বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দায় কে নেবে
বাংলাদেশের চব্বিশের রক্তাক্ত জুলাইয়ে নিহত শিশুদের চেহারা আমরা ভুলতে পারি না। সেই জুলাইয়ের স্মরণ চলাকালে আরেক জুলাইয়ে এসে আবারও আমাদের শিশুরা লাশ হলো। আগের জুলাইয়ে ঘাতকের গুলিতে আর এবার বিমানবাহিনীর এক প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায়। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানটি আছড়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে যেভাবে আগুনে পুড়ে যাওয়া বাচ্চাদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল, তা দেখে যে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের চিন্তা অবশ হয়ে যাওয়ারই কথা। আর যারা সন্তানের মা-বাবা, তাদের মানসিক বিপর্যস্ততার কথা তো বাদই দিলাম। এরপর তো একের পর এক পুড়ে যাওয়া শিশুর ছবি-ভিডিওতে শিশুর খোঁজ পেতে মা-বাবাদের আহাজারি, হাসপাতালে আহত শিশু নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন- যেন পৃথিবীর কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, এমন বেদনাদায়ক দৃশ্য একের পর এক হাজির হতে থাকে আমাদের সামনে।
কেউ বাচ্চার খোঁজ পেতে শিশুর ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন, আবার কেউ হাসপাতাল থেকে শিশুর অভিভাবকের খোঁজ পেতে তার স্কুল আইডির ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন। আর রক্তের জন্য গোটা ঢাকাবাসী যেন পারলে ছুটে যায় উত্তরার সব হাসপাতাল থেকে শুরু করে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার অল্প মুহূর্তের মধ্যে মানুষের ঢল নামে। উদ্ধার কার্যক্রমে যুক্ত মানুষের চেয়েও উৎসুক মানুষের ভিড় বেশি। কে কত কাছ থেকে ছবি ও ভিডিও তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিতে পারবে, সেই প্রতিযোগিতাও যেন দেখা যায়। দেখা গেছে, অন্য যে কোনো ঘটনার চেয়ে আজকে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে হেলিকপ্টারে করে সেনাবাহিনীর টিমসহ অন্যান্য উদ্ধার সহায়তা দল ঘটনাস্থলে হাজির হতে সক্ষম হয়েছে। দ্রুত বিধ্বস্ত বিমান ও ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের আগুন নেভানোও সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু হতাহতদের উদ্ধার থেকে শুরু করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে চরম বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছে উদ্ধারকারীদের। ঘটনাস্থল থেকেই বিষয়টি বারবার বলা হচ্ছিল। অতিরিক্ত মানুষের কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে; কিন্তু কে শোনে কার কথা! সময় যত যায়, ততই যেন মানুষের ঢল বেড়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট পর্যন্ত মানুষের ভিড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে এখানের ভিড় প্রধানত রক্ত দিতে ছুটে আসা মানুষের। এরপরও মানুষের ভিড়ের কারণে হাসপাতালে আসা-যাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্সের গতি কমে গেছে। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে ভিড় সামলাতে কাজ করছেন অনেক স্বেচ্ছাসেবী।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড, সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণ, মগবাজার বিস্ফোরণের মতো একের পর এক বড় বড় দুর্ঘটনা সামাল দিয়েছেন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক- স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকেরা। এর আগে চুড়িহাট্টা, নিমতলী, রানা প্লাজার মতো আরও বড় বড় ট্র্যাজেডি সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা তো আছেই। গতকাল দুপুর পার হতেই জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স এসে থামে। স্ট্রেচারে করে নামানো হয় দগ্ধ শিশু-কিশোরদের। অ্যাম্বুলেন্স থামলেই অভিভাবকরা সন্তানকে খুঁজে পাওয়ার আকুতি নিয়ে ছুটে যান। কেউ কেউ আশঙ্কাজনক অবস্থায় সন্তানকে দেখে জ্ঞান হারান। আবার নিজের সন্তানকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। চিকিৎসকরা জানান, পোড়া রোগীদের জন্য প্রচুর রক্তের দরকার হয়। পজিটিভ রক্ত পাওয়া গেলেও নেগেটিভ রক্তের ঘাটতি রয়েছে। নেগেটিভ রক্ত দেওয়ার জন্য তারা আহ্বান জানান। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান জানিয়েছেন, বার্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রায় সবাই স্কুলের শিক্ষার্থী। তাদের সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত অনেকেই বলছেন, একের পর এক আহত ও নিহতদের স্কুল থেকে বের করা হচ্ছে। আর প্রিয় সন্তানকে খুঁজে পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন তাদের বাবা-মা। স্কুলের বাইরে দিয়াবাড়ী গোল চত্বরে হাজার হাজার উৎসুক জনতার ভিড়। তাদের সামলাতে কাজ করছিল সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও স্বেচ্ছাসেবীরা। প্রিয় সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে অনেককেই সেখানে গগণবিদারী আহাজারি করতে দেখা গেছে। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমানবাহিনীর বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে বড় একটি ট্র্যাজেডি। এত বড় ট্রাজিক ঘটনা, বিয়োগান্তক ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে আর ঘটে নাই। গতকাল বিকালে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দুর্ঘটনায় হতাহতদের দেখতে গিয়ে গণমাধ্যমের কাছে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. আসিফ নজরুল আরও বলেন, জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওনারা চিকিৎসার প্রয়োজনে যত রকম প্রস্তুতি দরকার তা সম্পন্ন করেছেন। তার পরও যদি প্রয়োজন হয়, বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনবেন। বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আমাদের শিক্ষার্থীদের বিদেশ নেওয়ার প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা করা হবে। কোনো কিছুতেই কোনো ঘাটতি থাকবে না। পুরো রাষ্ট্র শোকাহত জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, আজ যা হারিয়েছি, কোনো কিছুর বিনিময়ে সেটা পূরণ করার মতো নয়। এ শোক ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় শোক জানিয়ে ভিডিওবার্তা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে দুর্ঘটনা-প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এই কচি শিশুদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল, আগুনে পুড়ে মরল। তাদের মা-বাবাদের আমরা কী জবাব দেব, কী বলব তাদেরকে?
আমরা নিজেদেরকেই তো জবাব দিতে পারছি না। অজানা শিশুদের মুখ চোখে ভেসে উঠছে।’ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এ ঘটনায় সারা জাতি হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। শোকাহত বললে খুব কম বলা হবে।এ দুর্ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি। এখনো হাসপাতালে লাশ আসছে, কেউ হাসপাতালে মারা যাচ্ছে। মা-বাবা এখনো খোঁজ নিচ্ছে- ‘আমার সন্তান কোথায়। তাদের আর চেনা যাবে কিনা। যাদের লাশ দেখছি তাদের মধ্যে আমার সন্তান আছে কি না’। তিনি বলেন, ‘এদের কাউকে পৃথক করার তো কোনো উপায় নেই। এরা সবাই আমাদের সন্তান। হঠাৎ করেই তারা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমরা অবশ্যই তদন্ত করব, কিন্তু তদন্ত করলে তো আর তারা ফিরে আসবে না। আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আহত-নিহতদের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে আমাদের সহানুভূতি জানাচ্ছি, সান্ত্বনা জানাচ্ছি। আমরা তাদের জন্য শোক দিবস ঘোষণা করেছি।আগামীকাল মঙ্গলবার শোক দিবস।
আমরা সবাই মিলে তাদের কথা স্মরণ করব। নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করব, রুহের মাগফিরাত কামনা করব। যদিও হতাহতের সংখ্যা এড়াতে পাইলট বিমানটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। সংস্থাটি জানায়, দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে উক্ত বিমানের বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের দোতালা একটি ভবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ঢাকা থেকে মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের সীমান্তঘেঁষে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সমীক্ষাও করা হয়েছে। এক লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের বিমানবন্দরের ড্রয়িং-ডিজাইন ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকা। তবে একযুগ পরও বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা এখনো হিমঘরে। পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকার একটি স্কুলে আছড়ে পড়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। তারপর কোমলমতি শিশুদের মৃত্যু আর আহতদের দগ্ধ শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা। প্রিয়তম সন্তান হারিয়ে স্বজনদের আহাজারি। দেশ শোকে মুহ্যমান।
এই শোকের মধ্যেই জনবহুল এলাকায় বিমানের পাইলট প্রশিক্ষণ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমানের প্রশিক্ষণ বন্ধের দাবি উঠেছে। সেইসঙ্গে ঢাকার মতো জনবহুল এলাকা থেকে বিমানবন্দর অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শতকোটি টাকা খরচ করার পরও ঢাকার বাইরে বিমানবন্দর সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ এখনো হিমঘরে। পাইলট প্রশিক্ষণ কোথায় হবে, সে প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রটোকলগুলোতে বলা হয়েছে- জনবহুল বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিচালিত কার্যক্রমে ব্যক্তি আহত হওয়ার সম্ভাবনা এবং নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই কারণে ঝুঁকি-বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে পাইলটদের প্রশিক্ষণের জন্য গ্রামীণ বা কম জনবসতিপূর্ণ এলাকা, নদী ও চর এলাকা সুপারিশ করা হয়।
এমনকি আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) পরিশিষ্ট ১৪ অনুযায়ী, গ্রামীণ ও জনবিরল এলাকাকে প্রশিক্ষণের জন্য সর্বোত্তম এলাকা হিসেবে বলা হয়েছে। ঢাকার মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমানের প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন হতাহতের স্বজন ও সহপাঠীরা। তারা বলেছেন, পৃথিবীর কোথায়ও এত ঘনবতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ পরিচালনা এবং বিমানবন্দর নেই।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ দূরত্বে বিমানবন্দরসহ এই ধরনের কার্যক্রম থাকে। এখন জনবসতি কম এলাকায় এই প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটা সিলেট-কক্সবাজারসহ ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকায় হতে পারে। বিমানের সব ধরনের প্রশিক্ষণ এবং বিমানবন্দরগুলো ঢাকার বাইরে সরিয়ে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের বিমান বন্দরগুলো হয়েছিল ৬০-৭০ বছর আগে। বিমানবন্দর যে সময় তৈরি হয়, তখন এলাকাগুলো অনেকটাই জনবিরল ছিল। কিন্তু জনবসতি ধীরে ধীরে বেড়ে গেছে। এখন ঝুঁকি বিবেচনা নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বাইরে বিমানবন্দর নির্মাণ করা খুবই প্রয়োজন। ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, দুর্ঘটনার কারণে বিমান ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিধ্বস্ত হলে হতাহতের সংখ্যা মারাত্মক আকার ধারণ করবে, যার প্রমাণ উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে প্রশিক্ষণের বিমান বিধ্বস্ত হওয়া। নানা মহল থেকে এসব প্রশিক্ষণ ঢাকার বাইরে করার দাবি উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে উদ্যোগ নেওয়া।
রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে