Views Bangladesh Logo

কেমন ছিল একাত্তরের গ্রাম

Afsan  Chowdhury

আফসান চৌধুরী

[২০০২ সালে ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’ নামে একটি ইতিহাস প্রকল্পের কাজ শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরী। এই কাজের অংশ হিসেবে ২০০৭ সালে ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’ নামের চার খণ্ডের একটি বই বের হয়। ২০১৩ সালে ‘গ্রামের একাত্তর’ নামে আরেকটি প্রকল্প শুরু হয়। সেই প্রকল্পের তথ্য থেকে ‘গ্রামের একাত্তর’ নামে উনার সম্পাদনায় একটি বই প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। লেখকের 'গ্রামের একাত্তর' থেকে ভিউজ বাংলাদেশ এর বিজয় দিবসের আয়োজন 'কেমন ছিল গ্রামের একাত্তর?']

গ্রামের একাত্তর
মুক্তিযুদ্ধের সময়টা একেক মানুষের জন্য একেকরকম ছিল। গ্রামের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সে অর্থে একাত্তরের বাস্তবতা ভিন্ন ভিন্ন হলেও, বেশিরভাগ মানুষ একই ধরণের সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে, বেঁচে থাকার জন্য তাদের পালাতে হয়েছে। এ কারণে সমাজের অবস্থা এত নড়বড়ে হয়ে উঠেছিল যে, এই সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা লুটতরাজ শুরু করেছিল।বিশেষ করে রাজাকার বাহিনী গঠন করার পর, মানুষের অবস্থা ছিল অকল্পনীয় ভাবে নাজুক। সে অবস্থার কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হলো।

বাধাগ্রস্ত জীবনযাত্রা
যুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলো কেটেছে ভয়াবহ আর্থিক ও খাদ্যের কষ্টে। যুদ্ধের কারণে স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, অর্থনৈতিক কাঠামোও দুর্বল হয়ে যায়। এই অবস্থায় কর্মসংস্থানের জন্য ঘরের বাইরে বের হওয়াও ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। যে কোনো স্থানে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকত। পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকাররা সার্বক্ষণিক মুক্তিবাহিনী বা তাদের সহযোগীদের চলাফেরার উপরে নজর রাখত। আর স্থানীয় রাজাকাররা সুযোগ পেলে পথযাত্রীদের মালামাল নিয়মিত লুট করত। এসব কারণে অনেকেই তাদের যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছিল। প্রয়োজন ছাড়া বাজার বা রাস্তায় কম গেছে। তবে এর মধ্যেও রুটি-রোজগারের প্রয়োজনে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গেছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।

গ্রামের স্কুলের অবস্থা
একাত্তর সালে গ্রামের স্কুলগুলো চালু থাকলেও শিক্ষার্থীরা খুব একটা যায়নি। সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, কিছু স্কুল খোলা থাকলেও শিক্ষকরা কেবল চাকরি রক্ষার জন্য স্বাক্ষর করতে যেতেন। সেদিক থেকে বাচ্চাদের ওই সময়ে খেলাধুলা করার সুযোগ বেশি ছিল। নিজের পরিবার, গ্রাম, অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত না হলে তাদের জন্য এটি একটি মিশ্র অভিজ্ঞতার সময় ছিল। কারণ দুশ্চিন্তা ছিল সবার নিত্যসঙ্গী।

ধর্মীয় জীবন
মানুষের জীবন ও ধর্মচর্চার ওপরও যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মসজিদের ইমামরা যুদ্ধ বা পাকিস্তানের পক্ষে জুম্মার নামাজে খুৎবা দেয়নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ইমামরা এ কাজটি করেছে। অনেক ক্ষেত্রে মসজিদের ইমাম নিজেও নির্যাতনের একজন ভুক্তভোগী ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে তাদের চলতে হয়েছে গ্রামবাসীদের সহায়তা নিয়ে।


হিন্দু জনগাষ্ঠীর জন্য ধর্মচর্চা ছিল সরাসরি বিপদের ব্যাপার। তারা ছিল পাকিস্তানিদের চিহ্নিত শত্রু। তাই গোপনে ধর্মপালন ছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিল না প্রায় সব ক্ষেত্রেই।

প্রতিরোধ ও প্রস্তুতি
১৯৭১ সালে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ দুটিই ছিল। অর্থাৎ পাকিস্তান আর্মি ও তাদের সহযোগীদের ঠেকানোর চেষ্টা যেমন হয়েছে, তেমনিভাবে তাদের হাতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। স্মরণীয় যে, উনসত্তরের আগে বাংলাদেশের গ্রামগুলো জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে এতটা সম্পৃক্ত ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচন এই অবস্থাটা পাল্টে দেয় এবং ১৯৭১ সালের মার্চের পরে মানুষের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টি হয়।

সুন্নতে খাতনা ও বিয়ে
কুষ্টিয়ার হাজী আবদুল কাদের বলেন, “যুদ্ধ চলার সময় বিয়ে-আকিকা হয়েছে। তবে মুসলমানি (সুন্নতে খাতনা) হয়নি।” দৌলতপুরের রিয়াজ উদ্দীনও একই কথা বলেন।
বিভিন্ন বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, একাত্তর সালে যুদ্ধ চলার সময় বিয়ে হয়েছিল। তবে অনুষ্ঠান কম হয়েছিল। আবার অনেকে বলেছেন, বিয়ে-শাদি সম্ভব ছিল না। কোথাও কোথাও জোর করে বিয়ের ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ স্থানে মুসলমানদের বিয়ে হয়েছে, হিন্দুদের তেমন বিয়ের ঘটনা খুব কম পাওয়া যায়।

সন্তান জন্মাদান
গ্রামে সন্তান প্রসব করানোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় কাজ করেছে দাইরা। মাঝে মধ্যে কোনো জায়গায় চিকিৎসক পাওয়া যেত। কুষ্টিয়ারর হাজী মো. আবদুল কাদের জানান, তাদের এলাকায় সন্তান প্রসবের সময় একজন হিন্দু নারী মারা গিয়েছিলেন।

রমজানে রোজা রাখা
বিভিন্ন স্থান থেকে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধারা এসে থাকত জয়নাল আবদীন চৌধুরীর বাড়িতে। খাওয়া-খাওয়ার ব্যবস্থা হতা তাঁর বাড়িতেই। তাঁর স্ত্রী মহিতোন্নেছা বলেন, “আমরা তো রোজা রাখতাম। দুই-চারজন থাকত। শেষরাত্রি তাগেরও আমরা খাওয়াতাম। শীত ছেল। এসব মানুষ রোজা রাখলি সওয়াব অবে, সেই আশায় আরো বেশি করতাম। বিপদে পড়ে আইছে।”
কলাবড়িয়া গ্রামের রজব আলী মোল্লা বলেন, “রোজা রাখত অনকেই। অভাবের মধ্যি যে খাবার পাত তাই খেয়েই। তবে রমাজান যেভাবে সাড়া ফ্যালে তা ফেলত পারিনি।”

ঈদ
কুষ্টিয়ার হাজী মো. আবদুল কাদের বলেন, “ঈদের নামাজ ঈদগাহে হয়েছিল, তবে জাঁকজমক হয়নি। মসজিদে তারাবির নামাজের ব্যবস্থাও হয়েছিল।”
কালিয়ার চাঁদপুর গ্রামের মওলানা মো. ফজলুল হক বলেন, “প্রচণ্ড অভাব ও শীতে রোজা থাকা ছিল কষ্টকর। তারপরও থাকিছি। ঈদি কোনো নতুন জামাকাপড় কিনতি পারিনি।”
মহিতোন্নেছা বলেন, “ঈদে আনন্দ? ঈদের দিনই তা এহানে যুদ্ধ অল। মুক্তিবাহিনী যারা ইন্ডিয়াতে আসত আর ওরা (রাজাকার ও মিলিশিয়া) সব সময় লাইগে থাকত।”

রোগ ও চিকিৎসা
গ্রামে সাধারণত জ্বর, সর্দি, কাশি, আমাশয় ও কলেরা রোগ হতো। যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত, ডাকাতি ও লুট করতে গিয়ে আহত কিংবা ডাকাত ও লুটেরার হাতে নানাভাবে লোকজন আহত হত। এসব রোগের চিকিৎসা পল্লী চিকিৎসকরাই করতেন। পল্লী চিকিৎসকের কাছে ওষুধ থাকত। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। বাজারের ওষুধের দোকানগুলো সুযোগ বুঝে খোলা হতো। তখন ডাক্তার রোগীরা ওষুধ সংগ্রহ করতেন।

কেনা- বেচা ও অভাব
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মোহাম্মদ আলী মণ্ডল জানান, তিনি বাড়ির কাঁসার ব্যবহার্য তৈজসপত্রগুলো দশ টাকা মণ হিসেবে বিক্রি করেছেন। দাম বেশি হওয়ায় লবণ ছাড়াই খাবার খেতেন। ছোলার দাম ১০ টাকা মণ, কাপড় একটা পাঁচ থেকে ছয় টাকা। লুঙ্গি একটা এক টাকা ২৫ বা ৫০ পয়সায় পাওয়া যেত।

মানুষের আহার-অনাহার
মুক্তিযোদ্ধা শরীফ আবদুল মান্নান লিখেছেন, ১৯৭১ সালের অক্টোবর থেকে সাধারণ জনগণের ও মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সংকট দেখা দেয়। ওই সময় হাট-বাজার প্রায় অচল অবস্থায় ছিল। অল্প কিছু এলাকায় শাপলা ও কচুর লতি বা মোথা দিয়ে জাউ রান্না করে খেয়ে জীবনধারণ করতে হয়েছে। গরুর মাংস খুব সস্তা ছিল। রাজাকাররা গ্রাম থেকে গরু ধরে নিয়ে জবাই করত। রাজাকার ও মিলিশিয়াদের মাংসের চাহিদা পূরণ করে বাকি অংশ এক টাকা, এক টাকা চার আনা করে বিক্রি করত।

মজুরি
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মোহাম্মদ আলী মণ্ডল জানান, তখন কামলার মজুরি ছিল পেট-ভাত। দু-চার আনা যা পেত তাতেই খুশি থাকত। বিমল দাশ বলেন, “গেরস্তরা কাজের জন্যি কামলাদের খাবার দেত। মানুষি খাটলে এক টাকা দেত।

হাট-বাজার
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মো. আবদুল কাদের জানান, চিথিলিয়ায় সবে ছোট একটি বাজার চালু হয়েছিল। সেখানে বৃহস্পতি ও রোববার হাট বসত। শুধু সবজি পাওয়া যেত।
দেশের আরো বিভিন্ন স্থানে হাট-বাজার বসত। তবে, বেচা-কেনা ছিল খুবই কম। জিনিশপত্রও তেমন পাওয়া যেত না। কয়েক কিলোমিটার হেটে গিয়ে বাজার করতে হতো। সন্ধ্যার মধ্যেই বাজার বন্ধ হয়ে যেত। অনেক জায়গাতেই বাজার পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। লুট-তরাজও ছিল নিয়মিত ঘটনা।

রাজাকার
রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে প্রধানত বিত্তহীন শ্রেণির গ্রামের মানুষ যাদের মধ্যে অপরাধমূলক প্রবণতা ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। রাজাকার হওয়ার পেছনে উৎসাহ জুগিয়েছে নিয়মিত আয় ও লুটের ভাগ পাওয়ার সুযোগ। রাজাকারদের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। তবে অনেকেই ছিল গ্রামের প্রভাবশালী মানুষের অনুসারী। যে সম্পর্ক তাদের রাজাকার হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

তরুণ ও হিন্দুদের বিপদ
বিপদ বেশি ছিল তরুণদের। কারণ তাদের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি। অর্থাৎ পাকিস্তানিদের আগামী শত্রু। তাই অনেকেই পালিয়ে থেকেছে। বাড়িতে থেকেছে কেবল নিরাপদ বোধ করলে। নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছে। পথেক অনেকের বাড়িতে আশ্রয় থেকেছে, কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে মারা গেছে।

নারী নির্যাতন ও মোকাবিলা
সংগৃহীত তথ্য থেকে বোঝা যায়, নারীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন হয়েছে। নারীর নাজুকতা ও পরিসরের ওপর এই নির্যাতনের ধরন ও মাত্রা নির্ভর করেছে। সাধারণভাবে নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হন এবং প্রায় সব ক্ষেত্রে এটি ঘটেছ পাকিস্তানপন্থি বিভিন্ন লোকের হাতে। যুদ্ধের সময় সবাই বিপদে থাকলেও নারীরা ছিলেন অধিক বিপদগ্রস্ত।

হঠাৎ করে গ্রামে আর্মি আসার খবর শুনলেই নারী-পুরুষ সবাই যেখানে পেরেছেন লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেছেন। তারা পুকুর- ডোবা, বন-জঙ্গলে পালিয়েছেন। বাংলাদেশের গ্রামের অনেক মানুষের জন্য এই নিরাপত্তাহীনতা ছিল প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ