রাজধানীতে কেন বিমান প্রশিক্ষণ দিতে হবে
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অত্যাধুনিক বিমান এফটি-৭ বিজিআই দুর্ঘটনায় সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৩১ জন নিহত এবং অন্তত ১৬৫ জন আহত হয়েছে। আহত এবং নিহতদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। যারা আহত হয়েছে, তাদের অনেকেরই অবস্থা খুবই খারাপ। ২০১৩ সালে এই বিমানটি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যুক্ত করা হয়েছিল। এই বিমানের রেঞ্জ হচ্ছে ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার। বিমানটি উড্ডয়ন করেছিল দুপুর ১টা ৬ মিনিটে। উড্ডয়নের মাত্র তিন মিনিট পর বিমান উড্ডয়নের পর ৯ মিনিটের মাথায় উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের ওপর দুর্ঘটনায় পতিত হলে স্কুল ভবনে আগুন লেগে যায়। বাচ্চাদের আর্তচিৎকারে পুরো এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
বিমানটির নিয়ন্ত্রণে ছিলেন প্রশিক্ষণরত পাইলট তৌকির। ঘটনার পর পরই বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে নেমে পরে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা আর ঘটেনি। পাইলট তৌকির ইচ্ছে করলে প্যারাসুটের মাধ্যমে দুর্ঘটনারত বিমান থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন; কিন্তু তিনি চেষ্টা করেন বিমানটি কীভাবে জনশূন্য এলাকায় নিয়ে যাওয়া যায়। জনশূন্য এলাকায় নিয়ে যাবার সময়ই বিমানটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। পাইলট তৌকির নিহত হন। একজন সেনা কর্মকর্তার জন্য এর চেয়ে বীরত্বপূর্ণ কাজ আর কি হতে পারে? শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। স্বাভাবিক সময়ে মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিহত হওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। আমি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এই বীরের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। তৌকিরের মা-বাবাকে সান্ত্বনা দেবার কোনো ভাষা জানা নেই।
এই বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য জাতি চিরদিন তৌকিরকে স্মরণ রাখবে- এটাই তাদের সান্ত্বনা। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী আর একজন বীর শহীদ আসিম জাওয়াদের কথা। তিনি চট্টগ্রামে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন। বিমানটি দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি নিজের জীবন বাঁচানোর কোনো চেষ্টা না করে গ্রামবাসীকে বাঁচানোর জন্য বিমানটি জনমানবহীন এলাকায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ওয়াসিম জাওয়াদ নিজের জীবন দিয়ে শত শত গ্রামবাসীকে রক্ষা করে গেছেন। এমন বীরদের আমরা সালাম জানাই। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সদস্যরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণকে রক্ষা করার জন্য যেভাবে জীবন দিচ্ছেন তা খুবই প্রশংসনীয়।
উত্তরার দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুলের ওপর বাংলাদেশ বিমানের প্রশিক্ষণ বিমানটি যখন বিধ্বস্ত হয়, তখন ক্লাস চলছিল। আর মাত্র ১০ মিনিট পরই স্কুল ছুটি হয়ে যেত। স্কুল ছুটি হলে বাচ্চারা বাড়িতে চলে যেত। তাদের অভিভাবকরাও স্কুল প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়েছিলেন বাচ্চাদের নিয়ে যাবার জন্য; কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়নি। তারা বাচ্চাদের নিয়ে গেছেন ঠিকই তবে জীবিত নয় কফিনে মোড়া অবস্থায়। অভিভাবকরা বুঝতে পারেননি মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কী ঘটতে চলেছে। বাংলাদেশের মানুষ একে অন্যের সমস্যায় এগিয়ে আসে। ত্যাগ স্বীকার করতে পারে অন্যের সেবায়। মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনায় আবারও সেই বিষয়টি প্রমাণিত হলো। চারদিক থেকে মানুষ এসে আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে পৌঁছে দেন। কেউবা রক্ত দিয়ে আহতদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাভাবে নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা হচ্ছে। কেন এই বিমান দুর্ঘটনা ঘটল তদন্ত কমিটি গঠন করে তার কারণ নিশ্চয়ই খুঁজে বের করা হবে; কিন্তু কোনো কোনো মহল থেকে এই বিমান দুর্ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
কেউ কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করছেন বাংলাদেশে কি ল্যান্ড এরিয়ার কোনো অভাব আছে? তাহলে রাজধানীর একটি স্কুলের ওপর দিয়ে কেনো বিমান প্রশিক্ষণ দিতে হবে? এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের বিকৃত মানসিকতা প্রত্যক্ষ করলে যে কারো মনে করুণার উদ্রেগ হতে বাধ্য। যে মুহূর্তে জাতি শোকাহত তখন এ ধরনের অবান্তর প্রশ্ন উত্থাপন করা একমাত্র বিকৃত রুচির মানুষের পক্ষেই সম্ভব। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। দুর্ঘটনার কোনো সহজ প্রতিকার হয় না। যারা আজকে এই অবান্তর প্রশ্ন উত্থাপন করে বাহবা নিতে চাচ্ছেন তারা এতদিন কোথায় ছিলেন? তারা যদি সত্যি ভদ্র মানুষ হতেন তাহলে অনেক আগেই এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করতেন।
যে কোনো দুর্ঘটনাই দুঃখজনক। আর এমন একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার শোক ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তবে এই দুর্ঘটনার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে যে সহমর্মিতা প্রত্যক্ষ করা গেছে, তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। মানুষ তাদের সর্বস্ব নিয়ে এগিয়ে এসেছে। নিঃস্বার্থভাবে অন্যের দুঃখে এগিয়ে আসা,পরের জন্য কাজ করার নামই সামাজিক পুঁজি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখনো সামাজিক পুঁজি ধারণ করে আছে। এটাই বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ। বাংলাদেশের মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এটা তারা বারবার প্রমাণ দিয়েছে; কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা কোনোভাবেই জাতিকে একতাবদ্ধ করার জন্য অনুকূল নয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ স্বীয় হীন স্বার্থ উদ্ধারে জাতিকে বিভক্ত করে রাখতেই যেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ঐক্যবদ্ধ জাতি দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে এটাই রাজনৈতিক নেতাদের সবচেয়ে বড় ভয়। তাই তারা দেশের মানুষকে নানা ইস্যুতে বিভক্ত করে রেখে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল ইস্পাতদৃঢ় ঐক্যের মাধ্যমে। শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ঐক্যবদ্ধ বাঙারি জাতি যে কোনো স্বৈরশাসকের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। ইংরেজরা ১৯০৫ সালে বাংলা নামক প্রদেশটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছিল। তারা এই বিভক্তির পেছনে দৃশ্যমান কারণ হিসেবে বাংলার বিশালতাকে প্রদর্শন করেছিল। তারা বলেছিল,বাংলা এত বড় একটি প্রদেশ যা একজন ভাইর রয়ের পক্ষে তার ৫ বছরের কর্মকালীন সময়ে একবারও পুরো অঞ্চল পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না। তাই প্রশাসনিক কাজেই সুবিধার্থে বাংলাকে বিভক্ত করা প্রয়োজন; কিন্তু ইংরেজদের ভয় ছিল অন্যত্র। ইংরেজদের বিভিন্ন গোপন নথিতে প্রমাণিত হয় যে, প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বাংলা ভাগ করা হয়নি। ইংরেজরা মনে করতো বাংলাদেশের মানুষ ভারতের যে কোনো অঞ্চলের মানুষের চেয়ে বেশি মাত্রায় রাজনীতি সচেতন। ভারতের অন্য অঞ্চলের মানুষ আজকে যা ভাবছে বাংলার মানুষ তা গতকালই ভেবে রেখেছে। বাঙালিরা স্বপ্ন দেখে দিল্লির লাট ভবনে একজন বাঙালি বসে আসে। কাজেই বাংলাকে যদি বিভক্ত করা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে। তাই ইংরেজরা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতিগ্রহণ করে এদেশ শাসনের জন্য। ইংরেজরা বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবেসে বাংলা ভাগ করেননি। এই হচ্ছে বাস্তবতা।
ইংরেজদের শেখানো ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা এখনো অনুসরণ করে চলেছে। ফলে দেখা যায় রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বাংলাদেশের মানুষ কোনো ইস্যুতেই একমত হতে পারে না। তারপরও মাঝে মাঝে কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যা আমাদের মধ্যে ঐক্যের সুবাতাস বইয়ে দেয়। উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের ওপর সংঘটিত বিমান দুর্ঘটনা তেমনি একটি ইস্যু। যারা প্রশ্ন তুলছেন, রাজধানীর উপর দিয়ে বিমান প্রশিক্ষণ কেনো চালানো হলো তাদের উদ্দেশ্য যে মহৎ নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা যদি বুঝতেই পারতেন যে রাজধানীর ওপর দিয়ে বিমান প্রশিক্ষণ দেয়া ঠিক নয়, যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তাহলে এই সত্য চেপে রাখার জন্য তারা দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে। জাতির দুঃখের দিনে সহমর্মিতা না জানিয়ে বিকৃত প্রশ্ন উত্থাপন করে কৃতিত্ব নেবার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
বিমান দুর্ঘটনা যারা নিহত বা আহত হয়েছেন তাদের পরিবারের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যদিও তাদের যে ক্ষতি হয়েছে তার কোনো মাশুল দেয়া সম্ভব নয়। যে মা তার সন্তানকে হারিয়েছেন তিনিই অনুভব করতে পারবেন সন্তান হারানোর বেদনা হৃদয় মাঝে কতটা ক্ষত সৃষ্টি করে। যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। আর তা যদি হয় এমন দুর্ঘটনায় তাহলে তো কথাই নেই। প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর পাইলট তৌকিরের এটাই ছিল প্রথম একক বিমান চালনা; কিন্তু তিনি সফল হতে পারলেন না। তবে তিনি নিজের জীবন দিয়ে যেভাবে শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন তা আগামীতে ইতিহাস হয়ে থাকবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২২ জুলাইকে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আমরা বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। প্রত্যাশা করবো আর কখনোই এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটবে না।
এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে