স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের আত্মহত্যার রহস্য কী?
আত্মহত্যা মানুষের জীবনের এক চূড়ান্ত বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত। তীব্র মানসিক চাপ, শারীরিক অসুস্থতা, পেশাগত ব্যর্থতা, সম্পর্কের সমীকরণ ও অর্থ সংকটের হতাশাসহ নানা কারণে অনেকেই নিজের জীবন শেষ করে দেন। চিকিৎসক ও মনঃসমীক্ষণ বিদরা মনে করেন, খুব সম্ভবত একাধিক কারণ ও জটিল পরিস্থিতির কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তবে একক কোনো ঘটনার আঘাত তীব্র ও তীক্ষ্ণ হলেও যে কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন।
শনিবার মধ্যরাত থেকে ফেসবুক ফিডে ঘুরে ফিরে আসছে মোনালিসার মতো স্মিত হাসির ভীষণ মায়াবী এক মুখ। ছবিটি সাদাকালো। জীবনের এপিটাফের সঙ্গে অনেকটা মানানসই। ছবিটি একজন সৃজনশীল মানুষ স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের। একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন। সংবাদমাধ্যমটিতে ছবি নিয়েই ছিল তার কাজ। নিজের কল্পনা শক্তি আর সৃজনশীলতা দিয়ে সাজিয়ে তুলতেন অনলাইনটির ওয়াল। আজ তিনি নিজেই একটি ছবি হয়ে মানুষের দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাকে ঘিরে এখন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে গণমাধ্যম অঙ্গনে। এখনো মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে এটা অনেকটা নিশ্চিত যে স্বর্ণময়ী বিশ্বাস আত্মহত্যা করেছেন।
অকালেই ঝরে গেছে মাত্র ২৮ বছর বয়সী একটি তরতাজা প্রাণ। এই অপমৃত্যুর জন্য অনেকেই কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও হেনস্তার একটি অভিযোগ সামনে আনছেন। যথাযথ তদন্তের আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন, অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের অকাল প্রস্থান বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্র বিশেষ করে গণমাধ্যমের সংবাদ কক্ষে নারীদের যৌন হয়রানি ও হেনস্তার শিকার হওয়ার বিষয়টি নতুন করে সামনে এনেছে। যে বিষয়ে চর্চা ও আলোচনা হওয়া খুবই প্রয়োজন। আগামীতে কেউ যাতে স্বর্ণময়ীর ভাগ্য বরণ না করেন সেজন্য প্রয়োজন সতর্কতাও।
স্বর্ণময়ী বিশ্বাস যে গণমাধ্যমে কাজ করতেন, সেটি বড় বাজেটের নতুন গণমাধ্যম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের সংবাদ আধেয়তে পেশাদারিত্ব ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছে। সংবাদ উপস্থাপনা থেকে অনেক কিছুতেই প্রতিষ্ঠানটি বেশ পেশাদার। এই প্রতিষ্ঠানেই কিছু দিন আগে একজন বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ দিয়েছিলেন স্বর্ণময়ী বিশ্বাসসহ তার সহকর্মীরা। চলতি বছরের জুলাই মাসের ১৩ তারিখে সংবাদমাধ্যমটির প্রধান কর্তাব্যক্তি বরাবর দেওয়া সেই অভিযোগে স্বর্ণময়ীসহ অন্যরা বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন। তাতে স্বর্ণময়ী বিশ্বাসসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে জানান, প্রতিষ্ঠানটির বাংলা বিভাগের প্রধান ক্রমাগত নারী সহকর্মীদের নিপীড়ন করে যাচ্ছেন। যার মধ্যে আছে নারী সহকর্মীদের সঙ্গে ব্যবহার অযোগ্য কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ প্রয়োগ, বুলিং, ইঙ্গিতপূর্ণ তোষণ, নারী সহকর্মীদের যৌন জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা, মধ্যরাতে প্রয়োজন ছাড়া ফোন করা, নারী সহকর্মীদের নিয়ে প্রেক্ষাপট ছাড়া অস্বাস্থ্যকর মন্তব্যসহ ইত্যাদি।
বর্তমান সভ্যতায় কর্মক্ষেত্রে উল্লিখিত যে কোনো একটি আচরণই অনেক সংবেদনশীল ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ঔই চিঠিতে মোট ২৮ জন স্বাক্ষর করেছেন। যাদের মধ্যে স্বর্ণময়ী বিশ্বাসসহ অন্যান্য নারী সহকর্মীও রয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে যে কোন ধরনের যৌন হয়রানির অভিযোগ অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব অভিযোগের যেমন সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন আবার তেমনি অভিযুক্তের বিষয়টাও অনেক বেশ যত্নের সঙ্গে আমলে নেওয়া প্রয়োজন। কারণ বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় অনেক সময় বিশেষ উদ্দেশ্যে ও বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েও এমন অভিযোগ অনেকেই করে থাকেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ২০০৯ সালে যৌন হয়রানির সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।
আদালতের ওই রায় অনুযায়ী দেশের প্রত্যেকটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি-সংক্রান্ত কমিটি থাকার জন্য। অভিযোগের যথাযথ তদন্তে প্রতিষ্ঠানের বাইরের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠন করার কথা তদন্ত কমিটি। এমন বাস্তবতায় সংবাদমাধ্যমটির কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল এই অভিযোগগুলোর যথাযথ তদন্ত করা; কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এক্ষেত্রে এসব কিছুই করা হয়নি। বিপরীতে অভিযুক্ত অপরাধী স্বপদে বহাল থেকেছেন, হয়তো চালিয়ে গেছেন ঘৃণ্য নিপীড়ন।
বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারী নিপীড়ন বিশেষ করে যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতন নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের নারীরা এই ঘৃণ্য অপরাধের শিকার। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অফিসগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নেতৃত্বের পর্যায়ে নারীদের হার কম হওয়ায় এই নিপীড়নের মাত্রা বেশি। এছাড়া তথ্য প্রযুক্তি বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে এই নিপীড়ন ও নির্যাতন ভিন্ন রূপ পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটন অনেক সহজ হয়েছে।
২০২০ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নারী উন্নয়ন ফোরাম এবং অ্যাওয়ারনেস বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি জরিপ করেছিল। তাতে জানা যায় বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ নারী কর্মী শারীরিক বা মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। এ ছাড়া প্রায় ৪৩ শতাংশ নারীর কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এই জরিপে আরও উঠে আসে প্রায় ৩৫ শতাংশ নারী কর্মী তাদের সহকর্মী বা সুপারভাইজারের কাছ থেকে অশ্লীল মন্তব্য এবং আপত্তিকর আচরণের শিকার হন। ঔই জরিপে আরও উঠে আসে, প্রায় ৪০ শতাংশ নারী কর্মী জানিয়েছেন, কর্মস্থলে যৌন হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ জানালে কর্তৃপক্ষ সঠিক পদক্ষেপ নেয় না বা বিষয়টি উপেক্ষা করে। হয়তো ঠিক এই উপেক্ষারই শিকার হয়েছেন স্বর্ণময়ী বিশ্বাস। স্বর্ণময়ী বিশ্বাস ও তার সহকর্মীরা যে অভিযোগ দিয়েছিলেন তার শেষ লাইনে তারা লিখেছিলেন, ‘We therefor demand that this organization be responsible enough to solve theses issues and protect us from being traumatized in work place.
একজন নিপীড়কের বিরুদ্ধে এই আকুতি কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছালে হয়তো আজ একটি তাজা প্রাণ ঝরে যেতো না। হয়তো শরতের এই সকালে অন্য সবার সাথে স্বর্ণময়ী বিশ্বাসও আনন্দ খুঁজে নিতেন পারতেন নিজের কর্ম ও সৃজনশীলতায়।
অতি সম্প্রতি ইউনেস্কো বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল এই তিন দেশের গণমাধ্যমের সক্ষমতা (IPDC media viability Project) নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করছে। এই গবেষণায় ব্যবহার করা হচ্ছে বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম ডয়েচেভেলে ও উন্নয়ন সংস্থা ইউনেস্কোর এর গণমাধ্যম সক্ষমতার সূচকগুলো (Indicators)। এই সূচকগুলোর মধ্যে অন্যতম কর্মক্ষেত্রে নারী সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও যৌন হয়রানি-সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর যথাযথ প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ। এই প্রকল্পের একজন গবেষক হিসেবে আমি নিজে দেখেছি বাংলাদেশের ৮০ শতাংশের বেশি গণমাধ্যম অফিসে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত কমিটি নেই। এছাড়া বিভিন্ন অভিযোগের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রায় ৯০ ভাগের বেশি ক্ষেত্রেই থাকে উদাসীন। খুব সম্ভবত এমন উদাসীনতার-ই বলি হলেন স্বর্ণময়ী বিশ্বাস। কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনায় আমরা আর কোনো স্বর্ণময়ী বিশ্বাসকে হারাতে চাই না।
রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে