হ্যামলেট থেকে বাংলাদেশ
উদরের সীমাবদ্ধতা থেকে কবে মুক্তি পাবে বাঙালি
শেকসপিয়রের হ্যামলেট নিজের দ্বন্দ্ব ও অনিশ্চয়তায় আটকে পড়ে রাজত্বের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। হ্যামলেট যখন নিজের সংকটে বিভ্রান্ত, তখন রাজ্যের ভবিষ্যৎও ঝুঁকির মুখে থাকে। আমাদের বাংলাদেশের চিত্রও তার থেকে কম নয়। স্বাধীনতা অর্জনের পর দীর্ঘ ৫৪ বছর পার হয়ে গেছে, অথচ আমরা এখনও সেই হ্যামলেটের মতো- নিজের দ্বন্দ্ব ও স্বার্থপরতায় আটকে- জাতির জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। উদরের আনন্দ, স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বার্থপরতা আমাদের চিন্তাশীল শক্তিকে শিকলবন্দি করেছে, আর রাজনৈতিক অঙ্গনও এক ধরনের বিভ্রান্তি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার জালে আটকে রয়েছে।
দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে আমরা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য নিয়ে বিভক্ত- কে রাজাকার, কে দুর্নীতিগ্রস্ত, কে স্বাধীনতার ঘোষক; কে কী নীতির অনুসারী- বাংলাদেশি নাকি বাঙালি, ইসলামী নীতি অনুসারী নাকি ভারতীয় প্রভাবমুক্ত চিন্তার পন্থা। ভোটপ্রক্রিয়া, পিআর পদ্ধতি বা নির্বাচনের কৌশল- সবই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের খেলাঘর হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সাধারণ মানুষ প্রায়শই এই বিতর্কের মধ্যে হারিয়ে যায়। ফলে দেশের চেতনা, নৈতিকতার মান এবং জাতির সামগ্রিক বিকাশ গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাধীনতা অর্জন সত্ত্বেও আমরা আজও জাতির চেতনা ও দেশের প্রকৃত স্বার্থের বাইরে আটকে আছি, ঠিক যেমন হ্যামলেট নিজের দ্বন্দ্ব অতিক্রম না করলে রাজ্য ধ্বংসের পথে এগোত।
নাগরিক জীবনে খাদ্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি অতিমাত্রার আকর্ষণ দেশের চিন্তাশীল শক্তিকে আটকে রেখেছে। আমরা পান্তা-ইলিশ বিতর্কে এত মনোযোগ দিই, যেন তা জাতির ইতিহাসের সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। টেলিভিশনের হোটেল সিরিজে চকচকে খাবারের ছবি দেখতেও আমরা সময় এবং মনোযোগ দিই; কিন্তু রাষ্ট্রনির্মাণ, প্রযুক্তি, শিল্প ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি- যা দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে- সেগুলোর দিকে নজর দিতে প্রায়ই ভুলে যাই। উদরের প্রতি এই অতিমাত্রার প্রেম শুধু ব্যক্তিগত প্রবণতা নয়; এটি দেশের মানসিকতা, সামাজিক কাঠামো এবং নৈতিক চেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
এদিকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও একই ধরনের ঘুরপাক দেখা যায়। ক্ষমতার লোভ, স্বার্থপর কৌশল এবং পার্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতার জটিল খেলায় সাধারণ মানুষ প্রায়ই হারিয়ে যায়। ভোট, নির্বাচনি প্রক্রিয়া এবং কৌশলগুলো হয়ে গেছে রাজনৈতিক শক্তির সংঘর্ষের মঞ্চ, যেখানে দেশের প্রকৃত চাহিদা এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থ প্রায়শই হাওয়ায় ভেসে যায়। এই পরিস্থিতি দেশের তরুণ প্রজন্মের সৃজনশীল, উদ্যোগ ও নৈতিক চেতনাকে আটকে রেখেছে।
ফলস্বরূপ, উদরের বন্দিত্ব এবং রাজনৈতিক বিভ্রান্তি একসঙ্গে দেশের শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প ও স্থানীয় উদ্যোগকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে বাধা দিচ্ছে। একদিকে টেলিভিশনের খাদ্যচিত্রে আমরা মুগ্ধ হই, অন্যদিকে দেশের উৎপাদনশীলতা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং স্থানীয় উদ্যোগ- সবই উপেক্ষিত থাকে। স্বাধীনতার অর্জিত সুযোগগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না, আর দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই একত্রিত সংকট শুধু ব্যক্তিগত সুখের প্রশ্ন নয়; এটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশকে দুর্বল করছে। উদরের অতিমাত্রা, রাজনৈতিক বিভ্রান্তি এবং স্বার্থপরতার সমন্বয় আমাদের নৈতিক চেতনা, দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই ব্যর্থতা হ্যামলেটের দ্বন্দ্বের মতোই- যদি আমরা নিজস্ব সংকট ও স্বার্থের বাইরে বের না হই, জাতি কখনো তার পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারবে না।
বাংলাদেশের দুরবস্থা কেবল উদরের প্রেম বা রাজনৈতিক বিভ্রান্তিতেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার অভাব, স্বার্থপর নেতৃত্ব এবং দক্ষ মানুষদের যথাযথ সুযোগ না দেওয়া জাতির গতিকে দীর্ঘদিন ধরে বাধাগ্রস্ত করেছে। স্বাধীনতার পরও আমরা প্রায়শই বিদেশি প্রযুক্তি, শিল্প ও সমাধানের ওপর নির্ভরশীল থেকে গিয়েছি, যেখানে দেশের নিজস্ব দক্ষ প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবনক্ষম মানুষদের প্রতিভা প্রায়ই কাজে লাগানো হয় না।
সামরিক প্রস্তুতি, শিল্পায়ন এবং দেশীয় উদ্যোগেও স্বল্পতা স্পষ্ট। দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য যেসব কাঠামো প্রয়োজন, সেগুলো যথাযথভাবে গড়ে তোলা হয়নি। ফলে বিদেশি প্রযুক্তি ও উপকরণের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং দেশের তরুণ প্রজন্মের উদ্ভাবনী শক্তি অনিয়মিত ও সীমিত সুযোগের মধ্যে আটকে রয়েছে। এই ঘাটতিগুলো দেশের সামগ্রিক প্রগতি, স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জাতির আত্মমর্যাদা- সবকিছুই প্রভাবিত করছে।
নৈতিকতার অবক্ষয় দেশের জন্য একটি গভীর সংকট হয়ে উঠেছে। স্বার্থপরতা এবং উদরের প্রতি অতিমাত্রার আকর্ষণ সমাজে দায়িত্ববোধ ও নৈতিক চেতনা ক্ষয় করেছে। শিক্ষায়, বিজ্ঞানচর্চায় এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগে অগ্রগতি সীমিত, আর তরুণ প্রজন্ম অনেক ক্ষেত্রেই সহজ এবং সুবিধাজনক পথ বেছে নেয়- যেমন বিসিএস ক্যাডার হওয়া বা নিরাপদ সরকারি চাকরি। এই অবস্থা শুধু দেশের দক্ষ মানবসম্পদের সঠিক ব্যবহার বাধাগ্রস্ত করছে না, বরং অনেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেশত্যাগের পথ বেছে নিচ্ছে, কারণ দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও রাজনৈতিক দুরবস্থার কারণে দেশে প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে। ফলে জাতির উদ্ভাবনী শক্তি, দক্ষতা এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, আর দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সঠিক সুযোগ তৈরি করা যাচ্ছে না।
এবার চিন্তা করুন দেশপ্রেমের পরিপ্রেক্ষিত। পান্তা-ইলিশ বা খাদ্য উৎসব- সবই আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ, কিন্তু স্বাধীনতার মূল অর্থ এবং জাতির চেতনা সীমিত হয়ে পড়েছে। আমরা বার্ষিক উৎসব বা টেলিভিশনের হোটেল সিরিজের মাধ্যমে আনন্দ খুঁজে পাই, কিন্তু দেশের নিরাপত্তা, শিল্পায়ন, শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং জাতির দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে। শেকসপিয়রের হ্যামলেট যেমন নিজের দ্বন্দ্বে আটকে থেকে রাজত্বের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তেমনি আমরা খাদ্যের প্রতি অতিমাত্রার আকর্ষণে জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে দূরে থাকি।
স্বাধীনতা অর্জনের পরও আমরা আজও জাতির চেতনা ও দেশের প্রকৃত স্বার্থের বাইরে আটকে আছি- ঠিক যেমন হ্যামলেট নিজের দ্বন্দ্ব অতিক্রম না করলে রাজ্য ধ্বংসের পথে এগোত। খাদ্য, স্বাচ্ছন্দ্য এবং স্বার্থপরতার প্রতি অতিমাত্রার আকর্ষণ আমাদের চিন্তাশীল শক্তি ও নৈতিক চেতনাকে সীমিত করেছে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি, ক্ষমতার লোভ, পার্টি রাজনীতি এবং স্বার্থপর নেতৃত্ব দেশের সত্যিকারের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সতর্ক করেছিলেন, ‘যে জাতি উদরের কাছে নত, সে কখনো মহৎ স্বপ্নের পথে হাঁটতে পারে না।’ খাদ্য, সৌন্দর্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক আনন্দ আমাদের সৃজনশীলতার উৎস হতে পারে, তবে যদি তা চেতনা, নৈতিকতা এবং দেশপ্রেমের সঙ্গে সমান্তরাল না থাকে, আমরা জাতির সম্ভাবনাকে নষ্ট করি। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের শেখিয়েছেন, ‘বিদ্রোহ যদি না হয়, মানুষ কখনো নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারে না।’ উদরের বন্দিত্ব ও স্বার্থপরতার বাইরে বের হয়ে আমরা যদি শিক্ষা, বিজ্ঞান, উদ্যোগ এবং দেশপ্রেমের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে বিদ্রোহী মনোভাব কাজে লাগাই, তবে জাতি সত্যিকারের শক্তি, মর্যাদা এবং স্বনির্ভরতা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
শেকসপিয়র, ঠাকুর এবং নজরুল একসঙ্গে আমাদের বার্তা দিচ্ছেন: চরিত্র, দায়িত্ব, চিন্তা এবং সাহস ছাড়া স্বাধীনতা ও ক্ষমতাই ধ্বংসের পথে যায়। উদরের সীমাবদ্ধতা শুধু ব্যক্তিগত সুখ নয়; এটি রাষ্ট্র, সমাজ এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি করছে। সমাধান সহজ, তবে প্রয়াস প্রয়োজন। শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সমান্তরালভাবে। দেশের নিজস্ব উদ্যোগ এবং দক্ষ মানবসম্পদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে; সব সমস্যার সমাধান বিদেশি প্রযুক্তি বা সমাধানে নয়। সাংস্কৃতিক আনন্দ এবং খাদ্যের স্বাদ গ্রহণকে জাতির উন্নয়ন ও দেশপ্রেমের সঙ্গে সমান্তরালে রাখতে হবে।
উদরের সুখকে আমরা নিন্দা দিচ্ছি না- বরং তাকে আমাদের চিন্তা, কর্ম ও প্রগতির সহায়ক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। হ্যামলেটের দ্বন্দ্ব অতিক্রম করা যেমন জরুরি, তেমনি আমাদেরও উদরের বন্দিত্ব, রাজনৈতিক বিভ্রান্তি এবং নৈতিক সংকট অতিক্রম করতে হবে। তখনই ঘরও, দেশও নিরাপদ হবে, জাতি উদরের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে এবং সত্যিকারের প্রগতি অর্জন করবে।
রহমান মৃধা: গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে