ভবিষ্যৎ রাজনীতি কাদের হাতে?
‘বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে, তারা অন্তর্গতভাবেই অগণতান্ত্রিক এবং এখানে শাসকশ্রেণির পড়ালেখা ও বিদ্যাশিক্ষার মান অত্যন্ত নিম্ন।’ ইংরেজি দৈনিক নিউএজের সম্পাদক নুরুল কবির যেদিন এই বক্তব্য দেন, তার ঠিক আগের দিন দেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে (শেখ হাসিনা) মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। প্রয়াত রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে নুরুল কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় তা কখনো ছিল না।’
এই অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বক্তব্য রাখেন। মওদুদ আহমদের সঙ্গে তার জেলখানার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, তিনি দেখতেন প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন মওদুদ আহমদ। তারপর ঢুকে যেতেন লাইব্রেরিতে। সারাক্ষণ সেখানে বসে লিখতেন। শুধু খাওয়ার সময় বের হতেন।
এ প্রসঙ্গে নুরুল কবীর বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ও মওদুদ আহমদের উপস্থিতিতে একবার এক অনুষ্ঠানে তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন, মওদুদ আহমদকে মাঝেমধ্যে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয়া দরকার। কারণ উনি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে যত বই লিখেছেন, তার অধিকাংশই জেলখানায় বসে।
প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য ৩৪ সদস্যের যে কমিটি করা হয়, তার মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন আইনের ছাত্র (ব্যারিস্টার/এলএলবি/বি.এল)। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, একজন পদার্থ বিজ্ঞান, একজন বাংলা এবং একজন ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। একজন স্নাতক। দুজন সাধারণ বি.এ পাস। একজনের বিএসসি অসম্পূর্ণ। একজন চিকিৎসক। আবার যারা আইনে পড়েছেন তাদের অনেকেরই অন্য বিষয়েও ডিগ্রি ছিল। অর্থাৎ অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর হওয়ার পরে আইনে পড়াশোনা করেছেন। রাজনীতি করতে গেলে আইন পড়তে হয়—এরকম একটি ধারণা, বিশ্বাস ও রেওয়াজ তখন ছিল। (আমীন আল রশীদ, সংবিধান প্রণেতাগণ, শিলালিপি/২০২৪, পৃ. ৩৩)।
কিন্তু এর পরবর্তী বছরগুলোয় যারা বাংলাদেশের আইনপ্রণেতা হয়েছেন, তাদের অনেকের পড়ালেখা ও বিদ্যাচর্চার মান নিয়ে নুরুল কবীর যা বলেছেন, সেটিই ধ্রুব। সেই আইনপ্রণেতাদের ভিড়ে মওদুদ আহমদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামরা বিরল।
বাংলাদেশের মানুষকে এমন সংসদ সদস্যও দেখতে হয়েছে, যারা সংসদে দাঁড়িয়ে কাগজে লেখা কোনো বক্তৃতা পড়তে গিয়ে বারবার জড়িয়ে যাচ্ছেন। এমন অনেক সংসদ সদস্যকে এই দেশের মানুষকে হজম করতে হয়েছে বা দেশের মানুষই এমন সব মানুষকে তাদের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ জনপ্রতিনিধি তথা আইনপ্রণেতা হিসেবে নির্বাচিত করেছে, সংসদে যাদের বক্তৃতার মধ্যে প্রয়াত জাতীয় নেতা এবং প্রধানমন্ত্রীর স্তূতি ছাড়া আর তেমন কিছু পাওয়া যেতো না। যে কারণে বারবারই এই প্রশ্ন উঠেছে যে, দেশের রাজনীতি কাদের হাতে এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতি কাদের হাতে যাবে?
যে তরুণদের বলা হয় আগামী দিনের কাণ্ডারি, সেই তরুণদের মধ্যে কতজন সত্যিই আগামী দিনে একটি সুন্দর, গণতান্ত্রিক, সহনশীল, সৃষ্টিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারবে—এই প্রশ্নটি জুলাই অভ্যুত্থানের পরে অনেক বেশি সামনে আসছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শুরু থেকেই এখানে ‘গণতন্ত্র অনুপস্থিত’ বলে জনাব নুরুল কবীর যে আক্ষেপ করলেন, সেই আক্ষেপ ঘোচাতে এই সময়ের তরুণরা কতটা প্রস্তুত—এই প্রশ্নেরও নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে বরাবরই একটা শব্দ ব্যবহার করা হয়। সেটি হলো ‘বস্তপঁচা’। প্রশ্ন হলো, এই বস্তাপঁচা, দুর্গন্ধময় আর অগণতান্ত্রিক রাজনীতি দূরে ফেলে আগামী দিনে একটি সুন্দর, সুগন্ধিময় ও গণতান্ত্রিক দেশ কারা নির্মাণ করবে?
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পরে যে শব্দগুলো সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তার একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’। নতুন বাংলাদেশে নিশ্চয়ই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ হবে। কিন্তু তার কি কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে?
অভ্যুত্থানের পরে বিভিন্ন মিছিলে স্লোগানের নামে যে অশ্লীল বাক্য ও শব্দের প্রয়োগ করেছেন তরুণরা, সেটি নতুন রাজনীতি তো বটেই, জনরুচির প্রশ্নেও প্রশ্নবিদ্ধ। এইসব স্লোগানকে রাগ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে যুক্তি দেয়া হয়। প্রশ্ন ওঠে, নতুন বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বা তরুণদের রাজনীতির ভাষা কি এভাবেই নির্মিত হবে?
টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকায় শেখ হাসিনার আমলে দেশের অবকাঠামোয় অভাবনীয় উন্নয়ন হলেও দুর্নীতির লাগাম টানতে না পারা, প্রশাসনে নির্লজ্জ দলীয়করণ, রাষ্ট্রকে একটি পরিবার লিমিটেড কোম্পানি বানিয়ে ফেলাসহ আরও অনেক সুনির্দিষ্ট কারণে তার পতন হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তার পতনের পরে যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে গেছেন; যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন—তারা কি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের চেয়ে উত্তম রাজনীতি উপহার দিতে পারছেন?
গত বছরের ৫ আগস্টের পরে দেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার যে ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে, সেটি কি বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে কোনো একটি সময়ের সঙ্গে তুলনীয়? গত এক বছর ধরে দেশে যে ভয়াবহ মবসন্ত্রাস হয়েছে বা এখনও হচ্ছে, সেটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোনো দুর্বল গণতন্ত্রের দেশেও এর উদাহরণ পাওয়া যাবে? কারা এসবরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তা সবার জানা।
যারা নতুন বাংলাদেশ ও সংস্কারের কথা বলছেন, তাদেরই একটি অংশ বুলেডোজার নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। আগুন দিয়েছেন। নতুন বাংলাদেশের স্লোগান দেয়া তরুণদের একটি অংশই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তাতে প্রস্রাব করার মতো ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে অবমাননার শব্দ বলছেন। অথচ জুলাই অভ্যুত্থানটি ছিল শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে—যে আন্দোলনটি গড়ে উঠেছিলো সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের মতো একটি ছোট্ট ইস্যুতে। কিন্তু অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার পতনের পরে মনে হয়েছে, দেশের একটি বিরাট অংশের মানুষের রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা বঙ্গবন্ধুর ওপরে।
এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে তাদের দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত করেছিল এবং স্তূতি করতে করতে তাকে অতিমানব করে তুলেছিল। কিন্তু এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের দায় কতটুকু—তারও নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
যুক্তি যতই থাকুক, আওয়ামী লীগ নষ্ট রাজনীতি করেছিল বলেই যদি তার পতন হয়ে থাকে, তাহলে এখনও তার পুনরাবৃত্তি কেন হবে? আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপি-জামায়াতের কতজন লোকের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছিল আর গত এক বছরে আওয়ামী লীগের কত শত নেতার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে?
দুর্নীতি ও লুটপাটতন্ত্রের ভিড়ে হাতেগোণা যে কয়জন মানুষকে নিয়ে বিতর্ক কম, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও স্পিকার আব্দুল হামিদের বাড়িতেও হামলা ও ভাঙচুর এবং তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা কি নতুন রাজনীতির পরিচয় বহন করে?
আওয়ামী লীগ যদি নষ্ট রাজনীতি করে থাকে, তাহলে এখন শুদ্ধ রাজনীতির উদ্বোধন হবে কাদের হাতে? যাদের হাতে এখন ক্ষমতা—তারা কি আওয়ামী লীগের চেয়ে উত্তম রাজনীতি করছে বা তারা কি সত্যিই প্রতিহিংসা ও ঘৃণামুক্ত রাজনীতি করতে চায়? চায় না। বরং তারা স্পষ্টতই নির্মূলের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ যেমন বহু বছর ধরে বিএনপি ও জামায়াতকে রাজনীতি থেকে নির্মূল করে দিতে চেয়েছে, এখন ঠিক একই ঘটনা ঘটছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তাহলে পরিবর্তনের সূচনাটা কে করবে?
যারা কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর বিষোদ্গার করে; মুক্তিযুদ্ধের নতুন বয়ান দিয়ে বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে; মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় চিহ্নিত দোসরদের বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়; যারা ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানকে মুজিববাদী সংবিধান আখ্যা দিয়ে তার কবর রচনা করতে চায়, ছুড়ে ফেলতে চায়—তাদের কাছে নতুন বাংলাদেশ মানে কী?
আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার পতনের পরে তাদের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে একটা ‘ইনক্লুসিভ সোসাইটি’ বিনির্মাণের পথ উন্মুক্ত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তা হয়নি। বরং গত বছরের ৫ আগস্টের পরে হরেদরে ফ্যাসিস্ট তকমা দিয়ে যাকেতাকে হেনস্থা করা হচ্ছে। বিরুদ্ধ মতের হলেই আগে যেমন জঙ্গি ও জামায়াত শিবির ট্যাগ দেয়া হতো, এখন ঠিক তার উল্টো আওয়ামী লীগের দোসর ও ফ্যাসিস্ট ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। শুধু রাজনৈতিক কর্মী নয়, অসংখ্য শিক্ষক তাদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। অপমানিত হয়েছে। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এখনও ঠিকতো ক্লাসে যেতে পারেন না বা একধরনের আত্মগোপনে আছেন বা নিজেকে আড়াল করে রাখছেন বলে শোনা যায়। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে এর আগে এরকম ভয়ানক পরিস্থিতি কখনো তৈরি হয়নি। সুতরাং, যে তরুণ শিক্ষার্থী তার পিতৃতুল্য শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মতের কারণে, সেই তরুণদের হাতে বাংলাদেশ কতটা নিরাপদ—এটি খুব মামুলি প্রশ্ন। ভিন্নমতকে সহ্য করতে না পারা মানুষেরা কী করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবেন?
ফ্যাসিস্ট হটিয়ে তারা নিজেরাই যদি আরও বড় ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেন, তাহলে নতুন বাংলাদেশ তো নয়ই, বরং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে পদ্ধতিটা গড়ে উঠবে, তার নাম ‘নিও ফ্যাসিজম’।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে