গণপরিবহনে নারী-শিশু নির্যাতন কেন প্রতিকারহীন?
যানবাহনে চলাচল করলে পরিবহন কর্তৃপক্ষ যাত্রীকে যে টিকিট দেয়, সেখানে প্রায়শই লেখা থাকে ‘আপনার ভ্রমণ নিরাপদ হোক’; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে যানবাহন ভ্রমণের ক্ষেত্রে যাত্রী কতটা নিরাপদ। বিশেষ করে নারী যাত্রী হয়রানির পাশাপাশি যে বিষয়টি এখন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হচ্ছে গণপরিবহনে নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ প্রসঙ্গটি। বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের এবং নারী ক্ষমতায়নের জন্য বড় প্রতিবন্ধক।
ব্র্যাকের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারাই যৌন হয়রানির শিকার হন বেশির ভাগ নারী, এর হার ৬৬ শতাংশ। নারীদের যৌন হয়রানির মূল কারণ হচ্ছে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলোর অভাব ইত্যাদি।
আমরা জানি, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা। এসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় যেমন অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন, তেমনি অনেককে বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্বের অভিশাপ। সড়কে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলোর পাশাপাশি ঘটে চলেছে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা হলেও গণপরিবহনে নারীর নিপীড়িত-নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়টি খুব কম গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই, গণপরিবহনে নির্যাতিত এসব নারী ও কন্যাশিশুরা পরবর্তী জীবনে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগেন। বিষয়টি অগ্রগতির পথে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। যার বিরূপ ফল সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকারি ও বেসরকারিভাবে সড়কে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা কমাতে নানা পর্যায় থেকে বিভিন্ন দাবি-পরামর্শ উপস্থাপিত হলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে গণপরিবহনে চলাফেরায় নারীর প্রতি সহিংসতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি। তা ছাড়া নারী ও কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতন-সহিংসতা কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। আবার অপরাধীর সঙ্গে ক্ষমতাবানদের সখ্য হওয়ার কারণে নির্যাতিতের পরিবার সঠিক বিচার পায় না! কখনো কখনো নির্যাতক কোনো কোনো রাজনীতিকের আশীর্বাদও পেয়ে থাকেন।
আমাদের কথা হচ্ছে, নারী ও কন্যাশিশুর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন বন্ধে দেশে ইতিবাচক আইন ও নীতিমালাও আছে; কিন্তু যথাযথ আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতার অভাবে এখনো দেশে শিশু নির্যাতনের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। তাই নানা ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতি সত্ত্বেও নারীর প্রতি এ ধরনের মনোভাব এখনো পিছিয়ে পড়া সমাজের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বোধ করি এ কারণে, ১৮৬৮ সালে কার্ল মার্ক্স লিডউইক কুগেলম্যানকে লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন, ‘ইতিহাস সম্পর্কে যার কোনো ধারণা আছে তিনিই জানেন যে নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো বড় সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
তাই আমরা বলতে চাই, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নারীবান্ধব যানবাহন, চালক ও সহকারী থাকতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে যাত্রীদের মানসিকতায়ও। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সড়কে নারীর নিরাপত্তার জন্য প্রশিক্ষিত চালকের অভাব একটি বড় সমস্যা। নারীবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা গড়তে ও পেশাগত নারী গাড়িচালক তৈরির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি নারী গাড়িচালক প্রশিক্ষিত করার ক্ষেত্রেও নজর দিতে হবে। পাশাপাশি গণপরিবহনে নারী-শিশু নির্যাতনে প্রতিকারহীন ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা গণপরিবহনে নারীর যাত্রা নিরাপদ হোক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে