দেখে এলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দার্জিলিং
দার্জিলিং ‘পাহাড়ের রানি’ নামে পরিচিত। গত বছর সপরিবারে দার্জিলিং গিয়েছিলাম। প্রথমে আমরা ঢাকা থকে কোলকাতা যাই। তারপর সেখানে পৌঁছানোর পর খুব ভোরে হাওড়া রেলস্টেশনে পৌঁছি এবং বন্দে ভারত নামের ট্রেনে করে জলপাইগুড়ি যাই। এটি পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন হিসেবে পরিচিত। আমাদের বহনকারী ট্রেন সকাল সাড়ে ৬টায় যাত্রা শুরু করে। ট্রেনে লাঞ্চ এবং ব্রেকফাস্ট প্যাকেজ ছিল। তারা সকাল ৭টায় ব্রেকফাস্ট দেয়। খাবার মেন্যুতে ছিল পাউরুটি, মাখন, সবজি, ডিম, চা এবং জুস। ট্রেনে যাওয়ার সময় আশপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো উপভোগ করি।
এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। ট্রেন থেকে তিস্তা ব্যারেজ দেখলাম। আগে অনেকবার তিস্তা ব্যারেজের কথা শুনলেও বাস্তবে কখনো দেখা হয়নি। আরও দেখলাম নদী, পশুপাখি, সুন্দর আকাশ। আমাদের বহনকারী ট্রেন দুপুর ১টায় জলপাইগুড়ি পৌঁছে। আমাদের দার্জিলিং পৌঁছে দেয়ার জন্য একটি গাড়ি অপেক্ষা করছিল। আমরা জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং যাই। জলপাইগুড়ি আর শিলিগুড়ির আবহাওয়া ছিল গরম। ভারতে প্রচুর গরু পাওয়া যায়। রাস্তায় গরু ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। আমরা গাড়িতে থাকা অবস্থায় অনেক গরু রাস্তায় এবং আশপাশের জমিতে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। আমি ড্রাইভারের কাছ থেকে জানতে পারি পথচারীর আঘাতে কোনো গরু মারা গেলে বা আহত হলে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। কাজেই রাস্তায় যারা গাড়ি চালান তারা অত্যন্ত সতর্ক থাকেন যেন তাদের গাড়ির আঘাতে কোনো গরু আহত বা নিহত না হয়। দার্জিলিং পৌঁছুতে আমাদের দেড় ঘণ্টা সময় লেগেছিল। পাহাড়ের শীতল বাতাস আমাদের দেহ-মন সতেজ করে তুলেছিল। আমরা স্বর্গীয় প্রশান্তি অনুভব করি।
প্রবাহিত বাতাস নির্মল এবং প্রাণ জুড়ানো। দার্জিলিংয়ের বাতাস শহরের মতো দূষিত নয়। আমরা যে হোটেলে ছিলাম তা সমতল ভূমি থেকে সাড়ে ৭ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। আমার মনে হচ্ছিল আমরা আকাশের কাছাকাছি চলে এসেছি। এখান থেকে হাত বাড়ালেই বুঝি আকাশ ছোঁয়া যাবে। আমরা মেঘের নাগাল পাচ্ছিলাম। আমি হাত বাড়িয়ে মেঘ ছুঁয়েছিলাম। তখন ছিল বর্ষাকাল। সারা দিনই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। সূর্যের মুখ খুব একটা দেখা যাচ্ছিল না। দিন গড়িয়ে যাচ্ছে অথচ সূর্য দেখতে পাচ্ছি না। আমার জন্য এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। দার্জিলিংয়ের আবহাওয়া সবসময়ই মেঘলা থাকে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। সারা দিন বৃষ্টি হলেও রাস্তায় কোনো পানি জমে না। কারণ সেখানকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই ভালো। মেঘ স্পর্শ করার পর আমার কেবলই মনে হচ্ছিল মেঘগুলো শুধু জলবিন্দু। পাহাড়ের বিভিন্ন গাছে প্রচুর ফুল দেখতে পেলাম। ফুলগুলো খুবই সুন্দর এবং উজ্জ্বল বর্ণের। আবহাওয়া যেহেতু কুয়াশায় ঢাকা ছিল তাই ড্রাইভারকে খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল। পাহাড়ের রাস্তা জিগজ্যাক আকৃতির এবং মাঝে মাঝে তা সংকীর্ণ হয়ে থাকে।
দার্জিলিংয়ে প্রচুর নেপালি নাগরিক দেখতে পাওয়া যায়। কারণ দার্জিলিং এবং নেপালের মধ্যে সীমান্ত রয়েছে। আমরা যে গাড়িতে যাচ্ছিলাম তার চালকও নেপালি। নেপাল থেকে অনেক মানুষ সকালবেলা দার্জিলিংয়ে আসে। কাজ শেষ করে বিকেলে আবার নেপালে ফিরে যান। আমরা বিকেল ৫টায় হোটেলে পৌঁছি। হোটেলের বেশিরভাগ স্টাফ নেপালি। তারা আচরণে ভদ্র এবং বিনয়ী।
আমরা যে হোটেলে উঠি তার নাম পিঙ্ক মাউনটেইন। আমি হোটেল কক্ষে প্রবেশ করে যারপরনাই অবাক হই। কারণ হোটেল রুমে কোনো ফ্যান বা এসি নেই। পরে অবশ্য আমি জানতে পারি দার্জিলিংয়ের বেশিরভাগ হোটেলে এসি বা ফ্যান থাকে না। কারণ এখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত শীতল। ফলে এসি বা ফ্যানের প্রয়োজন হয় না। আমরা যে হোটেলে উঠি তার অবস্থান দার্জিলিং ক্লকের কাছাকাছি। ফ্রেশআপ সেরে আমরা নিকটস্থ শপিং কমপ্লেক্সে গেলাম। সেখান থেকে কিছু শীতের কাপড় কিনলাম। এরপর নিকটস্থ একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার গ্রহণ করি এবং হোটেলে ফিরে আসি। এখানে থাকাকালে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়। আমরা আমাদের জামাকাপড় ধৌত করার জন্য লন্ড্রিতে পাঠিয়েছিলাম। কয়েকটি কাপড় ধৌত এবং ইস্ত্রি করার জন্য বিল করা হয় ২ হাজার ২০০ রুপি। ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে এখানে কাপড় পরিষ্কার করা এবং শুকানো খুবই কঠিন।
পরদিন আমাদের হোটেলে নাশতা করি। খাবার মেন্যুতে ছিল রুটি, মাখন, পুরি (লুচি), ছোলা, চুড়া পোলাও (চিড়ার পোলাও)। চুড়া পোলাও ভারতের বিখ্যাত খাবার; কিন্তু সত্যি বলতে কি এই খাবার আমার ভালো লাগেনি। খাবার গ্রহণ করার পর আমরা পিস প্যাগোডা নামে একটি বিখ্যাত প্যাগোডা দেখতে গেলাম। প্যাগোডার রং ছিল পুরোপুরি সাদা। প্যাগোডা দেখার পর আমরা ‘হিমালয়ার জু’ দেখতে গেলাম। এটি অত্যন্ত বিখ্যাত একটি চিড়িয়াখানা। সেখানে অনেক প্রাণী দেখতে পাই। চিড়িয়াখানাটি মেঘের মধ্যে ছিল। আমরা সেখান থেকে স্থানীয় একটি চা বাগানে যাই। চা বাগান পরিদর্শনকালে আমরা দুই ধরনের চা পান করি, যার নাম দার্জিলিং চা এবং মশলা চা। আমার ক্ষুদ্র জীবনে যতবার চা পান করেছি তার মধ্যে দার্জিলিং চা এবং মশলা চা গুণগতমানের দিক থেকে সবচেয়ে সেরা। এই চায়ের স্বাদ মনে হয় এখনো আমার জিভে লেগে আছে। চা বাগানের পাশে চা পাতা বিক্রি করা হয়। আমরা সেখান থেকে বেশ কিছু চা পাতা ক্রয় করি। দার্জিলিং হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম সেবা চা উৎপাদনকারী এলাকা। দার্জিলিংকে প্রায়শই ‘চায়ের স্যাম্পেন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দার্জিলিংয়ের চায়ের বাগানগুলো অসাধারণ। দার্জিলিংয়ের কমলা আর আপেলও অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত।
আমরা সেখানকার বেশ কিছু মঠ পরিদর্শন করি। এগুলো সত্যি খুব সুন্দর। এরপর আমরা সেইন্ট পলস স্কুল নামে একটি বিখ্যাত স্কুল পরিদর্শন করি। স্কুলটি সুটিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। স্কুল পরিদর্শনকালে আমার শুধু মনে হচ্ছিল, আহ্ আমি যদি এই স্কুলে পড়তে পারতাম তাহলে কতই না ভালো হতো। স্কুলটি চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত ছিল। এরপর আমরা বাতাসিয়া লোপে যাই। এটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাফল্যের গল্প ধারণ করে। সেনা সদস্যদের জন্য প্রবেশদ্বারটি উন্মুক্ত। দার্জিলিং শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এখানে কিছু রোপওয়ে ছিল। দার্জিলিংয়ের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে ‘টয় ট্রেন’। সব বয়সী মানুষই টয় ট্রেন উপভোগ করতে পারে। এটি একটি দুর্দান্ত রাইড। পরের দিন আমরা গেলাম টাইগার হিলে। নেপাল না গিয়েও এখান থেকে হিমালয় পর্বত দেখা যায়। টাইগার হিল থেকে আমরা বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত হিমালয় দর্শন করি। এরপর আমরা সেঞ্চাল যাই। সেঞ্চাল দেখা শেষে আমরা মিরিক লেক গেলাম। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য নৌকায় চড়ার ব্যবস্থা আছে। ইচ্ছে করলে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানো যায়। মিরিকের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে এই লেক।
দার্জিলিংয়ের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আমাকে বিস্মিত করে। তারা অত্যন্ত পরিশ্রমী। পাহাড়ের চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে তাদের প্রতিনিয়তই প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। এখান মানুষ অত্যন্ত পরিশ্রমী হলেও শান্তিপ্রিয় এবং বন্ধুবৎসল। বখু বা চুবা দার্জিলিংয়ের মানুষের পোশাক। দর্শনার্থীদের দার্জিলিং সফরকালে স্থানীয়দের পোশাক পরিধানের ব্যবস্থা ছিল। আমাদের দেশে সাধারণত গ্যাস সিলিন্ডার বয়ে নেয়ার জন্য ট্রাক ব্যবহার করা হয়। আর দার্জিলিংয়ের মানুষ দু-একটা গ্যাস সিলিন্ডার স্থানান্তর করতে হলে পিঠে বয়ে নিয়ে যায়। আমাদের দেশের পার্বত্য এলাকার মানুষ যেমন পরিশ্রমী দার্জিলিংয়ের মানুষও তেমনি। নেপালের কিছু মানুষ প্রতিদিনই ভারতে আসে কাজের জন্য এবং কাজ শেষে ফিরে যায়। তাদের কোনো ভিসার প্রয়োজন হয় না।
দার্জিলিংয়ের খাবারগুলো সাধারণত খুবই নোনতা হয়। কারণ তারা খাবারে বেশি পরিমাণে লবণ ব্যবহার করে। শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য তাদের প্রচুর লবণের প্রয়োজন হয়। তাই তারা খাবারে বেশি পরিমাণে লবণ ব্যবহার করে। মিরিক ভ্রমণ শেষে আমরা এক নেপালি রেস্টুরেন্টে যাই দুপুরের খাবার গ্রহণ করা জন্য। খাবারের মেন্যুতে ছিল মাছ, গরুর গোশত, ডাল, পাঁপড়, সাদা ভাত ও সবজি। খাবারের সঙ্গে তারা একটি ছোট মরিচ পরিবেশন করে। এই মরিচ শুধু পাহাড়েই পাওয়া যায়। মোমো হলো দার্জিলিংয়ের একটি বিখ্যাত খাবার।
আমার দার্জিলিং ছেড়ে আসার জন্য যাত্রা শুরু করি; কিন্তু আমার মন চাইছিল না যে দার্জিলিং ছেড়ে চলে আসি। এটি আমার জীবনের একটি অসাধারণ জার্নি। দার্জিলিংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়।
আমরিন হোসেন অপস্বরা: শিক্ষার্থী।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে