Views Bangladesh Logo

চীন-ভারত শত্রুতা ভুলে কেন মিত্রতার পথে হাঁটছে?

Mohshin  Habib

মহসীন হাবিব

শুরুতেই ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কীভাবে বন্ধুত্ব থেকে শত্রুতায় পরিণত হলো এবং ভারতকে এখন নিরাপদ-নিবিড় বন্ধুত্বের জন্য চীনের কথা বিবেচনা করতে হচ্ছে তার পেছনের ছোট্ট ইতিহাস উল্লেখ প্রাসঙ্গিক। ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন এগিয়ে এসেছে।


অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙেই গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিটিং প্রেসিডেন্ট তখন রিপাবলিকান দলের জর্জ ডব্লিউ বুশ, যাকে আমরা সিনিয়র বুশ বলে থাকি। সেই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনি আবহাওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে জুন মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে একটি সম্মেলনে যোগদান করতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলেন। আমেরিকার শহরে শহরে মিছিল হলো, বরিস! বরিস! চিৎকারে।

নির্বাচনে আরকানসাসের গভর্নর বিল ক্লিনটন ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী। তিনি এরই মধ্যে রাশিয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অধিক সহায়তা প্রদানের দাবি করেছেন। রাজনীতির বাইরেও ক্লিনটন ব্যক্তিগতভাবে ইয়েলৎসিনকে পছন্দ করতে শুরু করেছেন। তিনি আশা করলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন তার সঙ্গে দেখা করবেন। এটি একটি দীর্ঘদিনের পরম্পরা কোনো দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে তিনি দুই প্রার্থীর সঙ্গেই সাক্ষাৎ করেন; কিন্তু এক্ষেত্রে প্রায় ব্যতিক্রম হয়ে গিয়েছিল। ইয়েলৎসিন ক্লিনটনের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হলেন না। কারণ, রাশিয়ার দূতাবাস কর্মকর্তারা ইয়েলৎসিনকে বোঝালেন, ক্লিনটনের সঙ্গে দেখা না করে বরং স্বতন্ত্র প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রস পেরোটের সঙ্গে দেখা করাই শ্রেয়; কিন্তু ক্লিনটন নাছোড়বান্দা। তিনি ইয়েলৎসিনের সঙ্গে দেখা হওয়াটা জরুরি মনে করলেন এবং ব্লেয়ার হাউসে ৩০ মিনিটের একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা হলো। সাক্ষাতের সময় বরিস ছিলেন অমায়িক; কিন্তু ক্লিনটন বুঝতে পেরেছিলেন তিনি চাচ্ছেন বুশ সিনিয়র আবার যাতে নির্বাচিত হন।

ওই নির্বাচনে বুশ পরাজিত হলেন এবং ক্লিনটন জয়লাভ করেন। এরপর বরিস ইয়েলৎসিন বিল ক্লিনটনকে যথারীতি ফোন করে অভিনন্দন জানান এবং রাশিয়াকে পূর্ণ সহায়তার অনুরোধ জানান। ক্লিনটন শুধু রাজিই হননি, তিনি তার ফরেন পলিসি টিমকে নির্দেশ দেন, রাশিয়াকে আরও বড় আকারের সহায়তা প্রদানের জন্য।

ঠিক একইভাবে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, নির্বাচনের এক বছর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। প্রায় ৭০ শতাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভোটার ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দিয়েছিল। ফলে ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে মোদির এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। মোদিও এই খেপাটে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। তিনি ধারণা করলেন ট্রাম্প এবারও প্রেসিডেন্ট হবেন। ততদিনে অবশ্য দুজনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পর্যায়ে চলে গেছে। ওই সফরের সময় ‘দি টেক্সাস ইন্ডিয়া ফোরাম’ নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হাউসটনে বিশাল এক বর্ণাঢ্য আয়োজন করে, যার নাম দেয়া হয় হাউ দি মোদি।

প্রকৃতপক্ষে এই আয়োজন ছিল ট্রাম্প ও মোদির যৌথ উদ্যোগে। ট্রাম্প তখন ভাষণ দিতে উঠে বলেছিলেন, মোদি তাকে ওই অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেছেন। যা হোক, সংক্ষেপে বলি, বিশাল স্টেডিয়ামে ৫০ হাজার মানুষের সামনে ট্রাম্পের প্রশংসা করে তাকে সমর্থন দেন মোদি। ট্রাম্পও ‘আমি ভারতকে ভালোবাসি’ বলে মোদিকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেন। ট্রাম্প ভারতীয়-আমেরিকানদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমাদের পেয়ে আমরা গর্বিত। তখন থেকেই ট্রাম্প নরেন্দ্র মোদিকে ‘মাই ফ্রেন্ড’ বলে সম্বোধন করতেন।’

এর পাঁচ মাস পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প ভারত সফর করেন এবং তাকে গুজরাটের নরেন্দ্র মোদি (বর্তমান নাম) স্টেডিয়ামে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ‘নমস্তে ট্রাম্প’ নামের ওই অনুষ্ঠনে প্রায় সোয়া লাখ মানুষ উপস্থিত ছিলেন; কিন্তু ওই বছর নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে হেরে যান ট্রাম্প। বাইডেন সব অবলোকন করলেও নানা বিবেচনায় ভারতের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর সিদ্ধান্তের কথা ভাবেননি। সম্পর্ক স্বাভাবিক ও অব্যাহত রেখেছেন।

কিন্তু এসব হিসাব-নিকাশ ঘরে যায় ২০২৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে। নির্বাচনের পূর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোয়াড এর সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তার সফরের পূর্বেই রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্প মিশিগানে একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে মোদি আসছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। সে ফ্রান্টাস্টিক।’ কিন্তু মোদি ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেননি। উল্টো বাইডেনের স্ত্রীর জন্য ২০ হাজার ডলার দিয়ে ল্যাবে তৈরি হীরার আংটি নিয়ে যান।

কথিত আছে, মোদিকে ভারতীয় দূতাবাস থেকে ধারণা দেয়া হয়েছিল যে, এবার ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজিত হবেন এবং ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হবেন। এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় এবং ট্রাম্প ফের আরেক দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এবার শুরু হয় ট্রাম্পের ভারতের ওপর প্রতিশোধের পালা এবং তা এখন নগ্ন আকার ধারণ করেছে। ট্যারিফ প্রশ্নে ভারতকে অন্যতম টার্গেট করে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়াও গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান চার দিনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, যুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্র ও আইএমএফের পাকিস্তানের অনুকূলে অর্থ ছাড়, যুদ্ধ-পরবর্তীতে পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল হওয়া জেনারেল অসিম মুনিরকে ডিনারে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এক ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক- এসব কিছু শুধু ভারতকে ভীষণভাবে হতাশ করেছে। আর বিশ্ববাসীকে, এমনকি ওয়াশিংটনের অনেক দায়িত্বশীলকেও হতবাক করেছে।

বিগত ২৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সরকার তার বিদেশনীতিতে ভারতের প্রতি এমন বৈরী আচরণ করেনি। এখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক বন্ধুত্বে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং তার শিষ্য ইউরোপের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো ভারত নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে জ্বালানি কেনে! ভারত কিনলে দোষ; কিন্তু ইউরোপ কিনলে দোষ নেই। টোটাল এনার্জি, সাপ্লাই অব এনার্জি-২ যে গ্যাস সরবরাহ করে তা আসে নোভাটেক থেকে। এই রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহ না পেলে ইউরোপ অনেকটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠবে।

এসব কিছু ভারত এখন অপ্রত্যাশিত ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পেরেছে। এই বুঝতে পারাটা ছিল জরুরি। মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই ভারত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। গত সপ্তাহে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল মস্কো সফরে গিয়ে রাশিয়ার সিকিউরিটি কাউন্সিল সেক্রেটারি সেরগেই সইগু এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিক আলোচনা করেছেন, বিশেষ করে দুদেশের সম্পর্কের ওপর। ৮ আগস্ট নরেন্দ্র মোদি পুতিনকে টেলিফোন করেন এবং তাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান। এ বছরের শেষ দিকে পুতিন ভারত সফর করবেন।

অন্যদিকে ভারত চীনের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে কঠিন মতবিরোধ রয়েছে এবং তা রাতারাতি মিটিয়ে ফেলা সম্ভব নয়, তথাপি এটি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন সংযোজন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী ৩১ আগস্ট সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের মিটিংয়ে যোগ দিতে চীন যাচ্ছেন। চীন এরই মধ্যে স্বাগত জানিয়েছে তার সফর। চীন ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ফোড়া হয়ে আছে পাকিস্তান। চিরবৈরিতার দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে রয়েছে চীনের নিবিড় সম্পর্ক। চীন অনেকটাই পাকিস্তানের গার্ডিয়ান হিসেবে অবতীর্ন।

কিন্তু সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গেও স্বাভাবিক সম্পর্ক ভারত গড়ে তুলতে পারত। এর আগে একাধিকবার দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার কাছাকাছি গিয়েছিল; তবে বাদ সেধেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। যখনই ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা কাছাকাছি এসেছেন তখনই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের সঙ্গে সীমান্ত যুদ্ধ শুরু করেছে। তার প্রমাণ কারগিল যুদ্ধ এবং উরি আক্রমণ। এখন যদি চীন ভারতের সঙ্গে সত্যিই ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়, তাহলে সমস্যাটি দূর হওয়া সম্ভব। কারণ চীনের কথা ছাড়া পাকিস্তানের সরকার শুধু নয়, সেনাবাহিনীরও নড়ার উপায় নেই। তবে চীনও চাইছে ভারতের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে। তাদের কথায়ও তা পরিষ্কার। তাইওয়ান প্রশ্নে চীনের সঙ্গে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর, সেখানে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

সাময়িকভাবে অর্থনৈতিক চাপে পড়ছে ভারত; কিন্তু এখনই ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোয়াড না ব্রিকস। কোয়াড অস্ট্রেলিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মেরিটাইম পার্টনারশিপ সংগঠন। শুধু চীনের বিরুদ্ধেই এই সংগঠনের সৃষ্টি। আর ব্রিকস হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই পাঁচটি দেশের সংগঠন। মূলত গ্লোবাল সাউথের অর্থনৈতিক সহযোগিতাই এই সংগঠনের উদ্দেশ্য। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে এটি তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবস্থানের একটি সংগঠন। এই ব্রিকসের সদস্য হওয়ায় ভারতের ওপর বাড়ি ১০ শতাংশ ট্যারিফ পেনাল্টি হিসেবে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন ভারত কোন দিকে যাবে?

ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সাহসিকতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বহু বিশেষজ্ঞ বলছেন, বিদ্যুতের গতিতে আগানো প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে আঁটসাঁট সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলেই ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না। এখন সম্পর্ক কীভাবে তৈরি হবে, তা নির্ভর করছে ভারতের কূটনীতিকদের দক্ষতা, পারদর্শিতা এবং সিদ্ধান্তের ওপর। একটি বড় সমস্যা উত্তরোত্তর বেড়েছে। তা হলো দুদেশের জনগণের একের প্রতি আরেকের বিদ্বেষ। সেখানেও একটি বরফ গলানোর চেষ্টা চলছে দুদেশের পক্ষ থেকে। ভারতীয়দের মধ্যে অনেকে এখন সম্পর্ক নতুন করে ঝালাইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন- এটা একটি ভালো দিক।

তবে চলমান যে সংঘাত এবং অর্থনৈতিক যে প্রতিযোগিতা তা চলতেই থাকবে এবং তা সামনে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এক্ষেত্রে শিগগির ভারতের সিদ্ধান্তে আসাটা জরুরি। এমনকি চীন ভারত সম্পর্কের ধরনের ওপর নির্ভর করছে দক্ষিণ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা। এটাও ভারতকে মনে রাখতে হবে।

মহসীন হাবিব: সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। 

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ