Views Bangladesh Logo

বেড়েছে ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন

নিপীড়নমুক্ত সমাজের বাস্তবায়ন কোথায়!

প্রায়ই নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনাকে গণমাধ্যমের খবর হতে দেখা যায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নারী ও কন্যাশিশুরা অপরিচিত ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় পরিচিতজনদের দ্বারা; কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ঘটনাগুলো প্রকাশ হয় না। লোকলজ্জা ও সামাজিক বন্ধনজনিত কারণে বিষয়গুলো পরিবার ও সমাজের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। পরিস্থিতিটাকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করছেন মানবাধিকার কর্মী ও নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা। তারা প্রশ্ন তুলছেন রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে।

একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে, ঝিনাইদহের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী লিনার শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল। এক বিকেলে প্রাইভেট পড়া শেষে আর বাড়ি ফেরেনি সে। দুদিন পর ধানক্ষেতের পাশের এক ঝোপে তার লাশ মেলে। তাকে প্রথমে ধর্ষণ, পরে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। ধর্ষক ও হত্যাকারী ছিল প্রতিবেশী এক যুবক, যে প্রায়ই লিনাকে নানা অজুহাতে বিরক্ত করত। তার পরিবার অতিষ্ঠ হয়ে থানায় অভিযোগের কথা ভাবলেও গ্রামের লোকজন বলেছিল, ‘এসব কথা চেপে যাওয়াই ভালো, মেয়েরই বদনাম হবে!’

লিনার মতো প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্তে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে কন্যাশিশু। আবার কাউকে কাউকে ধর্ষণের পর হত্যাও করা হচ্ছে। মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত এ সহিংসতা এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং তা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে।

২০২৪ সালে নারী নির্যাতনের মাত্রা কিছুটা কমলেও এ বছরের প্রথম সাত মাসে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি দেখা দেয়। প্রথম সাত মাসেই নির্যাতনের শিকার হয়েছে এক হাজার ৬৬৪ জন নারী ও কন্যাশিশু। তাদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৫৩ জন। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ১০৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৫ জনকে। এ ছাড়া, গত বছর নির্যাতনের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫২৫টি, এর মধ্যে এক হাজার ১০৬ কন্যাশিশু আক্রান্ত হয়। ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৫১৬ জন, এর মধ্যে ৩৬৭ কন্যাশিশু। ৮৬ কন্যাশিশুসহ ১৪২ জনকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৮ কন্যাশিশুসহ ২৩ জনকে।

এত বড় ভয়ংকর পরিসংখ্যানের পরও বলতে চাই, নারী ও কন্যাশিশুর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন বন্ধে দেশে ইতিবাচক আইন ও নীতিমালাও আছে; কিন্তু যথাযথ আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতার অভাবে এখনো দেশে শিশু নির্যাতনের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। তাই নানা ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতি সত্ত্বেও নারীর প্রতি এ ধরনের মনোভাব এখনো পিছিয়ে পড়া সমাজের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

দেখা গেছে, নির্যাতিত নারী ও কন্যাশিশুরা পরবর্তী জীবনে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগে। বিষয়টি অগ্রগতির পথে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। যার বিরূপ ফল সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়। তা ছাড়া দেশে শুধু নারী ও মেয়েশিশুই যৌন নির্যাতনের শিকার হয় এমন নয়; আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে পুরুষশিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনাও। যৌন নির্যাতক কেবল পুরুষ নয়, নারীও হতে পারে।

নারী ও কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতন-সহিংসতা কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। তা ছাড়া অপরাধীর সঙ্গে ক্ষমতাবানদের সখ্য হওয়ার কারণে নির্যাতিতের পরিবার সঠিক বিচার পায় না! কখনো কখনো নির্যাতক কোনো কোনো রাজনীতিকের আশীর্বাদও পেয়ে থাকে।

মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি কোনো একক সত্তা নয়, ব্যক্তি সামাজিক সমষ্টির অংশ। তাই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নারী ও শিশুদের যথাযথ অধিকার, শিক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে সরকার জাতীয় শিশুনীতি ও নারী উন্নয়ননীতি প্রণয়ন করেছে। গৃহীত এসব পদক্ষেপের ফলে বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও এখনো প্রত্যাশিত হারে কমেনি।

তাই নারী ও শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরিবেশ, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা এবং নিপীড়নমুক্ত সমাজব্যবস্থ্যা। সেই সঙ্গে নারী ও শিশুর প্রতি আপনজনসহ সবাইকে মানবিক আচরণ করতে হবে এবং নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চার ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ