Views Bangladesh Logo

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এবারের ডাকসু নির্বাচন কীরকম প্রভাব ফেলতে পারে!

Kamrul  Ahsan

কামরুল আহসান

৯২৪ থেকে ২০২৫ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর ১০০ বছরের ইতিহাসে এবারের ডাকসু নির্বাচন কি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে? ইতিহাসের ঘটনাসমূহ কোনটার চেয়ে কোনটার গুরুত্ব বেশি তা নির্ধারণ করা কঠিন। তাৎক্ষণিকভাবে তা অনেক সময় সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আড়ালে পড়ে যায়, অনেক ছোটখাটো বিষয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্লেষণ, পক্ষপাতিত্ব- সব মিলিয়ে একেকটা ঘটনার ব্যাখ্যা হয় একেক রকম। তারপরও এ কথা স্পষ্টভাবেই বলা যায়, আমাদের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে, বিশেষ করে দেশভাগ-পরবর্তী বাঙালি-মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমানের সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি গঠনে ডাকসু এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।

দেশভাগের সময় ডাকসুর ভিপি মৌলভী ফরিদ আহমদের কথা আমরা অনেকেই হয়তো আজ ভুলে গেছি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন পর্যন্ত তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৬৩-৬৪ সালে রাশেদ খান মেনন যখন ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন এ দেশে বামধারার রাজনীতি তখন তুঙ্গে। তখনই জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী। পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক ভুলভ্রান্তি নিয়ে আমরা আজ আলোচনা করব না; কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুক্ত এবং তার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ গঠনে তাদের অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তেমনি অস্বীকার করার উপায় নেই ১৯৬৮-৬৯ সালে ভিপি নির্বাচিত তোফায়েল আহমেদের কথা, যার উদ্যোগে ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।

অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও আমরা ভুলতে পারব না আ. স. ম. আবদুর রবের কথা, ১৯৭০-৭১ সালের ডাকসুর ভিপি তিনি। তার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-জনতা সর্ব প্রথম উত্তোলন করে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তিনিই পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ উপাধি প্রদান করেন। পরবর্তীতে তার ও শাজাহান সিরাজের উদ্যোগে ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনও বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আমরা যদি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নাম নেই, ছাত্র ইউনিয়ন থেকে যিনি ১৯৭২-৭৩ সালে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তাতেও আমরা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতির একটা গতিধারা বুঝতে পারব। মাহমুদুর রহমান মান্না পরপর দুবার ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, ১৯৭৯-৮০ সালে এবং ১৯৮০-৮১ সালে। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি হিসেবে আজও তিনি রাজনীতির মাঠে সরব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর ভিপি হিসেবে সর্বশেষ নুরুল হক নুরের অবদান আমরা ’৯০ দশকের প্রজন্ম চোখের সামনে দেখলাম। প্রায় ২০ বছর স্থগিত থাকার পর ২০১৯-২০ সালে তিনি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের পর সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে হওয়া সেই নির্বাচনও দেশজুড়ে সাড়া ফেলেছিল। ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া নুরুল হক নুর এবং ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি ক্রমাগত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করতে থাকেন। বিগত ’২৪-এর অভূতপূর্ব জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। শুধু তার ব্যক্তিগত অবদান নয়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সমন্বয়ক হিসেবে যারা জনপ্রিয় হয়েছেন তাদের অনেকেই ছিলেন নুরুল হক নুরের দলের শিক্ষার্থী।

এমন এক প্রেক্ষাপটে, গণ-অভ্যুত্থানের ৫ বছর পর আজ মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর যে কোনো পর্যায়ে প্রথম নির্বাচন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। এ কারণে এই নির্বাচনে নজর পুরো দেশের। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনের আগে এই ছাত্র সংসদ নির্বাচনটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি লিটমাস টেস্ট। অতীতের নির্বাচনগুলোর চেয়ে নানা দিক দিয়ে এবারের নির্বাচনকে আলাদাভাবে দেখা হচ্ছে।

এবার প্রার্থী সংখ্যা অনেক বেশি। নারী প্রার্থীও আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় বেশি। তবে নারী প্রার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এবার ডাকসুতে ২৮টি পদের বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন ৪৭১ জন। ১৮টি হল সংসদে নির্বাচন হবে ১৩টি করে পদে। হল সংসদের ২৩৪টি পদের বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন এক হাজার ৩৫ জন। সব মিলিয়ে এবার ভোটারদের ৪১টি ভোট দিতে হবে। মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। নারী ভোটর প্রায় অর্ধেক ১৮ হাজার ৯৫৯ জন। ভিপি পদে মোট প্রার্থী হয়েছেন ৪৫ জন। তাদের মধ্যে পাঁচজন নারী। ডাকসুর বিভিন্ন পদে মোট নারী প্রার্থী আছেন ৬২ জন।

এবারের ডাকসু নির্বাচনকে সুস্থ ধারার রাজনীতিতে ফেরার এক সুযোগ ও প্রত্যয় হিসেবে দেখছেন শিক্ষার্থী ও রাজনীতিবিদরা। জনগণেরও আশা তাই। প্রার্থীরা প্রত্যেকেই এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, তারা রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখবেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আচরণে গণতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতিফলন ঘটানোর শপথ নিয়েছেন প্রার্থীরা। তারা শপথ নিয়েছেন, ফ্যাসিবাদী শাসনামলের ঘৃণিত গণরুম প্রথা, গেস্টরুম নির্যাতন, জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য বাধ্য করানো, ভিন্নমতের জন্য অত্যাচার-নিপীড়ন চালানোর যে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল যে কোনো মূল্যে ক্যাম্পাসে তা আর কখনো ফিরে আসতে দেয়া হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে আটটি ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছিল। শেষ হলো বিকেল চারটার সময়। এখন ফলাফলের অপেক্ষা। উপাচার্য বলেন, ‘কার্জন হলে ভুলক্রমে একটি ছোট সমস্যা হয়েছে। তার জন্য আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। তবুও এই ঘটনার আমরা পুনরায় তদন্ত করে কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেব।’ উল্লেখ্য, কার্জন হলে এক ভোটারকে দুটি ব্যালট দেয়া হয়েছিল। পরে পোলিং অফিসারকে প্রত্যাহার করা হয়। টিএসসির কেন্দ্রে ‘ক্রস চিহ্ন’ দেয়া একটি ব্যালট একজন ভোটারকে দেয়ার অভিযোগ সম্পর্কে উপাচার্য বলেন, ‘এখানেও আমরা সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। ডাকসু নির্বাচন এখন দেশের দাবিতে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, ‘আমরা আশা করছি, যিনি জিতবেন এবং যিনি বিজেতা হবেন সবাই ফলাফল মেনে নেবেন। তারা স্বীকার করবেন যে, কোথাও কোনো স্বচ্ছতার ঘাটতি নেই।’

সব ঠিকঠাক থাকলে আজ রাতের মধ্যেই চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে। আর আগামীকাল বা তার পরদিন, কিংবা আগামী সপ্তাহ, আগামী মাস এবং নির্বাচনের আগে আগেই মোটামুটি অনুমান করা যাবে যে, ডাকসু নির্বাচন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কীরকম প্রভাব ফেলবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ