নেপাল ও ফ্রান্সে সংঘাত
পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় শান্তির বার্তা কোথায়?
‘জেন-জি’দের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তীব্র আন্দোলনের মুখে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করার পরপরই ফ্রান্সে প্রবল সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। নেপালের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল ‘জেন-জি’রা আর ফ্রান্সের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বামপন্থিরা। গতকাল প্রায় ২ লাখ বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। সারা দেশজুড়ে তারা ‘ব্লক এভরিথিং’ ঘোষণা দিয়েছেন। আর তার জের ধরেই ফ্রান্সের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ। রাস্তার আবর্জনার বাক্স তুলে জনগণ ছুড়ে মেরেছেন পুলিশের ওপর। অসংখ্য যানবাহন পুড়িয়ে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে ফ্রান্স সরকার দেশজুড়ে ৮০ হাজার পুলিশ মোতায়েন করেছে। প্রায় ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক।
ফ্রান্সে হঠাৎ এই রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বাইরুর পদত্যাগ এবং তার জায়গায় নতুন প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেবাস্তিয়েন লেকর্নুকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। গত দুই বছরের মধ্য প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিতে বাধ্য হলেন। ফ্রান্সে চলমান বিক্ষোভের মূল কারণ হলো অর্থনৈতিক চাপ ও সরকারের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে জনগণের অসন্তোষ।
সাম্প্রতিক আন্দোলনের পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ কাজ করছে: পেনশন সংস্কার, সরকার অবসরের বয়স ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৪ বছর করার সিদ্ধান্ত নেয়া। এতে শ্রমিক ও কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তারা মনে করেন, দীর্ঘদিন কাজ করতে বাধ্য করলে জীবনমান ও সামাজিক সুরক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে জ্বালানি মূল্য বেড়েছে, খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়েছে। ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ার ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে ফ্রান্সে। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুগছেন।
অনেকের অভিযোগ, নতুন শ্রমনীতি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ। চাকরির নিরাপত্তা কমে যাচ্ছে, বেকারত্বের ভয় বাড়ছে। এসব ক্ষেত্রেই সরকারের অনমনীয়তা প্রকাশ করেছে। সংসদে যথেষ্ট সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সংবিধানের বিশেষ ধারা ব্যবহার করে পেনশন আইন পাস করান। এতে জনগণের মধ্যে ধারণা তৈরি হয় যে, সরকার তাদের মতামত উপেক্ষা করছে। ফলে এখন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁরই পদত্যাগের দাবি উঠছে। প্যারিসে বিক্ষোভে ছিলেন ফ্রেড নামে আন্দোলনকারীদের একজন প্রতিনিধি। ম্যাক্রোঁর পদত্যাগ দাবি করে তিনি বলেন, ‘সেই একই গল্প, একই অবস্থা। শুধু মন্ত্রীরা নন, সমস্যা মাখোঁ নিজেই। মন্ত্রীরাও সমস্যা বটে; কিন্তু মাখোঁ ও তার কাজের ধরন আরও সমস্যাজনক। এ কারণেই তাকে সরে যেতে হবে।’
ফ্রান্সের এই রাজনৈতিক সংকট এমন এক সময়ে এসেছে যখন ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চলছে। প্যারিসের এই অস্থিরতা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয়ের জন্যই একটি ইতিবাচক দিক, কারণ তারা ইউরোপের দুর্বলতাকে উপহাস করতে আনন্দ পায়।
অন্যদিকে, নেপাল বহু বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র থেকে সংবিধান—সব মিলিয়ে কাঠমান্ডুর রাজনীতি যেন অনন্ত পরীক্ষাগারের মতো। কয়েক মাস পরপর সরকার পরিবর্তন এখন প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষমতার পাল্লা ভারী করতে ব্যস্ত; কিন্তু জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে কার্যত ব্যর্থ। এর ফলে সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ। ক্ষমতার টানাপোড়েন, দুর্বল অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ বিভাজন নেপালের অগ্রযাত্রাকে আটকে রেখেছে। দীর্ঘদিন ধরে টালমাটাল এই অবস্থা দেশটিকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আস্থা ও ঐক্যের জায়গা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপালের পর ফ্রান্সেও এই গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া এটাই ইঙ্গিত করে যে, বিশ্ব ক্রমশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে এবং এক পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। জনগণ ক্রমশ সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এটা কি নতুন দিনের হাতছানি? নতুন এক বৈশ্বিক বিপ্লবের পদধ্বনি কি শুনতে পাচ্ছে বিশ্ব? এই পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় শান্তির বার্তা কোথায়? তাই বিশ্বব্যাপী শান্তির কোনো বিকল্প নেই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে