Views Bangladesh Logo

‘জুলাই সনদ’ ইস্যুতে রাজনৈতিক সংশয় কাটাতে করণীয়

ব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোয় যে অবস্থা বিরাজ করছে সেটাকে এক পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা বলা যায়। কারণ, বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় এটাকে ব্যাখ্যা করা ও সেই ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না; কোনো না কোনো অধিসাংবিধানিক প্রক্রিয়ার শরণ নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বাস্তবে পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায় বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ পুরোনো ব্যবস্থার পদ্ধতি মেনেই নেয়া হয়। কারণ, পদ্ধতিগুলো প্রায় সব জায়গায়ই একই থাকে। পার্থক্য থাকে শুধু কোন সার্বভৌম শক্তি সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, কেন, কীভাবে, কখন, কাকে দিচ্ছে- এসব ক্ষেত্রে।

আরও একটি কারণে আগের মতো করেই কাজগুলো করা হয়, সেটা হলো এ পদ্ধতিগুলো শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা, সার্বভৌম শক্তিকে সাধারণ জনগণের কাছে সহজে অনুভূত বা আবির্ভূত হওয়া ও অনুকরণযোগ্য সবচেয়ে ভালো শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রয়োগ করা সুবিধাজনক; কিন্তু যত যা-ই হোক না কেন, সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপই নতুন সার্বভৌম শক্তির সিদ্ধান্তের অধস্তন হয়ে যায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আমরা যে পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায় ঢুকে গিয়েছি তা ছাত্র-জনতার দাবি ও সক্রিয় আন্দোলনের মুখে সাংবিধানিক পদাধিকারী বিভিন্ন ব্যক্তির পদত্যাগ বা অব্যাহতির ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। স্বাভাবিক সাংবিধানিক অবস্থায় জাতীয় সংসদে অভিশংসনের প্রক্রিয়া ছাড়া এদের পদচ্যুত করার সুযোগ নেই; কিন্তু সবই হয়েছে আর তা হয়েছে পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায়, যেখানে অভ্যুত্থানে বিজয়ীদের অভিপ্রায়ই প্রাধান্য লাভ করে। তত্ত্বে যেভাবেই থাক না কেন, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে।

অনেক আশা নিয়ে দেশটা স্বাধীন হলো। গুটিকয় পরিবার ছাড়া স্বাধীনতার জন্য সবাই মূল্য দিয়েছে; কিন্তু স্বাধীনতার ফল পকেটে পুরেছে কিংবা আঁচলে বেঁধেছে হাতেগোনা কিছু পরিবার ও গোষ্ঠী। আমরা গণতন্ত্র চাই, নাকি সমাজতন্ত্র, নাকি খেলাফত- এ নিয়ে এখনো বাহাস করি। ১৭ কোটি মানুষের কাঁধে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসেছে গুটিকয় অলিগার্ক, যারা নিজ নিজ ডকট্রিন নিয়ে আস্ফালন করছে। সেখানে শুধু তারাই আছে, মানুষ নেই। মানুষ এখানে কখনো কামানের খোরাক, কখনো ক্ষমতায় আরোহণের কাঁচামাল। রাজনৈতিক দলের সিন্ডিকেট আর ব্যক্তিশাসনের বিরুদ্ধে ইতিহাসে একবারই এ দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো একাট্টা হয়েছিল।

১৯৯০ সালে আমরা পেয়েছিলাম একটি সনদ, যেটি ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নামে পরিচিত। সেখানে মূল কিছু বিষয় ছিল। যেমন: হত্যা, ক্যু, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ধারা থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশে পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সার্বভৌম জাতীয় সংসদ গঠনের ব্যবস্থা করা। গণমাধ্যমকে সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাখতে রেডিও-টেলিভিশনসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করা। জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে অসাংবিধানিক কোনো পথে ক্ষমতা দখল প্রতিরোধ করা। জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা। মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি সব আইন বাতিল করা। ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা ও অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকা, সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় না দেয়া এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করা; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। দলগুলোর মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল। প্রধান দুই দলের দুই নেত্রী এই সনদে সই দেননি।

নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন বৃথা যায়। এবারের জুলাই সনদে মোটামুটি সব দলই স্বাক্ষর করেছে। শুধু যেসব তরুণকে শান্ত করতে ইউনূস সরকার সংস্কার ও সনদ শুরু করেছিল তারাই স্বাক্ষর করেননি। তারা এখন পর্যন্ত অশান্তই রয়ে গেলেন। তবু স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর মোটামুটি এখন সবারই জন্য স্বস্তি। নির্বাচনে যেতে এখন আর বাধা নেই। গত এক বছরে জুলাই সনদ নিয়ে কম কসরত হয়নি। মনে হচ্ছিল, এই ম্যাগনাকার্টা করতে না পারলে আমাদের নির্বাচন, সরকার, রাজনীতি সব অচল হয়ে যাবে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তাদের জন্য সনদের এতসব ধারা-উপধারা, কে কোনটি মানল, কোনটি কখন বাদ গেল, আবার কখন কোনটি সংশোধন করা হলো- এসবের হদিস রাখা কঠিন হয়ে উঠেছিল। তবে সংবাদমাধ্যমগুলো সংক্ষেপে আমাদের সামনে যা তুলে ধরেছে তার থেকে সনদের কার্যক্রমের যে বিষয়গুলো আমাদের সবার নজরে এসেছে তা হচ্ছে: সনদে কী লেখা হবে তা নিয়ে বাগবিতণ্ডা ও ডিসেন্ট, সনদ কীভাবে গৃহীত হবে তা নিয়ে মত-মতান্তর এবং সনদে কে স্বাক্ষর দেবেন কিংবা কে স্বাক্ষর দেবেন না- তা নিয়ে টালবাহানা। এসব পর্বই বেশ উপভোগ্য ছিল। আজ যিনি পক্ষে, কাল চলে গেলেন বিপক্ষে; আবার তাকে বুঝিয়ে নিমরাজি করানো হলো। এখানে এসেই আমরা বারবার হোঁচট খাচ্ছি।

আমাদের এখানে ১৯৪৯ সালের চীন কিংবা ১৯৫৮ সালের কিউবার আদলে পালাবদল হবে না। পরিবর্তনের একটি মডেল কখনোই আরেকটি মডেলকে হুবহু অনুসরণ করে না। এখানে ড্রয়িংরুম বিহারি কিছু শৌখিন স্বপ্নবিলাসী ছাড়া সম্ভবত সবাই বহুদলীয় সরকারব্যবস্থা চান; কিন্তু আমরা সাড়ে পাঁচ দশক ধরে এমন একটা ব্যবস্থার চর্চা করেছি, যেটি নাগরিকের শাসনকে টেকসই করার দিকে যায় না। বরং সৃষ্টি করে বিদ্রোহী। এ থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়? আমরা তো কারও ভাষণ কিংবা ইশতেহারে আস্থা রাখতে পারছি না?

সে জন্য দরকার একটি চুক্তি, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিকদের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দেবে। তিন জোটের রূপরেখার পরিণতি দেখার পর লিখিত অঙ্গীকারের মাধ্যমে একটি সনদের দাবি উঠেছে। এটাই হচ্ছে প্রস্তাবিত জুলাই সনদের পটভূমি। জুলাই সনদে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব আছে, যার মধ্যে যে ৪৭টি সংবিধান-সম্পর্কিত এগুলো করবে নির্বাচিত সংসদ। যেসব প্রস্তাবে দলগুলোর ভিন্নমত আছে, প্রস্তাবের পাশেই সেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। সনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সাত দফা অঙ্গীকারনামা, যার তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে, এই সনদের বৈধতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে দলগুলো কোনো আদালতে প্রশ্ন তুলবে না। আর অঙ্গীকারনামার শেষ দফায় বলা হয়েছে, জুলাই সনদে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে। বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্তর্বর্তী সরকার গণভোটের আয়োজন করতে পারে। কমিশনে নির্বাচনের একই দিনে সেই গণভোট হওয়ার দিকেই দল ভারী ছিল।

জুলাই সনদে যেসব বিষয়ে সম্পূর্ণ ঐকমত্য আছে সেসব বিষয়কে লক্ষ করেই এই গণভোট সাজাতে হবে। দ্বিমত ও নোট অব ডিসেন্ট হিসেবে আসা প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকেই যেতে হবে। সেই লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি সংবিধান সংস্কার সভা তৈরি করা যেতে পারে। জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করতে সেই সভায় ১৯৩৭ সালের লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির মতো বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের সংযুক্ত করা যেতে পারে। সামনের নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে তারাও থাকবে; আবার তাদের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনে অংশগ্রহণ করা দলগুলোর প্রতিনিধি, নারী প্রতিনিধি, নাগরিক প্রতিনিধি, পেশাজীবী প্রতিনিধি, সংখ্যালঘু প্রতিনিধি ও অবাঙালি প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি জাতীয় ঐক্যের মঞ্চ তৈরি করা যায়।

এই সংবিধান সংস্কার সভা ঐকমত্য কমিশনের কমিশনাররাই পরিচালনার দায়িত্ব পেতে পারেন। এ সভা সময়ের চাপ না নিয়ে জুলাই সনদে যেসব প্রস্তাবে আপত্তি বা নোট অব ডিসেন্ট আছে সে বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছে সেগুলো বাস্তবায়ন করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে। আমরা ইন্দোনেশিয়ার চলমান সংবিধান তৈরির উদাহরণ নিলে দেখব, তারা ধাপে ধাপে ১৯৯৯ সালে শুরু করে চার ধাপে সংস্কার করে ২০০২ সালে এসে শেষ ধাপের সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করে। সেই চতুর্থ ধাপে এসে তারা শরিয়াহ আইন, সাংবিধানিক কোর্ট ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের সাংবিধানিক সমাধানে পৌঁছাতে পারে। জাতীয় ঐক্য টিকিয়ে রাখার জন্য তারা তাদের সংবিধানে সবচেয়ে কট্টর প্রদেশকে শরিয়াহ আইনে চলার বন্দোবস্ত করে দেয়। এই ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের দীর্ঘ প্রক্রিয়া ইন্দোনেশিয়ার বিভাজিত জনগোষ্ঠীকে ঐক্যের সুতায় বাঁধতে সমর্থ হয়। বাংলাদেশকেও তার মধ্যের মতদ্বৈততাকে সম্মান করতে হবে।

বিপরীত মেরুর গোষ্ঠীগুলো যাতে আলাপ চালিয়ে যেতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। সময়ের চাপে দেখা যাবে, তারাই একসময় সমাধান বের করে নিয়ে আসবে। অন্তর্বর্তী সরকার তার অনেক প্রতিশ্রুত কাজ সময় নিয়ে করছে, যাতে কাজের মান ঠিক থাকে। সংবিধান তৈরির এই মোড়ে এসে তারা একইভাবে সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে কাজের মানের দিকেই মনোযোগ রাখলে দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা হবে। আমরা আমাদের দেশটা গোছাতে পারিনি। এখানেই প্রশ্ন, আমরা কেন পারিনি? আমরা কেউ গাল দিই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে, কেউ মন্দ বলি পাকিস্তানি শাসকদের, কথায় কথায় আলোচনায় আনি মীরজাফর। মীরজাফর মরে ভূত হয়ে গেছে আড়াইশ বছর আগে। কোম্পানির শাসন শেষ হয়েছে ৭৮ বছর আগে, পাকিস্তানের থাবা সরে গেছে ৫৪ বছর হলো। তারপরও আমাদের কেন এই ব্যর্থতা, কেন এত আক্ষেপ, কেন এই হতাশা? আর কতকাল আমরা অতীতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নিজেদের আড়াল করে রাখব? আমাদেরই তো সবকিছুর দায় নিতে হবে।

রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক, যুক্তরাজ্য। 

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ