Views Bangladesh Logo

বঙ্গভঙ্গের কুশীলব কে?

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চরম প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিনিধি, জর্জ নাথানিয়েল ব্যারন কার্জন অব কেল্লেস্টোন সংক্ষেপে লর্ড কার্জন ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ভাইসরয় রূপে ভারতে আসেন। তার কর্মস্থল-আবাসস্থল রাজধানী কলকাতায়। অতি ধূর্ত এবং চরম বাঙালি বিদ্বেষী কার্জনের বাংলা ও বাঙালিকে চিনতে-বুঝতে বিলম্ব হয়নি। বাঙালিদের প্রখর জাতীয়তাবোধ-দেশপ্রেম এবং সর্বোপরি উপনিবেশিক ইংরেজবিরোধী মনোভাব সহজেই তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় আগ্রসর বাঙালি জাতি ব্রিটিশ শাসন অবসানে ক্রমেই তৎপর হয়ে উঠেছে; এই সত্যটি তার মতো ধূর্ত ব্যক্তির পক্ষে বোঝা কঠিন ছিল না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বাঙালি জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল রূপে নানা পদক্ষেপ কার্জন গ্রহণ করেছিলেন। বাঙালি জাতিকে ধর্মের বিভাজনে দ্বিখণ্ডিত করার অভিপ্রায়ে ১৯০২ সালে বাংলা বিভক্তি অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

পাশাপাশি অবাধ সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আরোপ করেন কঠোর বিধিনিষেধ। রাষ্ট্রীয় গোপন আইনের আওতায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকরা শিক্ষা বিস্তারে যে ভূমিকা নিয়েছিল-সেটা মোটেও উদ্দেশ্যহীন ছিল না, ছিল রাষ্ট্রনীতির স্বার্থে। ভারতীয়দের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত জাতি রূপে গড়ে তোলা তাদের অভিপ্রায় ছিল না। স্থানীয় ভারতীয়দের শিক্ষা প্রদানে একটি কেরানি শ্রেণি গড়ে তোলাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। শাসন ব্যবস্থার সহযোগী রূপে এই কেরানি শ্রেণি গড়ে তুলেছিল উপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারে এবং শাসন ব্যবস্থার তাগিদে। কেননা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিশাল ইংরেজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বহর ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আনয়ন ছিল অসম্ভব। সেই উদ্দেশ্যই মিশনারীদের মাধ্যমে স্থানীয় ভারতীয়দের শিক্ষিত করার অভিপ্রায়ে শাসনকার্যের স্বার্থে কেরানি শ্রেণি গড়ে তুলেছিল।

শিক্ষা বিস্তারের সুযোগে ভারতীয়দের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথ উন্মুক্ত হয়েছিল সত্য, তবে সেটা ব্রিটিশ শাসকদের উদ্দেশ্যমূলক ছিল। সেই সুযোগেই স্থানীয়রা উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পেরেছিল। এই উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে লর্ড কার্জনের নগ্ন হস্তক্ষেপে উচ্চশিক্ষার উন্মুক্ত পথটি বন্ধের অভিপ্রায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেতন বৃদ্ধিসহ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের যাবতীয় কার্যাবলিকে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের অধীনস্থ করেন। ব্রিটিশ শাসনকে নিষ্কণ্টক করার অভিপ্রায়ে নানাবিধ কালাকানুন আরোপ করেন। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রসর বাঙালিদের ওপরই কার্জনের খড়গ হস্তটি সর্বাধিক পরিমাণে প্রসারিত হয়েছিল।

এই শ্রেণিকে সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে স্থায়ীভাবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার অভিপ্রায়ে ব্রিটিশ ভাইসরয়ের পরোক্ষ মদতে ব্রিটিশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত আমলা এ্যালেন অক্টোভিয়ান হিউমের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ১৮৮৫ সালে গঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। সময়ের ব্যবধানে কংগ্রেস দলের লাগাম ব্রিটিশদের হাতবদলে ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কংগ্রেস দলের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ক্ষুব্ধ লর্ড কার্জন কংগ্রেস সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, তার (কার্জনের) সাহায্যের কল্যাণেই এটি (কংগ্রেস) শান্তিপূর্ণ মৃত্যুবরণের পথ খুঁজে পাবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে চরম ব্যঙ্গবিদ্রুপ মন্তব্য করতেও কার্জন দ্বিধা করেননি। কার্জনের নিগ্রহ ও নিপীড়নমূলক নীতির কারণেই ভারতের ব্রিটিশ শাসন অবসানের লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল সশস্ত্র গোপন সমিতি। সশস্ত্র পন্থায় ব্রিটিশদের পরাস্ত করে মাতৃভূমি রক্ষাই ছিল গোপন সমিতির মূল লক্ষ্য।

বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নে লর্ড কার্জন ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব বাংলায় আসেন। ব্রিটিশ শাসনাধীনে পূর্ব বাংলায় আগত ইংরেজ শাসকদের বিভিন্ন প্রদেশে আগমনকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ তখন নিয়মে পরিণত হয়েছিল। কলকাতায় মহারানী ভিক্টোরিয়ার আগমন উপলক্ষে কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে নির্মিত হয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। এই বিশালাকার ব্যয় সাপেক্ষ স্থাপনা নির্মাণে অর্থের জোগান ব্রিটিশ শাসকরা করেনি। স্থানীয় জনগণের ওপর অধিক করের বোঝা চাপিয়ে অর্থ আদায়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নির্মাণ ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছিল। একইভাবে ঢাকায় ১৮৭৪ সালে লর্ড নর্থব্রুকের আগমন উপলক্ষে ব্রিটিশদের পদলেহনকারী ব্যবসায়ী এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশদের দেয়া খেতাবপ্রাপ্ত কাগুজে নবাব আব্দুল গণি কর্তৃক ২,৫০,০০০ টাকা অনুদানে নর্থব্রুক হল নির্মাণ করা হয়েছিল। লর্ড কার্জনের আগমনকে স্মরণীয় রাখার অভিপ্রায়ে ভাওয়ালের রাজকুমার নরেন্দ্র নারায়ণের ১,৫০,০০০ টাকা অনুদানে ঢাকায় নির্মিত হয়েছিল কার্জন হল। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ সালে কার্জন হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বয়ং লর্ড কার্জন। কার্জনের স্থাপিত ভিত্তিপ্রস্তরটি আজও কার্জন হলের মূল প্রবেশদ্বারের বাম পাশের দেয়ালে অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।

ঢাকার সদরঘাট এলাকায় অবস্থিত ট্রেজারিটি তখন ছিল ঢাকা কলেজ। স্থান সংকুলানের অভাবে কলেজের লাইব্রেরিটি কার্জন হলে স্থানান্তরিত করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে কার্জন হল টাউন হল হিসেবে ব্যবহারের জন্যই নির্মাণ করা হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ রদ হবার পর সদরঘাট থেকে কার্জন হলে ঢাকা কলেজকে স্থানান্তরিত করে নতুন নামকরণ করা হয় ঢাকা গভর্নমেন্ট কলেজ। এরপূর্বে কার্জন হল পাবলিক হল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন হয়ে যায়। বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষাক্রম কার্জন হলকেন্দ্রিক পূর্বের ন্যায় আজও বলবৎ রয়েছে।

বঙ্গভঙ্গ মিশন বস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই পূর্ব বাংলায় লর্ড কার্জনের আগমনের ঘটে। কািক্ষত উদ্দেশ্য সাধনে কার্জন ছুটে যান ময়মনসিংহে মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর অতিথি হয়ে। সেখানে মহারাজাকে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব সমর্থনের জন্য অনুরোধ ও চাপ প্রয়োগ করেন। ব্রিটিশ শাসনাধীনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলভোগী স্থানীয় মহারাজা, জমিদার সামন্ত শ্রেণির কেউ স্বয়ং ভাইসরয়ের প্রস্তাব উপেক্ষার ধৃষ্টতা দেখাতে সক্ষম হবে কার্জনের কাছে সেটা ছিল অসম্ভব এবং চিন্তারও অতীত। অথচ মহারাজা সূর্যকান্ত চৌধুরী লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব সরাসরি কার্জনের মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান করে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। 

ময়মনসিংহ গমনের মিশন ব্যর্থ হবার পর কার্জন ঢাকায় ফিরে আসেন এবং নবাব সলিমুল্লাহর অতিথি রূপে আহসান মঞ্জিলে অবস্থান নেন। ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের উপস্থিতিতে আহসান মঞ্জিলে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উসকে বলেন, প্রস্তাবিত আসাম ও পূর্ববাংলা নিয়ে গঠিত নতুন ইস্টার্ন বেঙ্গলের কর্তৃত্ব থাকবে সম্পূর্ণ রূপে মুসলিম সম্প্রদায়ের অধীনে। এখানকার মুসলমানদিগকে আর হিন্দুদের কর্তৃত্বে থাকা কলকাতার মুখাপেক্ষী হতে হবে না। নবাব সলিমুল্লাহকে নতুন প্রদেশ উন্নয়নে সুদমুক্ত দশ হাজার পাউন্ড প্রদানেরও প্রস্তাব দেন। 

নবাব সলিমুল্লাহর তখন আর্থিক টানাপড়েন চলছিল। ওই অর্থ তার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। নবাব সলিমুল্লাহ তাৎক্ষণিক বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন। ময়মনসিংহের অপর জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব একবাক্যে সমর্থন করেন। বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নে কার্জন চরম সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠিত হননি। আকারে-ইঙ্গিতে, অপ্রত্যক্ষে-প্রত্যক্ষে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের হৃদয়ের গভীরে সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করে যান। যে কারণে পূর্ব বাংলার সম্ভ্রান্ত মুসলিম সম্প্রদায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় বঙ্গভঙ্গের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের মিশনকে গতিশীল করে তোলে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে কার্জন বাংলা বিভক্তিতে পূর্ব বাংলা চষে বেড়িয়েছেন। ছুটে গেছেন চট্টগ্রামেও। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ট্রেনে বসে ভারত সচিবকে যে চিঠিটি তিনি লেখেন সেই চিঠিতেই কার্জনের প্রকৃত উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ সালে কার্জনের লিখিত সেই চিঠিটির বঙ্গানুবাদটি এরূপ, “বাঙালিরা, নিজেদের যারা একটি জাতি বলে ভাবতে পছন্দ করে এবং যারা এমন একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যখন ইংরেজদের বিদায় করে দিয়ে কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউজে একজন বাঙালি বাবুকে অধিষ্ঠিত করবে, তারা অবশ্যই তাদের ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নে হস্তক্ষেপ ঘটাতে পারে এমন যে কোনো প্রতিবন্ধকের ব্যাপারে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করবে। আমরা যদি তাদের হইচই এর কাছে নতি স্বীকার করার মতো দুর্বলতা প্রকাশ করি, তাহলে আগামীতে বাংলাকে কখনোই খণ্ডিত বা দুর্বল করতে পারব না এবং ভারতের পূর্ব পার্শ্বে আপনি এমন একটি শক্তিকে সংযুক্ত ও দৃঢ় করবেন যেটি ইতিমধ্যেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং ভবিষ্যতে তা ক্রমবর্ধমান গোলযোগের নিশ্চিত উৎস হয়ে দাঁড়াবে।’

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন দ্রুত দাবানলের ন্যায় কেবল বাংলায় নয়, ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন, ‘এতে বাঙালিরা অপমানিত-অসম্মানিত হচ্ছে এবং তাদের সমগ্র ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়েছে।’ তার মতে বঙ্গভঙ্গ বাংলাভাষী জনগণের বর্তমান ঐক্যের প্রতি সতর্কভাবে পরিকল্পিত আঘাত। নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল লর্ড কার্জন ৭ জুলাই ১৯০৫ সালে সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করেন। কার্জনের সেই ঘোষণা কার্যকর হয় ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ সালে। আগস্ট মাসেই রাজধানী কলকাতাজুড়ে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, বিক্ষোভ, সমাবেশসহ ব্যাপক প্রতিরোধ কর্মসূচি পালিত হয়।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী সমাবেশ থেকে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মধ্যবিত্ত বাঙালি ১৬ অক্টোবর দিনটিকে বঙ্গভঙ্গ দিবসের পাশাপাশি জাতীয় শোক দিবস রূপেও পালন করে। কলকাতার বঙ্গভঙ্গবিরোধী বিশাল বিক্ষোভ মিছিল গঙ্গাতীরে পৌঁছে সমবেতভাবে বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘বন্দেমাতারম’ গান পরিবেশন করে পুনরায় অখণ্ড বাংলার সংযুক্তিকরণের শপথ নেয়। এদিন কলকাতায় অঘোষিত হরতাল পালিত হয়। আনুষ্ঠানিক প্রতিজ্ঞার নিদর্শন স্বরূপ মণিবন্ধে প্রত্যেকে রাখি বাঁধে। এই রাখি বন্ধন বাঙালির ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। সামন্ত-ভূস্বামী, মধ্যবিত্ত, পেশাজীবী, ছাত্রসমাজসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্যের পাশাপাশি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজনরা আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন জাতিগত চেতনায়। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র খুবই স্পষ্ট। যা ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের বিপন্ন করে অজানা শঙ্কার মুখে ফেলেছিল।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে কংগ্রেস সভাপতি গোপালকৃষ্ণ গোখলে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বাংলায় ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের আহ্বানকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন প্রদান করেন। কংগ্রেসের সেই অধিবেশনে বালগঙ্গাধর তিলক ও তার অনুসারীরা সারা ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন বিস্তারে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের প্রস্তাব পেশ করলেও, কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থিদের অসম্মতি ও বিরোধিতায় সে প্রস্তাব গৃহিত হতে পারেনি। কলকাতার বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিক হতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গবিরোধী কর্মসূচিসমূহে উপস্থিত ও অংশগ্রহণের পাশাপাশি অনেকগুলো দেশপ্রেমের দেশাত্মবোধক গান রচনা ও পরিবেশন করেন। বাংলার মাটি-বাংলার জল, বাংলার বায়ু-বাংলার ফল, আমায় বলো না-গাহিতে বলো না, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ইত্যাদি।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়ে ‘বিজয় সম্মিলন’ নামক এক ভাষণও তিনি দিয়েছিলেন। কলকাতার উপকণ্ঠের প্রখ্যাত নাখোদা মসজিদে উপস্থিত হয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মসজিদের মুসল্লিদের হাতে রাখি বেঁধে দেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী এই আন্দোলনের ব্যাপকতাই ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত এই আন্দোলন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বলেই ঘৃণিত লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়ন স্থায়ী হয়নি। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়। প্রকৃতভাবে জনদাবির মুখে রদ করতে বাধ্য হয়। পক্ষান্তরে স্থানীয় ব্রিটিশ শাসকদের জন্য ছিল সেটা চরম চপেটাঘাত। এই অপমানের প্রতিশোধে ১৯১২ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়। কলকাতা হারায় তার ঐতিহ্য। হ্রাস পায় কলকাতার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব। রাজধানীর মর্যাদা হারিয়ে কলকাতা কেবলই প্রদেশের রাজধানীতে পরিণত হয়।

ওদিকে বৃহৎ বাংলাকে উদ্দেশ্যমূলক সংকুচিত করা হয়। উড়িষ্যা, বিহার, ছোটনাগপুরকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। আসাম পূর্বের ন্যায় স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত হয়। পূর্ব ও পশ্চিমবাংলা নিয়েই বাংলা প্রদেশ তার পূর্বেকার আয়তন ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। 

মযহারুল ইসলাম বাবলা: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ