Views Bangladesh Logo

চুয়ান্ন বছর বয়সেও কেন বাংলাদেশ শিশু রয়ে গেল?

নির্বাচনমুখী লোকজনের ধারণা নির্বাচন হলে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে, জিডিপি বৃদ্ধি পাবে, বিনিয়োগের মহাপ্লাবন হবে, কলকারখানা বন্ধ হবে না, গ্যাসের সরবরাহে কমতি হবে না, বিদ্যুতের দাম কমবে, লোডশেডিং হবে না, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম থাকবে না, ওয়াজ আর ব্যান্ড সংগীতের আওয়াজে শিক্ষার্থীর মনোযোগ নষ্ট হবে না। আবার কিছু মানুষের ধারণা- নির্বাচন হলেও এগুলোর কিচ্ছু হবে না বরং আবির্ভাব হবে নতুন চোর, ভিন্ন সাজের ডাকাত, অর্থগৃধ্নু দুর্নীতিবাজ, লেবাসধারী ঘুষখোর, নবসাজে অর্থ পাচারকারী। বর্তমান দুদক কমিশনার মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী তার ঘুষ দেয়ার কাহিনি শুনিয়েছেন গণশুনানিতে; শুনিয়েছেন বহুতলা ভবনের নকশা অনুমোদনে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বা অনাপত্তি নিতে গিয়ে কীভাবে তাকে হেনস্তা হতে হয়েছে, উল্লেখ করেছেন কীভাবে হজে যাওয়ার ঠিক পূর্বদিন তাকে এক লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ঘুষ দেয়া অপরাধ বিধায় ঘুষ দেয়ার কথা কেউ বলে না, ঘুষ ইমানদার লোকদেরও দিতে হয়; কিন্তু প্রমাণ করা কঠিন। প্রমাণ করা গেলেও প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়া বোকামি, আইনের অসংখ্য ধারা, কোন ধারা জামিন অযোগ্য তা ঘুষখোর জানে। এগুলো শুধু স্বৈরাচারের আমলে হয় না, নির্বাচিত সরকারের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়ও হয়।

জনগণের ক্ষমতায়নই নাকি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মূল বৈশিষ্ট্য; অথচ বাংলাদেশে যতবার নির্বাচন হয়েছে জনগণ ততবারই ক্ষমতাহীন হয়েছে। বৈষম্য, ঘুষ-দুর্নীতি আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ইশতেহার দিয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিটি দলীয় সরকার ক্ষমতায় বসে সব অপরাধের সঙ্গে আপস করেছে। নির্বাচনে যতবার ক্ষমতার বদল হয়েছে ততবার বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্নীতি আর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। বিরোধী দল সবসময় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মিছিল করেছে, মিটিং করেছে, রাজপথে রক্ত দিয়েছে; কিন্তু এই একই বিরোধী দল ক্ষমতায় গিয়েই ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার সর্ব প্রকার অবৈধ পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে গিয়েই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির সরকারের গণঅভ্যুত্থানে পতন হয়েছে। স্বাধীনতার পর সব সরকারই ছিল স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট। এই তিনটি দলের শীর্ষ নেতার কথাই আইন, তাদের কথায় দল চলে, কোনো দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির লেশমাত্রও নেই। তাই এই দলগুলো যখন ক্ষমতায় বসে তখন দলীয় শীর্ষ নেতার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ অটোমেটিক্যালি সরকারের ওপর ছায়া ফেলে।

নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু দুর্নীতিবাজের পরিবর্তন হয়। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে নির্বাচনটাও দুর্নীতিগ্রস্ত, নির্বাচনকে যারাই দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে তাদের আবার পতনও হয়েছে। নির্বাচনকে দুর্নীতিগ্রস্ত করার কারণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানেরও পতন হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনেও কারচুপি হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করতে পারত; কিন্তু তারা চেয়েছিল ৩০০ আসনে জিততে। আওয়ামী লীগের খন্দকার মোশতাক স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশীদ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হলেও খন্দকার মোস্তাককেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়- এমন ঘটনা আরও হয়েছে।

তারপর হলো জিয়াউর রহমানের ‘গণভোট’, ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন। গণভোটে কোনো কোনো কেন্দ্রে মোট ভোটের চেয়ে জিয়াউর রহমানের পক্ষে কাস্টিং ভোট ছিল বেশি। এরশাদ সাহেবের আমলে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচন, বিএনপির আমলের ১৯৯৪ সালের মাগুরার উপনির্বাচন ও ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন, আওয়ামী লীগ আমলের ২০১৪ সালের নির্বাচন- সব নির্বাচনই ছিল একতরফা ও একচেটিয়া। এ ছাড়াও ২০১৮ সালের নৈশভোটের কথা সবার জানা। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে অদ্যাবধি দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচন বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থাকে সুষ্ঠু হলেও বিরোধী দলের সাংসদরা কিন্তু সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন; অনুপস্থিত থাকলেও তারা বেতন-ভাতা নিতে ভুল করেননি। এমন নীতিহীন সাংসদদের নির্বাচন করার জন্যই আমাদের ভোট দিতে হবে।

সংসদে কী হয়? ক্ষমতাসীন সরকার যা চায় তাই পাস হয়, পাস হয় কণ্ঠভোটে। বাংলাদেশে বিগত ৫৪ বছরে সংসদে এবং সংসদের বাইরে নিবর্তনমূলক আইন পাস করতে কোনো দলীয় সরকারের কখনো বেগ পেতে হয়নি। বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করার জন্য বা বিরোধী দলকে দমন করার জন্য সব সরকারই গণতান্ত্রিক নিয়মকানুন মেনে নিবর্তনমূলক আইন করেছে; এই সব আইন পাসের সময় বিরোধী সাংসদদের আপত্তির প্রতি কর্ণপাত করা হয়নি। ভবিষ্যতেও তাই হবে। যে সংসদ সদস্যদের অনুমোদনে জনগণের ওপর ট্যাক্স আরোপিত হয়, সেই সাংসদদের ট্যাক্স ছাড়া গাড়ি আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে এই সংসদেই।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, নিজেদের সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রে সরকার এবং বিরোধী সাংসদদের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকে না। সাংসদরা জনগণের প্রতিনিধি; কিন্তু সংসদের ভেতরে ও বাইরে সাংসদদের আচরণ প্রতিনিধিত্বমূলক থাকে না- সংসদের বাইরে অনেক চড়-থাপ্পড়ের কথা শুনেছি, আর সংসদের ভেতরে শুনেছি সাংসদদের খিস্তিখেউড়। সাংসদদের আরও কিছু বিরক্তিকর কীর্তি আছে- বরাদ্দকৃত দুই মিনিটের বক্তব্যে পৌনে দুই মিনিট দলীয় শীর্ষ নেতার গুণগান করেন, দলীয় নেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অভিধান থেকে বেছে বেছে উপযোগী বিশেষণগুলো প্রয়োগ করেন; কিন্তু দলীয় শীর্ষ নেতা সংসদে না থাকলে জনগণের কথা বলার ক্ষেত্রেও তাদের কোনো আগ্রহ থাকে না। এমন সংসদের জন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের আগ্রহ আকাশচুম্বী হলেও জনগণ ত্যক্ত-বিরক্ত।

যে গণতন্ত্রে সরকারদলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ভালো-মন্দ সব আইনসম্মত করা সম্ভব হয় সেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার নেই, সুষ্ঠু নির্বাচন অপরিহার্য নয়। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনার ব্যাপারে সোচ্চার; কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বা গণতান্ত্রিক আচরণে সরকারকে বাধ্য করতে পারে না। জনবিরোধী আইন করে গণবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণও কিন্তু একদিনের গণতন্ত্র উপভোগ করার সুযোগ পায়, ভোট দিতে পারে; কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে রাজা-বাদশাহর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে যেমন কথা বলে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না, তেমনি বাংলাদেশেও নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে খাঁচার বাইরে থাকা যায় না।

রাজা-বাদশাহর বিরুদ্ধে কথা বললে সাংবাদিক খাসোগীর মতো করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়, আর বাংলাদেশে হয় হামলা-মামলা, রিমান্ড, গুম, হত্যা, মব লিঞ্চিং ইত্যাদি। সবই হয় গণতন্ত্রের নিয়মকানুন মেনে, সব হয় নির্বাচিত সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। তাই মনে হয় সরকারের কিছু অপকর্মকে আইনের ভিত্তি দেয়ার জন্যই নির্বাচন প্রয়োজন। বাংলাদেশে সুশাসনের বড়ই অভাব। ক্ষমতায় গিয়েই বলবে, নতুন দেশ, এত দ্রুত সুশাসন প্রত্যাশিত নয়। বিরোধী দল কিন্তু তা বলে না। চুয়ান্ন বছর বয়সেও কেন বাংলাদেশ এখনো শিশু রয়ে গেল সেই প্রশ্নের উত্তর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছে কখনো পাওয়া যায়নি।

প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এই দেশের জনগণ কখনো দেখেনি, অদূর ভবিষ্যতে দেখবে বলেও মনে হয় না। তারপরও দেশের জনগণ মওলানা ভাসানীর মতো ‘ভোটের বাক্সে লাথি’ মারতে চায় না। কারণ ভোটের আমেজে কখনো কখনো ভোটারদেরও প্রপ্তিযোগ হয়- কথাটি প্রধান উপদেষ্টাও বলেছেন। আওয়ামী লীগ কার্যত নিষিদ্ধ, যদিও আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা একেবারেই ‘সাময়িক’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা; কিন্তু আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেয়া হবে বলে মনে হয় না। ফলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথিত ‘এক পরিবার’ আর গড়ে উঠল না, এতে ভবিষ্যতের জন্য একটা বিষফোড়ার জন্ম হলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবী থেকে ইংরেজ জাতি তাদের কলোনিগুলোকে স্বাধীনতা প্রদান করলেও প্রতিটি কলোনিতে এক বা একাধিক বিষফোড়া রেখে গেছে, সেই বিষফোড়ার বিষে আজও প্রতিটি দেশ জাতিগত সংঘাতে মারামারি করছে, এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীর সঙ্গে করছে যুদ্ধ। এক পরিবার গড়তে না পারার ব্যর্থতায় যে বিষফোড়ার জন্ম হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আজ না হোক আগামীকাল যে একটি বিস্ফোরণ ঘটাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কথাটি শুধু আমাদের নয়, ১২৫ বছরের পুরোনো পত্রিকা ‘জাপান টাইমসেরও’। পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য ডন’ও বলেছে, ‘আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধের বিষয়টি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।’

কোনো সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন হচ্ছে তাহলে এই নির্বাচন কীভাবে স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব প্রতিরোধ করবে? আমরা যে নির্বাচন কমিশন দেখছি তা তো পুরোনো কাঠামোতে নতুন লোকের সমাবেশ মাত্র। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু মৌলিক সংস্কার ব্যতিরেকে আসন্ন নির্বাচন অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। স্রেফ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের জন্য গণঅভ্যুত্থান হয়নি, অভ্যুত্থান হয়েছে দেশের ঘুণেধরা মনমানসিকতায় পরিবর্তন এনে বাংলাদেশকে বৈষম্যহীন, মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার বৃহত্তর প্রেষণায়; কিন্তু একটি বছর কেটে গেল শুধু ‘আওয়ামী ফোবিয়া’ আর অপ্রয়োজনীয় বাগবিতণ্ডায়। আগের ধারায় নির্বাচন হলে ‘জুলাই বিপ্লবের চেতনা’ও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ