অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গন্তব্য কোথায়!
বর্তমান বাংলাদেশের গন্তব্য কোথায় এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে! এমন প্রশ্ন সব মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। দীর্ঘ ১০ মাসব্যাপী সরকারের নানা দেশের স্বার্থহানির একের পর এক সিদ্ধান্ত আমাদের আতঙ্কিত ও শঙ্কার মুখে ঠেলে দিয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্য যে মহৎ তা ভাবা যাচ্ছে না। একটি এক দলীয় শাসনামলের পরিবর্তনে আমার অপর একটি অগণতান্ত্রিক, স্বাধীন মত প্রকাশের অন্তরায় একটি অসাংবিধানিক সরকার পেয়েছি। সরকারের এখতিয়ার বহির্ভূত নানা কর্মকাণ্ডে দেশবাসীর আস্থা ইতিমধ্যে কমছে।
প্রশ্ন থাকে এরকম একটি অসাংবিধানিক সরকারের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের পেছনের শক্তি কে বা কারা? এই সরকারকে আন্দোলনকারী তথাকথিত শিক্ষার্থীদের সিদ্ধান্তে গঠিত হয়েছিল। ওই শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টার প্রচ্ছন্ন মদদে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলও গঠন করেছে। সরকার প্রধানও আন্দোলনকারী কতিপয়ের দাবির ভিত্তিতে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতিকে সংঘাতের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সরকার প্রধানের কথা ও কাজের ক্ষেত্রে চরম বৈপরীত্য যেমন প্রকাশ পাচ্ছে, তেমনি সরকার প্রধানের বলা কথার বরখেলাপ তিনি নিজেই করে চলেছেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের পর হতে এ যাবৎ কোনো কথারই বাস্তবায়ন তিনি করেননি। বরং উল্টোটাই করে চলেছেন।
বহু বিতর্কিত আরাকান রাজ্যের করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের কাছে তুলে দেয়া, সেন্টমার্টিন দ্বীপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরের চরম দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে জনমনে উদ্বেগ-আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। পরিবেশ উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসান প্রবাল রক্ষায় পর্যটকদের সেন্টমার্টিনে যাওয়া নিষিদ্ধ করার কথা বহু পূর্বে বলেছিলেন। নেপথ্যের উদ্দেশ্য প্রবাল রক্ষায় যে নয় তা ইতিমধ্যে জনমনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। উদ্দেশ্যটা আর বুঝতে কারও বাকি নেই। দেশের স্টক হোল্ডার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সেনাবাহিনী এবং দেশবাসীর অগোচরে বিদেশিদের নিকট দেশের ভূমি ও সম্পদ তুলে দেবার ক্ষেত্রে কারও সঙ্গে ন্যূনতম আলোচনা পর্যন্ত করা হয়নি।
এ নিয়ে ইতিমধ্যে জামায়াত, এনসিপি [কিংস পার্টি] ভূঁইফোঁড় এবি পার্টি ব্যতীত সব রাজনৈতিক দল চরম বিরোধিতায় নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সেনাপ্রধান পর্যন্ত তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অথচ সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অটল অবস্থান থেকে পিছ-পা না হয়ে একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। এমন একটি অসাংবিধানিক ও সমষ্টিগত জনগণের অসমর্থিত সরকারের শক্তির উৎস নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কোনো নির্বাচিত সরকারও এ পর্যন্ত এরূপ ধৃষ্টতা দেখাতে না পারলেও বর্তমান সরকার সেটা দেখাতে কসুর করছে না।
২০২৪-এর ৫ আগস্টের পর হতে দেশে মব ভায়োলেন্স অব্যাহত গতিতে চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর উপস্থিতিরও তোয়াক্কা না করে কতিপয় তথাকথিত আন্দোলনকারীদের নিরবচ্ছিন্ন স্বেচ্ছাচারে জাতি অতিষ্ঠ। তাদের মর্জিমাফিক নৃশংসতা সকল ক্ষেত্রেই বিরাজমান। সম্প্রতি আন্দোলনকারীদের গৃহ তল্লাশি করে সেনাবাহিনী নড়াইলে স্নাইপার রাইফেল এবং কুমিল্লায় অতীত ছাত্র শিবির ও বর্তমান এনসিপির সদস্যের বাড়ি তল্লাশি করে অস্ত্র উদ্ধারে আন্দোলনে মানুষ হত্যার রহস্য অনেকটা উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আন্দোলনে নিহতদের ময়নাতদন্তে পাওয়া গুলি নিয়ে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, এই স্নাইপার রাইফেল পুলিশের নয়। কে বা কারা এটি ব্যবহার করেছে এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।
এই বক্তব্যের পর ক্ষমতার দাপুটে অংশীদার ও আধিপত্য বিস্তারকারীদের দ্বারা তাকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদ হারাতে হয়েছে। আমাদের সরকার প্রধান গত ১০ মাসে ১১টি বিদেশ সফর করেছেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। তবে একটি সফরও দ্বিপক্ষীয় ছিল না। ছিল তার ব্যক্তিগত সফর। বিশাল লটবহর সহকারে রাষ্ট্রের অর্থনাশ করেছেন ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক কাছে। এ নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু তিনি কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছেন বলে মনে হচ্ছে না।
আমাদের নিশ্চয় স্মরণে আছে, ৫ আগস্ট সেনাপ্রধান সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণের এবং তার ওপর আস্থা রাখার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি দেশজুড়ে চলেছে নৃশংস সন্ত্রাস। চারশত থানার অস্ত্র লুণ্ঠন, থানায় আগুন দিয়ে পুলিশ হত্যা, বিগত সরকারের সংশ্লিষ্টদের শিল্পকারখানা ধ্বংসের মহোৎসব চলেছে দেশজুড়ে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা-মামলা, গণগ্রেফতারের নজিরবিহীন কর্মযজ্ঞ। অথচ সেনাবাহিনী নীরব দর্শক হিসেবে তামাশা দেখেছে। প্রতিশ্রুতি দেবার পরও সেনাপ্রধান এসব অনাচার ঠেকাতে কোনো ভূমিকা পালন করেননি। অরক্ষিত দেশবাসীকে শিকার হতে হয়েছে নৃশংস মব ভায়োলেন্সে। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য পর্যন্ত রক্ষা পায়নি।
মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের আস্ফালন, মুক্তিযোদ্ধাদের নিগৃত হওয়ার ঘটনায় দেশবাসী অবাক বিস্ময়ে দেখে নির্বাক ও ব্যথিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা বিলীন করে দেবার অসংখ্য ঘটনা প্রমাণ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের কবলে এখন দেশ। বর্তমান সরকারের পেছনে তিনটি শক্তি ক্রিয়াশীল জামায়াতে ইসলামীসহ মৌলবাদী চক্র, বৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনের ম্যাটিকুলাস ডিজাইনের অংশীদার নেতৃবৃন্দ এবং ভূঁইফোঁড় কিছু দল। আন্দোলনে অংশ নেয়া বৃহৎ জনতাকে তারা কামলা হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ওই ম্যাটিকুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নকারী নেতৃত্বের বৃত্তে তাদের যুক্ত করেনি। তাই আন্দোলনকারী বৃহৎ অংশের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তাদের ভুল স্বীকারের অসংখ্য কথন তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলে যাচ্ছে।
অতি সম্প্রতি লটবহরসহ প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফর নিয়ে অসংখ্য অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। তিনি একটি পুরস্কার গ্রহণে এবং বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। এটি তার ব্যক্তিগত সফর নিশ্চয়ই; কিন্তু জানা যাচ্ছে রাষ্ট্রের অর্থ-শ্রাদ্ধ করে তিনি অতীতের ন্যায় এই ব্যক্তিগত সফরটি করেছেন। প্রতিটি বিদেশ সফরের কেন্দ্রে তার গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে গিয়েছেন, রাষ্ট্রের অর্থ নাশ করে। জনমনে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
তথাকথিত সংস্কার, জুলাই সনদ ঘোষণা ব্যতিরেকে নির্বাচন না করার হুমকি দিয়েছে কিংস পার্টি। সরকার প্রধানও একই কথা বলে নির্বাচন অনুষ্ঠানে হরেক টালবাহানা করে যাচ্ছে। সেনাপ্রধান এবং বিএনপিসহ সকল মূলধারার রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানালেও সরকার প্রধান এপ্রিল ২০২৬-এ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপরোক্তদের দাবি অগ্রাহ্য করে। তাই প্রশ্ন জাগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শক্তি উৎস কোথায়? আর দেশকে নিয়ে তারা কোন গন্তব্যে অগ্রসর হচ্ছে।
মযহারুল ইসলাম বাবলা: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে