ধেই ২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। তাহলে এখন আবার এ ধরনের নিষ্ঠুরতার দৃশ্য দেখতে হচ্ছে কেন? এই ভিডিওগুলো বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে কি বার্তা দেবে? ভবিষ্যতে যেন আর কখনই এ ধরনের দৃশ্য দেখতে না হয়, সে কারণেই যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা সামনে আসা জরুরি।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে