Views Bangladesh Logo

নেপালের বিক্ষোভ থেকে চীন কী বার্তা পেলো

Reza  Ghatok

রেজা ঘটক

হিমালয়কন্যা নেপাল কার্যত এখন অশান্ত। দেশে কার্যকর কোনো সরকার নেই। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের মাত্র ৪৮ ঘণ্টার আন্দোলনেই পতন হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কে পি শর্মা অলি চতুর্থবারের মতো নেপালের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কে পি শর্মা অলির দল ইউএমএল (ইউনাইটেড মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী পার্টি) নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে সরকার গঠন করে।

নেপালের ২৭৫ আসনের পার্লামেন্টে নেপালি কংগ্রেসের সদস্য ৮৮ জন, প্রধানমন্ত্রী অলির দল ইউএমএলের (ইউনাইটেড মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী পার্টি) সদস্য ৭৬ জন এবং মাওবাদী কেন্দ্রের প্রচণ্ডের সদস্য ৩২ জন। নেপালে ২৭৫ আসনের পার্লামেন্টে সরাসরি ভোট হয় ১৬৫ আসনে। বাকি ১১০ আসনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সদস্য নির্বাচিত হয়। সংসদ গঠিত হয় পাঁচ বছরের জন্য। নেপালের প্রধান রাজনৈতিক দল নেপালি কংগ্রেসের ঐতিহাসিক ঘনিষ্ঠতা নয়াদিল্লির সঙ্গে।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির দল ইউএমএলের (ইউনাইটেড মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী পার্টি) ঘনিষ্ঠতা বেইজিংয়ের সঙ্গে। এর আগে তিনবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাওবাদী গেরিলা নেতা পুষ্প কমল দাহাল প্রচণ্ড, যিনিও চীনের ঘনিষ্ঠ। তার মানে নেপালে এর আগে নয়াদিল্লি বা বেইজিং সমর্থিত দল সরকার গঠন করেছে। এরমধ্যে নেপালি কংগ্রেস দলের নেতা শের বাহাদুর দেউবা পাঁচবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্রের অবসানের পর দেশটি গণতন্ত্রে ফিরলেও কোনো সরকারই পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি।

২০১৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ইউএমএলের (ইউনাইটেড মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী পার্টি) নেতৃত্বে থাকেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি এবং মাওবাদী কেন্দ্রের নেতৃত্বে থাকেন পুষ্প কমল দাহাল প্রচণ্ড। এমনকি এই দুই কমিউনিস্ট নেতা ২০১৮ সালে দুই দলে বিভক্ত হবার পর আড়াই বছর করে প্রধানমন্ত্রীর পদও ভাগ করে নেন। গত সোম ও মঙ্গলবারের বিক্ষোভের পর প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পৌডেল প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কার্যত দেশের ক্ষমতা এখন সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেলের হাতে।


হঠাৎ করে নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এরকম উত্তপ্ত হওয়ার কারণ কী? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে যেসব কারণে হঠাৎ নেপালে রাজনৈতিক সরকারের পতন হলো, সেগুলো নিম্নরূপ:

১. বৃহস্পতিবার ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করাকে কেন্দ্র করে নেপালের তরুণ সমাজের (জেন-জি) অসন্তোষকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হলেও আসল সমস্যা দেশটির দুর্নীতি ও প্রধান প্রধান দলের প্রবীণ রাজনীতিবিদদের নিয়ে নতুন প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে গভীর হতাশা।

২. স্থানীয় সাংবাদিকদের ভাষ্য, মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় সরকার পতনের বিক্ষোভ আন্দোলন দেশজুড়ে ব্যাপকমাত্রায় ছড়িয়ে পরার মধ্যে ভূরাজনৈতিক উপাদানও যুক্ত রয়েছে।

৩. গত নেপালে সোম ও মঙ্গলবারের সহিংসতায় ভারত ও চীনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাতটি দেশের দূতাবাস একটা বিবৃতি দিয়েছে।

সেই বিবৃতির ভাষায় বিক্ষোভকারীদের দাবির প্রতি তাদের সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। ফলে কে পি শর্মা অলি সরকারের পতনের পর পুরো বিষয়টা চীনের জন্য একটা আঘাত হিসেবেই এখন আন্তর্জাতিক মহলে বিবেচিত হচ্ছে।

৪. নেপালের তরুণ সমাজের (জেন-জি) আন্দোলনে নামার নৈতিক ও আইনগত যুক্তি হিসেবে ছিল নেপালের সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ। যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি রয়েছে। তবে সরকার সামাজিক শান্তির প্রয়োজনে ইচ্ছা করলে সেই মতামতের প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সেই সূত্রেই যোগাযোগমাধ্যমের ওপর চড়াও হয়েছিল কে পি শর্মা অলির সরকার।

৫. সম্প্রতি সরকার গোয়েন্দা বিভাগকে টেলিফোনে আড়ি পাতার অধিকার দিয়ে একটা নতুন আইন তৈরির কাজ শুরু করেছিল। যেটি নেপালের শহুরে শিক্ষিত সমাজকে অসন্তুষ্ট করেছে।

৬. নেপালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মূলত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের রাজনৈতিক কথাবার্তার বড় একটা জায়গা। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা এবারের আন্দোলনে শুরুর দিকে সংগঠক ছিলেন না। এমনকি মিছিলেও তাদের সংখ্যা কমই ছিল।
সরকারের দুর্নীতি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনৈতিক কথাবার্তা বন্ধ করার ষড়যন্ত্র হিসেবে ধীরে ধীরে গোটা নেপালজুড়েই সরকারবিরোধী লোকজন পরবর্তীতে বিক্ষোভে যোগ দেয়।

৭. সরকারের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের ঘোষণার জবাবে শুরুতে তরুণ সমাজের (জেন-জি) আন্দোলনকারীরা সুস্পষ্টভাবে শ্রেণিগতভাবে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একদিকে দেশের নিম্নবিত্ত তরুণসমাজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ব্যবসা করেন। তারা সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধের ঘোষণায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

অন্যদিকে উচ্চবিত্ত ঘরের তরুণ সমাজ বিষয়টি ভালো নজরে দেখেননি। কারণ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা তাদের সাংস্কৃতিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সরকার হঠাৎ এটি বন্ধ ঘোষণা করায় তাদের অভ্যাসে ছন্দপতন ঘটেছে। এমনকি অনেকের পড়ালেখার ধরনেও নানানরকম সমস্যা হয়েছে সরকারের ওই সিদ্ধান্তে।

নেপালের সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রথমে শুরু করেছে স্কুলের কম বয়সী শিক্ষার্থীরা। ক্রমেই সেই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে মধ্যবয়সী তরুণসমাজ। আর রক্তপাতের পর সর্বশেষ এটা ধীরে ধীরে অনেকটা সরকারবিরোধী বিক্ষোভের চেহারা নেয়। ফলে আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনেই সেটা অনিয়ন্ত্রিত দাবানলের মতো গোটা নেপালে ছড়িয়ে পড়ে।

নেপালে তরুণ সমাজের (জেন-জি) আন্দোলনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো- এটি দেশের বয়োবৃদ্ধ নেতাদের জন্য সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা। বয়স্ক নেতারা ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি করেন আর তাদের সন্তানরা বিদেশে নানান কিসিমের সুবিধা পান। 'নেপো কিডস' নামে বিত্তবানদের সন্তানদের বিরুদ্ধে তরুণ সমাজ (জেন-জি) একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। তাদের ধারণা 'নেপো কিডস'রা যে বিলাসিতা দেখায় তার প্রধান উৎস দুর্নীতি।

বিশ্বব্যাপী জেন-জিদের আন্দোলনের মতো নেপালের তরুণ সমাজের (জেন-জি) আন্দোলনে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেক তারকাশিল্পী বিক্ষোভকারীদের পক্ষ নিয়েছেন। তারকারা সবসময় পেশাগত স্বার্থেই তরুণদের সঙ্গে থাকতে চান। আবার তরুণেরাও তাদের প্রিয় তারকার সমর্থন পেলে বাড়তি চাঙা হন। নেপালের এই আন্দোলনেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল।

বিশ্বব্যাপী জেন-জিদের আন্দোলনের মত নেপালেও তরুণ সমাজের (জেন-জি) বিক্ষোভকারীরা আন্দোলন শুরু করার পরপরই হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তারা গোটা দেশজুড়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় এবং আগুনসন্ত্রাস করে। ফলে রাষ্ট্রীয় স্থাপনার নিরাপত্তায় নিয়োজিত রক্ষীদের সঙ্গে দ্রুত সংঘর্ষ লেগে যায়। সংঘর্ষে ২২ জন নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়। ফলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

নেপালের রাজনৈতিক সরকারগুলোর এক ধরনের দায়মুক্তির সংস্কৃতি সেদেশের জনআস্থাকে ভেঙে চুরমার করেছে। অর্থনীতি তীব্র ধাক্কা খেয়েছে। নেপালিরা কর দেন, কিন্তু এর বিনিময়ে সড়ক, হাসপাতাল ও স্কুলের উন্নতি পান না। মন্ত্রীরা কেবল নিজেদের পকেট ভারী করেন। যা আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভে রসদ জুগিয়েছে।
গত মাসে নেপালের শীর্ষ আদালত একটি রায় দেন। ওই রায়ে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে দেশের আইন মেনে নিবন্ধনে বাধ্য করতে পারবে সরকার। কোম্পানিগুলোকে স্থানীয় প্রতিনিধি নিয়োগ করতে হবে। যার কাছে তাৎক্ষণিকভাবে দেশটির সরকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অভিযোগ জানাতে পারবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের পক্ষে সরকারের বক্তব্য ছিল এরকম যে, বিদেশি কোম্পানিগুলো কোনো নিয়মের মধ্যে না থাকায় দেশ থেকে তারা বিপুল অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। এমন কি তারা ঠিকমতো কর দিচ্ছে না। কোম্পানিগুলো নিবন্ধ করলে দেশের বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি পাবে। সরকার এক সপ্তাহ সময় বেধে দিলেও ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া সেটি না মানায় সরকার বৃহস্পতিবার সেগুলো বন্ধ করে দেয়।

বৈশ্বিক রাজনীতিতে এখন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নানাভাবে ক্রিয়াশীল। নেপালে যেসব বহুজাতিক কোম্পানি নেপালের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি লোভনীয় দৃষ্টি নিয়ে নেপালের গরীব কৃষকদের জন্য নানান কিসিমের ফাঁদে ফেলেছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সেই ফাঁদের স্টেকহোল্ডারদের খুশি রেখে তারা নেপালকে শোষণ করার নতুন নতুন ফন্দি ফিকির বের করেছে। কে পি শর্মা অলির সরকার পতনেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।

নেপালের রাজতন্ত্র অবসানের আন্দোলনের সময়ে ২০০৬ সালের শেষের দিকে পুষ্প কমল দাহাল প্রচণ্ড, বাবুরাম ভট্টরাইদের মতো নেতারা জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে আগ্রহ দেখানোর পর ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে জাতিসংঘ নেপালে তাদের কার্যক্রম (United Nations MIssion in Nepal (UNMIN) শুরু করে। জাতিসংঘ নেপালে কার্যক্রম শুরু করার পর প্রথমে ডিডিআর কার্যক্রম (Disarmament, Demobilization, Reintegration) শুরু করে। ডিসআর্মমেন্ট বা নিরস্ত্রীকরণ, ডিমোবিলাইজেশন বা সামরিক কর্মপন্থা বর্জন এবং রিঅ্যান্টিগ্রেশন বা গেরিলা বাহিনী ভেঙ্গে ফেলা- এই ডিডিআর কার্যক্রম দিয়ে জাতিসংঘ নেপালে কার্যত মাওবাদী পার্টির মূল চালিকা শক্তি ভেঙ্গে দেয়।

জাতিসংঘ নেপালের মাওবাদীদের মিথ্যা উন্নয়নের আশ্বাস দিয়ে নেপালে তখন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নামে এনজিও গ্রামের কার্যক্রম শুরু করে। নেপালের মাওবাদীরা গ্রামে মৌলিক উন্নয়নের জন্য যেসব স্কুল, হাসপাতাল ও স্থানীয় পরিষেবা কাঠামো গঠন করেছিল, জাতিসংঘ সেগুলো এনজিও গ্রামের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গোগ্রাসে গলধকরণ করতে শুরু করে।

নির্ধন উত্থান ব্যাংক লিমিটেড নামে একটি এনজিও, যেটি এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের তহবিলে পরিচালিত, সেটি মাওবাদীদের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করার জন্য নেপালের গ্রামীণ জনসমাজে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম শুরু করে। এছাড়া নেপালের কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা (Center for Micro-Finance in Nepal, CMF) নেপালের জনগণ ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় এনে নেপালের মৌলিক পরিসেবাগুলোর ধ্বংস ডেকে আনে।

নেপালের মাওবাদ গ্রুপের অনেক শিক্ষিত সুবিধাবাদী সদস্য এসব এনজিওর খপ্পরে পড়ে উচ্চ বেতনে অথবা নানান কিসিমের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মাওবাদীদের গণসংগঠনগুলো ধ্বংস করে ফেলে। এভাবে ধীরে ধীরে নেপালে জাতিসংঘ ও এনজিওগুলো মাওবাদীদের মাধ্যমেই গ্রামীণ গণসংগঠনগুলো ধসিয়ে দেয়। ফলে বিপুল জনসমর্থণপুষ্ট মাওবাদীরা ধীরে ধীরে নেপালে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। আর সেখানে জায়গা দখল করে নেয় জাতিসংঘ, এনজিও, নরওয়ে, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।

নেপালে বাম রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠন করলেও নেপালের গ্রামীণ কাঠামো কার্যত দখল করে নেয় ইন্দো-মার্কিন পরাশক্তি ও তাদের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। আর জাতিসংঘ নেপালে নানান কিসিমের মিথ্যা প্রলাপ দিয়ে ভালো মানুষ সাজার ভান করে নেপালি শক্ত মাওবাদী গ্রামীণ কাঠামোর মূলশক্তি ধ্বংস করে দেয়।

যে নেপাল একদিন ভারত ও চীন সমর্থিত দৃশ্যমান রাজনৈতিক সরকার গঠন করে দেশ শাসন করতো, কার্যত সেই নেপালে রাজতন্ত্রের অবসানের পর সেখানে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা উন্নয়নের নামে নানান কিসিমের বহুজাতিক কোম্পানি ও এনজিওর মাধ্যমে নেপালের মূল গ্রামীণ শক্তিশালী কাঠামোকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। ফলে নেপালি সমাজে নানান মাত্রার ভাঙন শুরু হয়। আর এসব বহুজাতিক কোম্পানি ও এনজিওরা মিলে কে পি শর্মা অলির দুর্বল জোট সরকারকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার আন্দোলনে ফেলে দিতে সক্ষম হয়।

নেপালের কালাপানি নামে একটি এলাকা বর্তমানে ভারতের দখলে। যেটি নিয়ে ভারত ও নেপাল নিজেদের মধ্যে কুটনৈতিক লড়াই চলছে। কালাপানির সঙ্গে রয়েছে চীনের বর্ডার। বিরোধপূর্ণ ওই এলাকার পাশে লিপুলেখ এলাকায় বর্ডার বাজার বসাতে চাইছে চীন ও ভারত। কিন্তু নেপালিরা মনে করে এই অঞ্চল আগে তাদেরই ছিল। ২০১৯ থেকে ভারত এটা তাদের মানচিত্রে দেখাচ্ছে এবং চীন সেটা মেনে নিয়েছে। সাধারণ নেপালিরা চায়- নেপাল সরকার শক্তভাবে কালাপানি এলাকার দাবিতে ভারত ও চীনের বিরুদ্ধে কুটনৈতিক লড়াইয়ে দাঁড়াক।

নেপালে পুনরায় রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে নাগরিক সমাজের অনেক প্রভাবশালী লোকজন এবং জেন-জিদের উচ্চবিত্ত অংশটি এবারের আন্দোলনে বেশ উৎসাহ দেখিয়েছে। যাদের মধ্যে নেতৃত্বে আছেন নেপালের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী দুর্গা প্রসাই। দুর্গা প্রসাই এবং নেপালের সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রের নাতি হিরেন্দ্র শাহ তরুণ সমাজের (জেন-জি) এই আন্দোলনে শুরু থেকেই শামিল হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তরুণ সমাজ (জেন-জি) তাদের প্রকাশ্যে আসতে নিষেধ করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সন্দেহ দ্বিতীয় দিনের সহিংসতায় এদের সক্রিয় সহযোগিতা রয়েছে।

নেপালে কে পি শর্মা অলি সরকারের পতনের পর দেশটির প্রশাসনিক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে না পড়লেও দেশটি এখন এক গভীর রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। আর দেশটির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে এখন থেকে তরুণ সমাজ (জেন-জি)-এর এক ধরনের অভিষেক ঘটল। ভবিষ্যতের ভোটের রাজনীতিতে এর একটা প্রভাব থাকবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, খুব দ্রুত যে নেপালে রাজনৈতিক সংকট কাটবে তা এখনই বলা কঠিন।

সর্ব শেষ বলব, নেপালের সরকার পতনের তারিখটা একটু খেয়াল রাখবেন- মাও সেতুং-এর মৃত্যু দিবসে মানে ৯ সেপ্টেম্বর চীন সমর্থিত কে পি শর্মা অলি সরকারের পতন ঘটেছে। ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে নেপালের সরকার ফেলে দেবার চিন্তা কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পনার অংশই নয় বরং চীনকে সুস্পষ্টভাবেই একটি বার্তা দেবার প্রচেষ্টারও অংশ।

রেজা ঘটক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ