কেমন ছিল আড়াই হাজার বছর আগের ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা
সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন বা সিবিআই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে সুপরিচিত; কিন্তু আপনি কি জানেন, এরও অনেক আগে, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ভারতে এর মতো একটি সংস্থা কাজ করত?
ইতিহাস অনুযায়ী, সিবিআই (CBI) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪১ সালে, স্পেশাল পুলিশ এস্টাবলিশমেন্ট (Special Police Establishment) হিসেবে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্নীতি এবং ঘুষের বিরুদ্ধে কাজ করা। পরবর্তীতে এই সংস্থাটিই ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা অর্থাৎ সিবিআইর রূপ নেয়।
আজকের দিনে সিবিআই বা অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কথা শুনলে আমাদের মনে যে চিত্র ভেসে ওঠে, আড়াই হাজার বছর আগে ভারতের চিত্রটা ছিল তার থেকেও অনেক বেশি জটিল এবং চমকপ্রদ। সেই সময় কোনো আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না, ছিল না স্যাটেলাইট বা অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবুও, মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থপতি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং তার প্রধান পরামর্শদাতা কৌটিল্য বা চাণক্য এমন এক সুসংগঠিত গোয়েন্দা ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন যা আজকের দিনেও বিস্ময় জাগায়।
কৌটিল্যের লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’-এ এই গোয়েন্দা ব্যবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। এটি কেবল একটি গোয়েন্দা ব্যবস্থা ছিল না, বরং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার ছিল। এই ব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল কঠোর শৃঙ্খলা, বিশ্বাস এবং নিখুঁত ছদ্মবেশ।
গুপ্তচরদের দুটি প্রধান বিভাগ
কৌটিল্য তার গুপ্তচরদের প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন:
১. সংস্থা (Samstha): এই গুপ্তচররা ছিল নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে অবস্থানকারী। তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরে মিশে যেত এবং সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করত। যেমন কোনো বাজারের ব্যবসায়ী, কোনো গ্রামের কৃষক অথবা কোনো শিক্ষকের ছদ্মবেশে তারা নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখত।
২. সঞ্চরা (Sanchara): এরা ছিল ভ্রাম্যমাণ গুপ্তচর। তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়িয়ে খবর সংগ্রহ করত। সন্ন্যাসী, ভিক্ষুক, সাধু বা গায়কের ছদ্মবেশে তারা রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারত।
বিচিত্র ছদ্মবেশে গুপ্তচরদের দল
মৌর্য সাম্রাজ্যের গুপ্তচররা (যারা ‘গূঢ়পুরুষ’ নামে পরিচিত ছিল) তাদের পেশা ও দক্ষতার ভিত্তিতে বিভিন্ন দলে বিভক্ত ছিল। তাদের ছদ্মবেশ ছিল এতটাই নিখুঁত যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের আসল পরিচয় বোঝা প্রায় অসম্ভব ছিল।
কপটিকা (Kapatika): এরা ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিচক্ষণ মেধাবী ছাত্র। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর তাদের গোয়েন্দা হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। তাদের প্রধান কাজ ছিল অসৎ রাজকর্মচারীদের ওপর নজর রাখা এবং তাদের দুর্নীতি ফাঁস করা।
উদাস্থিত (Udasthita): এই দলের সদস্যরা সন্ন্যাসী বা তপস্বীর ছদ্মবেশ ধারণ করত। তারা রাজ্যের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াত এবং জনগণের মনোভাব, রাজার প্রতি তাদের আনুগত্য এবং কোনো সম্ভাব্য বিদ্রোহের লক্ষণ সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করত।
গৃহপতিকা (Grihapatika): এরা ছিল মূলত দরিদ্র কৃষক বা গৃহস্থের ছদ্মবেশে থাকা গোয়েন্দা। গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে তারা কৃষি, অর্থনীতি এবং গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করত।
বৈদেহক (Vaidehaka): এই দলের সদস্যরা ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে থাকত। তাদের কাজ ছিল বাণিজ্যিক কার্যকলাপের আড়ালে বাজার, বন্দর এবং সীমান্ত অঞ্চলে শত্রুদের গতিবিধি ও কার্যকলাপের ওপর নজর রাখা।
তাপস (Tapasa): এরা ছিল সন্ন্যাসী বা সাধুর ছদ্মবেশে থাকা গুপ্তচর। তারা তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াত এবং জনমানসের খবর সংগ্রহ করে রাজাকে জানাত।
মহিলা গুপ্তচরদের ভূমিকা
মৌর্য গোয়েন্দা ব্যবস্থায় নারীদেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাদের এমন কিছু দলে নিয়োগ করা হয়েছিল যেখানে পুরুষদের পক্ষে প্রবেশ করা কঠিন ছিল।
সত্রী (Satri): এরা ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন নারী। তারা সাধারণত নৃত্যশিল্পী বা বারবণিতার ছদ্মবেশে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মজলিসে প্রবেশ করত এবং তাদের কাছ থেকে গোপন খবর সংগ্রহ করত।
পরিব্রাজিকা (Parivrajika): এরা ছিল সন্ন্যাসিনী বা ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে থাকা গুপ্তচর। তারা সহজেই উচ্চবিত্ত পরিবারে প্রবেশ করতে পারত এবং বাড়ির মহিলাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক ও রাজনৈতিক তথ্য সংগ্রহ করত। তাদের প্রধান কাজ ছিল মুনাফাখোর ও কৃপণ ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করা, যারা পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করত।
লক্ষ্যবস্তু ছিল চার ধরনের বিক্ষুব্ধ জনতা
চাণক্য তার গোয়েন্দাদের মাধ্যমে চার ধরনের বিক্ষুব্ধ জনগণের ওপর বিশেষভাবে নজর রাখতেন। এই শ্রেণিগুলোকে চিহ্নিত করা এবং তাদের বশে আনা ছিল গোয়েন্দাদের অন্যতম প্রধান কাজ।
ক্রুদ্ধবর্গ: যেসব ব্যক্তি কোনো কারণে রাজার ওপর ক্ষুব্ধ, তাদের ওপর নজর রাখা হতো। তাদের অসন্তোষের কারণ জেনে রাজা তাদের উপহার বা উপঢৌকন পাঠিয়ে বশে আনার চেষ্টা করতেন।
ভীতবর্গ: অসৎ কাজের জন্য যারা শাস্তি বা অপমানের শিকার হয়েছিল তাদেরও বশে আনার চেষ্টা করা হতো।
লুব্ধবর্গ: যারা খাজনা দিতে পারত না বা নানা আসক্তির কারণে দরিদ্র ছিল তাদের রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন ছোটখাটো কাজে যেমন ঝাড়ুদার বা শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো।
মানীবর্গ: উচ্চাভিলাষী, ধনী এবং জমিদারদের এই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য রাজা স্বয়ং উপহার দিতেন এবং ছোট ছোট অঞ্চলের শাসনভার তাদের হাতে তুলে দিতেন। যদি তাতেও তারা সন্তুষ্ট না হতো তাহলে ‘রসদ’ শ্রেণির গুপ্তচররা তাদের গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা করত।
নিষ্ঠুরতা ও কঠোর শৃঙ্খলা
মৌর্য গোয়েন্দা ব্যবস্থায় শুধু তথ্য সংগ্রহই শেষ কথা ছিল না, এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল নির্মমতা এবং কঠোর শৃঙ্খলা। ‘রসদ’ নামের এক বিশেষ ধরনের গোয়েন্দা দল ছিল, যারা ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর। ‘তাপস’ গোয়েন্দাদের দ্বারা চিহ্নিত বিদ্রোহীদের বিষপ্রয়োগে হত্যা করা ছিল তাদের প্রধান কাজ।
বিশ্বাসঘাতকতা বা ভুলের কোনো ক্ষমা ছিল না। গুপ্তচরদের সততা যাচাই করতে কৌটিল্য একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। তিনি একই খবর সংগ্রহের জন্য একাধিক গুপ্তচরকে পাঠাতেন, যাদের একে অপরের সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকত না। যদি তাদের সংগৃহীত তথ্য মিলে যেত, তবে তা সঠিক বলে গণ্য হতো। আর যদি কোনো চরের দেয়া তথ্যে গরমিল পাওয়া যেত তাহলে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হতো এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হতো।
নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মৌর্যযুগের ভারতীয় সমাজ’ বইয়ে উল্লেখ আছে, নন্দবংশের কাছ থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যখন ক্ষমতা ছিনিয়ে নিচ্ছিলেন তখন চাণক্যের এই গোয়েন্দা বাহিনীই তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল। আড়াই হাজার বছর আগেকার এই সুসংগঠিত এবং কার্যকরী গোয়েন্দা ব্যবস্থা প্রমাণ করে যে, কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা আর মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে কতটা শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। মৌর্য সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি ও স্থায়িত্বের পেছনে তাই চাণক্যের কূটকৌশল এবং তার তৈরি এই গুপ্তচর ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য।
চন্দন চৌধুরী: কবি ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে