মাচাদোর নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক কোথায়?
মারিয়া কোরিনা মাচাদো ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে। নোবেল কমিটি তার সাহস ও দৃঢ় অবস্থানের প্রশংসা করেছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক হুমকি ও বিপদের মুখেও তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
নোবেল কমিটি মাচাদোকে “শান্তির চ্যাম্পিয়ন” হিসেবে অভিহিত করেছে, যিনি ভেনেজুয়েলায় ক্রমবর্ধমান অন্ধকারের মধ্যে গণতন্ত্রের শিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন। কমিটির চেয়ারম্যান জর্গেন ওয়াটনে ফ্রিডনেস তাকে ভেনেজুয়েলার “একটি মূল, ঐক্যবদ্ধ ব্যক্তিত্ব” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যেখানে একসময় রাজনৈতিক বিরোধী দল বিভক্ত ছিল। তিনি বলেন, মাচাদো একটি ভিন্ন ভবিষ্যতের প্রতীক, যেখানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে এবং তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে।
ফ্রিডনেস আরও বলেছেন, “গত বছর মাচাদোকে গোপনে বসবাস করতে হয়েছিল। জীবনের ওপর গুরুতর হুমকি থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশ ছাড়েননি। এই সাহসিকতা লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। যখন স্বৈরাচারীরা ক্ষমতা দখল করে তখন এমন সাহসী স্বাধীনতার রক্ষকদের স্বীকৃতি দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
তবে তার পুরস্কার পাওয়া ঘিরে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকেই তার রাজনৈতিক অবস্থান ও অতীত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিতর্কের প্রধান কারণগুলো হলো:
ইসরায়েলপ্রীতি ও গাজা যুদ্ধ নিয়ে অবস্থান
মাচাদোকে সমালোচনা করা হচ্ছে ইসরায়েলের প্রতি তার দৃঢ় সমর্থন এবং প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর লিকুদ দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে। তিনি ইসরায়েলকে “স্বাধীনতার প্রকৃত মিত্র” বলেছেন এবং ভেনেজুয়েলার গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে ইসরায়েলের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
নরওয়ের সংসদ সদস্য বিজর্নার মক্সনেস উল্লেখ করেছেন, মাচাদো ২০২০ সালে ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির সঙ্গে একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। লিকুদ পার্টি ‘গাজা গণহত্যা’র জন্য দায়ী, তাই এই পুরস্কার নোবেলের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
দেশি হস্তক্ষেপের আহ্বান
মাচাদো একাধিকবার ভেনেজুয়েলার সরকার উৎখাতের জন্য বিদেশি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন। সমালোচকদের মতে, এ ধরনের আহ্বান নোবেল শান্তি পুরস্কারের মূল আদর্শ- শান্তিপূর্ণ পথে পরিবর্তনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ২০১৮ সালে তিনি আর্জেন্টিনা ও ইসরায়েলের কাছ থেকে সমর্থন চেয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যাতে তারা “ভেনেজুয়েলার অপরাধী সরকারকে ভেঙে ফেলার জন্য” তাদের প্রভাব ব্যবহার করে। চিঠিটি অনলাইনে শেয়ার করা হয়েছিল।
ডানপন্থি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা
অনেকে অভিযোগ করেছেন, মাচাদো ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থি এবং অতিডানপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের মতে, তিনি শান্তির পরিবর্তে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছড়িয়েছেন। তিনি কয়েকটি অতিদানপন্থি সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছেন এবং ভেনেজুয়েলার ওপর নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক চাপের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন।
সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া
আমেরিকান ইসলামিক কাউন্সিল (CAIR) এই সিদ্ধান্তকে “নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য” বলে নিন্দা জানিয়েছে এবং বলেছে, এটি নোবেল কমিটির সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। ল্যাটিন আমেরিকার অনেক সামাজিক আন্দোলন এবং আঞ্চলিক নেতা নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং মানবাধিকার সংগঠনও এই মাচাদোর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদানের নিন্দা জানিয়েছে।
ট্রাম্পকে উৎসর্গ করা বিতর্ক
বিতর্ক আরও বেড়েছে, যখন মাচাদো তার নোবেল পুরস্কার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উৎসর্গ করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন আগেও নোবেল কমিটিকে “শান্তির চেয়ে রাজনীতি প্রাধান্য দিচ্ছে” বলে সমালোচনা করেছিল। এটি পুরস্কারটিকে আরও রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত করেছে।
শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয়। নোবেলের ইতিহাসে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে ১৯৭৩ সালে হেনরি কিসিঞ্জিারের নোবেল পুরস্কার, অনেক সমালোচকদের অভিমত, কিসিঞ্জার শান্তি প্রণেতা ছিলেন না; বরঞ্চ যুদ্ধের ব্যাপক প্রসারে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিলেন, ১৯৯৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের পুরস্কার, যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল- ২০০৯ সালে বারাক ওবামার পুরস্কার, যিনি তখনো কোনো উল্লেখযোগ্য শান্তি অর্জন করেননি।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এবারও মাচাদোর নোবেল প্রাপ্তিকে ঘিরে অনেক বিতর্কের কথা লেখা হয়েছে। হংকংয়ের সংবাদমাধ্যম দি স্ট্যান্ডার্ড লেখে, ভেনেজুয়েলায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল মজুত রয়েছে এবং জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা সেখানে বিরোধী শক্তিগুলোকে সমর্থন করে আসছেন, যেখানে ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি একটি মূল তহবিলদাতা হিসেবে সন্দেহভাজন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাচাদো ট্রাম্পের পুত্রের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, ক্ষমতায় এলে তিনি ভেনেজুয়েলার তেল শিল্পকে বেসরকারিকরণ করবেন যা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে লাভ ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেবে।
দি হিন্দুস্তান টাইমস লেখেছে, মাচাদোর কিছু সমালোচক তার ইউরোপের রক্ষণশীল রাজনৈতিক আন্দোলন এবং মার্কিন ডানপন্থি স্বার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্য সমালোচনা করেছেন। যদিও মাচাদোর নোবেল জয় আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করা হচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে থাকা ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের বাস্তব পরিস্থিতি উন্নত করবে না।
তুরস্কের আনাদুলু এজেন্সি জানায়, এক পোস্টে মাচাদো লিখেছিলেন, “ভেনেজুয়েলার সংগ্রাম ইসরায়েলের সংগ্রাম,” এবং পরে ইসরায়েলকে “স্বাধীনতার প্রকৃত মিত্র” হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
এনডিটিভি ওয়ার্ল্ড জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হামলার পর তিনি ইসরায়েলের প্রতি সংহতি প্রকাশ করলেও কখনো প্যালেস্টাইনিদের হত্যার সমর্থন প্রকাশ্যে দেননি। তবে তার পোস্টগুলো নিশ্চিত করে যে তিনি নেতানিয়াহুর মিত্র। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে ভেনেজুয়েলার দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করবেন।
CAIR এক বিবৃতিতে বলেছে, “মিস মাচাদো ইসরায়েলের বর্ণবাদী লিকুদ পার্টির স্পষ্ট সমর্থক এবং এই বছরের শুরুতে ইউরোপীয় ফ্যাসিস্টদের একটি সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যেখানে প্রকাশ্যে ‘নতুন রেকনকুইস্তা’ আহ্বান জানানো হয়- যা ১৫০০-এর দশকে স্প্যানিশ মুসলিম ও ইহুদিদের জাতিগত নির্মূলের ঘটনা উল্লেখ করে।”
প্রাক্তন পোডেমোস নেতা ও ভেনেজুয়েলার প্রাক্তন উপ-রাষ্ট্রপতি পাবলো ইগ্লেসিয়াস বলেছেন, “করিনা মাচাদোকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া মানে হলো এমন কাউকে স্বীকৃতি দেয়া, যিনি বছরের পর বছর ধরে নিজের দেশে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছেন। এভাবে চাইলে ট্রাম্প বা মরণোত্তর হিটলারকেও দিতে পারত। আগামী বছর পুতিন ও জেলেনস্কিকেও ভাগ করে দেয়া যেতে পারে।”
ল্যাটিন আমেরিকার অনেক সামাজিক আন্দোলন এবং আঞ্চলিক নেতা নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর্জেন্টিনার আন্তঃধর্মীয় গোষ্ঠী মেসা ইকুমেনিকা শুক্রবারের পুরস্কার ঘোষণার পর বলেছে, তারা “গভীর বিভ্রান্তি ও অসন্তোষ” অনুভব করছে। তাদের মতে, নোবেল কমিটি “পূর্ববর্তী পুরস্কারপ্রাপ্তদের উত্তরাধিকার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে”। তারা বলেছে, “এই ধরনের পুরস্কার এমন কাজের স্বীকৃতি দেয়া উচিত যা দীর্ঘস্থায়ী, যাচাইযোগ্য এবং মানুষের মধ্যে শান্তি, ন্যায়বিচার ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে; কিন্তু মাচাদোর কাজ এই নীতিগুলোর থেকে অনেক দূরে মনে হচ্ছে।”
ডোমিনিকান সোলিডারিটি আন্দোলন এবং কিছু রাজনৈতিক সংগঠন এই পুরস্কারকে “শান্তির সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ” হিসেবে দেখছে এবং বলছে নোবেল শান্তি পুরস্কার এখন “ল্যাটিন আমেরিকায় পশ্চিমা হস্তক্ষেপের একটি হাতিয়ার” হয়ে গেছে। তারা আরও বলেছেন, “একজন এমন ব্যক্তিকে পুরস্কার দেয়া হয়েছে যিনি স্পষ্টভাবে মার্কিন ও ইসরায়েলি সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন যা আলফ্রেড নোবেলের প্যাসিফিস্ট মনোভাবের প্রতি অবজ্ঞা।”
কিছু ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠনও এই পুরস্কার সমালোচনা করেছে। তারা বলছে, এটি ওয়াশিংটনের বিদেশনীতির সমর্থন হিসেবে দেখা যেতে পারে, বিশেষ করে যখন কারাকাসের বিরুদ্ধে সামরিক হুমকি দেয়া হয়েছে এবং ক্যারিবিয়ান সাগরে মার্কিন নৌবহর মোতায়েন করা হয়েছে।
কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ-কানেল বলেছেন, নোবেল কমিটি “অচিন্তনীয় মাত্রায় রাজনীতি ও পক্ষপাতিত্বে নিমজ্জিত হয়েছে”। সাবেক হন্ডুরাস প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল জেলায়া বলেছেন, এই পুরস্কার “শান্তির প্রতীককে আধুনিক ঔপনিবেশিকতার হাতিয়ারে রূপান্তরিত করেছে”।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো মাচাদোকে “দুষ্টাচারী” হিসেবে অভিহিত করেছেন, কারণ তার বিদেশি হস্তক্ষেপের আহ্বান ভেনেজুয়েলান জনগণের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশেরও বেশি ভেনেজুয়েলান বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরোধী। মাচাদোর প্রার্থিতা প্রচার করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, যিনি ভেনেজুয়েলায় সরকারের পরিবর্তনের নীতির প্রধান সমর্থক।
ভেনেজুয়েলার কমিউনিস্ট পার্টি (PCV) মাচাদোর পুরস্কার প্রাপ্তিকে “মিথ্যা কংগ্রেস” হিসেবে অভিহিত করেছে। তাদের মতে, এটি মার্কিন হস্তক্ষেপকে সমর্থন করে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করে। কিছু মানবাধিকার সংস্থাও মাচাদোর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সম্পর্ক এবং মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে অবস্থান নেয়াকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সব মিলিয়ে, মাচাদোকে তার সমর্থকরা ভেনেজুয়েলার সাহসী গণতন্ত্রযোদ্ধা হিসেবে দেখছেন; কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, তার রাজনৈতিক সংযোগ, বিদেশি হস্তক্ষেপের আহ্বান এবং ইসরায়েলপ্রীতি নোবেল শান্তি পুরস্কারকে শান্তির প্রতীক নয় বরং বৈশ্বিক রাজনৈতিক বিভেদের প্রতীক হিসেবে পরিণত করেছে। এভাবে মাচাদোর রাজনৈতিক অবস্থান এবং বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি মিলিয়েই এই নোবেল জয়কে ঘিরে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তাই মাচাদোর এই নোবেল জয় শুধু আনন্দের নয় বরং আজকের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন হিসেবেও আলোচিত হচ্ছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে