Views Bangladesh Logo

ডাকসু নির্বাচনে কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতিত্ব কেন?

ডাকসু নির্বাচন কেবল বহু প্রত্যাশিত শুধু নয়, এটার ভেতর দিয়ে মানুষের প্রত্যাশার পাশাপাশি আকাঙ্ক্ষাটা ছিল বিশাল। এতদিন নির্বাচনকে একটা প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রত্যেক বছর ফি নেয়া হতো, কিন্তু নির্বাচিত ছাত্র সংসদ থাকত না। দীর্ঘ বছর পর ২০১৯ সালে ডাকসুর নির্বাচন হয়েছিল। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সত্তরের দশকে একবার নির্বাচন হয়েছে, এরপর আর হয়নি। এরকম একটা অবস্থা থেকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শিক্ষার পরিবেশ এবং রাজনীতির ক্ষেত্রেও একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশে যেতে পারব- এটিই ছিল আমাদের প্রত্যাশা। একটা সুন্দর নির্বাচন সবাই চেয়েছিল।

কিন্তু একটা আশঙ্কা ছিল, ছাত্ররা হয়তো ভোট দিতে আসবে না। এটা খুব অবাক লাগল, তারিখটা এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল, যেদিন সব সেমিস্টার পরীক্ষার চূড়ান্ত দিন। যখন সবাই লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকবে, তাহলে নির্বাচনের উৎসবমুখর ক্যাম্পেইনটা করবে কখন? পরীক্ষা নিয়েই সবাই ব্যস্ত, তাই  ছুটিই দিয়ে দিল। আগে-পিছে লম্বা ছুটি। যারা বাড়িতে বহুদিন যেতে পারেন না, স্বাভাবিকভাবে তারা বলল, ঠিক আছে এখন হলত্যাগ করে ছুটি কাটিয়ে আসি।

টার্নআউটের প্রথম দিকেই একটা চেষ্টা ছিল যে, বেশি ছাত্রছাত্রী যেন ভোট দিতে না আসে। অধিকন্তু; পোলিং এজেন্টগুলো বা সেন্টারগুলো করা হলো ভোটারের অনুপাতে খুবই কম। অঙ্কে হিসাব করে দেখা গেছে, সবাই যদি ভোট দিতে আসে তাহলে মধ্যরাত পার হয়ে যাবে, কিন্তু ভোটগ্রহণ শেষ হবে না। ভোটগ্রহণ তো ৪টা পর্যন্ত। তারপরে তো আর ভোটগ্রহণ হবে না।

সুতরাং এসবের পেছনে কোনো চক্র কাজ করেছে কী না, সেটা প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল। তারপরে দেখা গেলো, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষকমণ্ডলী প্রক্টর থেকে শুরু করে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে যারা নতুন করে চাকরিতে আসলেন, সেটা একটা চ্যানেল ধরে আসলেন। সুপারিশের মাধ্যমে একটা চিহ্নিত মতাদর্শের লোক, যাদের রাজনৈতিক শক্তির পরিচয় জানা আছে, তারা বিরাট সংখ্যায় সেখানে চলে এলো।

তার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখতে পেলাম এবং এটা আমরা সকলেই জানি, যে-শক্তির কথা আমি ইঙ্গিত করছি, তারা ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশ করায় অভ্যস্ত।  শিবিরের নেতারাই কিন্তু আত্মস্বীকৃতভাবে বলেছে যে, আমরা ওই সময় এত লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ছাত্র লীগের কমিটিতে ঢুকেছিলাম। আমি হুন্ডাবাহিনীর সদস্য হিসেবে সেখানে ভূমিকা পালন করেছি। তারা তো এই কৌশল গ্রহণ করতে অভ্যস্ত।

সুতরাং কিছু কিছু ঘটনা হয়তো আমরা জানতে পেরেছি বা সবাই বুঝতে পেরেছি। অনেকে হয়তো পরিচয় গোপন করে ছদ্মবেশে জামায়াত-শিবিরের ক্রীড়নক এবং তাদের ঘৃণার পরিকল্পনায় কার্যকর করার ভূমিকায় একেকজন হয়তো ডেপুটেট ছিল। সুতরাং শুরু থেকেই এ ধরনের কতগুলো ব্যত্যয় আমরা দেখেছি, যেটা আমাদের ভেতরে সংশয় তৈরি করেছিল যে স্বাভাবিক নির্বাচন হবে কি না। 

নির্বাচনের দিন একটা বিশৃঙ্খলা হবে যতটা আশঙ্কা ছিল , ছাত্র-ছাত্রীরা আসবে না, কিন্তু তাদের আশানুরূপ সাড়া পাওয়া গেল। কতজন এসেছে, কতজন ভোট দিয়েছে, আমাদের যেটা বলা হচ্ছে- আমরা সেভাবে জানছি। অতীতে, জিয়াউর রহমানের সময় হ্যাঁ- না হয়েছিল, ঘোষণা দেওয়া হলো ৯৮ শতাংশ মানুষ হ্যাঁ ভোট দিয়েছে। এসবের কারণে তো মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল ভোটব্যবস্থার ওপর থেকে। সেই বিশ্বাসটা ফেরত আনার দরকার ছিল। তারপরেও কোনো মেজর ইনসিডেন্ট  ছাড়া,  দুপুরের পর কিছু মাইনর ইনসিডেন্ট হয়েছে। দুপুরের আগে হয়তো অতটা হয়নি।

ডাকসুতে দুপুরের পর থেকে ওকে আটকায় একে যেতে দেয়। এই দলের নেতাকে যেতে দিচ্ছে আরেক দলের নেতাকে যেতে দিচ্ছেন না এসব হয়েছে। ভাবটা এরকম- তুমি বহিরাগত আর এরা হলো আসল, এরা আমার আত্মীয়র লোক। অর্থাৎ, এখানে শুরু থেকে দেখা গিয়েছিল কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতিত্বের কিছু লক্ষণ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এগুলো টিকবে না যদি সাধারণ ছাত্রছাত্রী দলবেঁধে তাদের অধিকার প্রয়োগ করে। অনেকটা সেরকম পরিস্থিতি ঘটেছে।

কিন্তু সন্দেহ-সংশয় বেড়ে গেল আরেকটি জায়গায়। কারণ নির্বাচন তো ভোট কাস্টিংয়ের পরে শেষ হয় না। আসল তো হলো ভোট গুনে কি ফলাফল, তা দেখা। সেখানে বড় বড় অভিযোগ এসেছে। এক হলো, ভোটিংয়ের সময় ব্যালট পেপারে আগে থেকে টিক মার্ক দেওয়া বা ক্রস চিহ্ন দেওয়া। এটা তো একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। যদিও সেই ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটা দিয়ে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে, এরকম ঘটনা হচ্ছে। হয়তো বলবে এটা একটা ঘটনা; কিন্তু না, একটা ঘটনা ধরা পড়েছে, আর ধরা পড়ে নাই এরকম যে হাজারটা ঘটনা হয় নাই- এটার নিশ্চয়তা কোথায়? একটাই-বা হবে কেন? একটা যেহেতু হতে পারে এরকম হাজারটা ঘটনাও হতে পারে। সেটা মনিটর করে ব্যবস্থা গ্রহণ করার দরকার ছিল, সেটা হয়নি। তারপর সন্ধ্যার দিকে গণনা শুরু হলো এলইডি-তে ডিসপ্লে হলো।

দেখা গেছে, ক্যামেরায় যে জায়গাটা ফোকাস করা হয়, সেটা ব্লার (ঝাপসা) করা। আবছা আবছা। পুরা দৃশ্য দেখা যায় না। বড় দাগে ব্যত্যয় হলে সেটা হয়তো দেখা সম্ভব না; কিন্তু কাগজে কী লেখা হচ্ছে, ওই ব্যালট পেপারে কী ছিল আপনি তো সেটা অনুসন্ধান করতে পারবেন না। ব্যালট কাউন্টিং নিয়ে যতদূর আমি শুনেছি, সেটা হলো ভিজ্যুয়াল, চোখে দেখে দাগ দেয়া, যাকে টেলি মার্ক বলে ১, ২, ৩, ৪, ৫- এরকম। শুনেছি, ব্যালট পেপারটা স্ক্যানিং করে স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে অটোমেটিক মেশিন নির্ধারণ করেছে ক্রস চিহ্নটা কত নাম্বারে দেওয়া হয়েছে। এখন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নিয়ে একটা কন্ট্রোভার্সি (বিতর্ক) ছিল। দেখুন, ইলেকশন কমিশনও আমাদেরকে দশ-বারো বার ওখানে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে ডিসপ্লে করে দেখিয়েছে যে, কোনোভাবেই এটাকে হ্যাকিং করা বা অন্য কোনোভাবে ইন্টারভিন (হস্তক্ষেপ) করা যায় না। এক্সাক্ট (সঠিক) রেজাল্ট দিবে। এবার আমরা জানলামও না, ছাত্ররা জানলও না, ক্যান্ডিডেটদেরও জানানো হলো না এবং তাদের না জানিয়ে এই জিনিসটা করা হলো যে, এটার ভেতরে কোনো কারচুপির সুযোগ নেই। সুতরাং সন্দেহের পরিমাণ কিন্তু বেড়ে গেল।

ফেসবুকে দেখলাম (জানি না আজকাল তো মিথ্যা খবরও ছড়িয়ে যায়) দুইটা হলের ভোটে একই ব্যক্তি, এই হলে যে পরিমাণ ভোট পেয়েছে ওই হলেও ঠিক একই পরিমাণ ভোট। দুই নাম্বার তিন নাম্বার হলে একই পরিমাণ ভোট- এটা বেশ আশ্চর্যজনক। সায়েন্স, পরিসংখ্যান এবং প্রভাবলিটি থিওরিতেও অসম্ভব ব্যাপার যে, দুইটা সেপারেট জায়গায় যেখানে একেবারেই ভিন্ন ভোটাররা ভোট দিচ্ছে-২৪১ এখানে ওখানেও ২৪১। মনে হয় কোনো কাগজে লেখা ছিল সেই অনুযায়ী এটা হয়েছে। সুতরাং যুক্তিসঙ্গতভাবে অধিকাংশ বলবো না, প্রায় সব প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের বাইরে যারা আছে, তারা এ রেজাল্টকে রিজেক্ট করেছে এবং নতুন করে গণনার ব্যবস্থা কিংবা নতুন করে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা তারা চাচ্ছে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: রাজনীতিবিদ ও ডাকসুর সাবেক ভিপি।
অনুলিখন: শাহাদাত হোসেন তৌহিদ

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ