Views Bangladesh Logo

আর্থিক শৃঙ্খলা ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সংস্কারের উদ্যোগ

০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতির ঘোষণা উপলক্ষে সম্প্রতি একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক । আসন্ন মুদ্রানীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয় এই সভায়। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ নীতিগত সুদের হার বহাল থাকা, বেসরকারি খাতে বিশেষ করে CMSME খাতের জন্য ঋণ সুবিধা সংকুচিত হয়ে যাওয়া, উচ্চ পরিমাণে অক্ষম ঋণ (NPL), বিনিয়োগে স্থবিরতা, নতুন বিনিয়োগে ‘অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ’ প্রবণতা এবং বিদ্যমান বিনিয়োগ ইত্যাদি বিষয় ঘিরে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এই আলোচনা সভায়।


মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দেয়ার জন্য যে সক্ষমতা দরকার তা বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘হাইপার-অ্যাকটিভ’ ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে স্থিতিশীল ব্যবস্থাপনার নীতি গ্রহণ করেছে। বর্তমানে নীতিগত সুদের হার ও মুদ্রাস্ফীতির হারের মধ্যে পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশ। ভবিষ্যতে মুদ্রাস্ফীতির হার আরো কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটা নীতিগত সুদের হার কমানোর সুযোগ সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, মুদ্রাস্ফীতির গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ নীতিগত সুদের হার হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সাম্প্রতিক ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ শতাংশ। তবে উচ্চ সুদের হার এবং বিনিময় হারজনিত চাপ গ্রাহকদের ওপর বড় ধাক্কা তৈরি করেছে। বেসরকারি খাত মনে করছে, মূলধনি ব্যয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে নীতিগত সুদের হার কমানো জরুরি। ব্যাংকিং খাতে আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয়, বিপুল পরিমাণ অক্ষম ঋণ, যার পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। বিশেষ করে সোনালী ব্যাংকের অক্ষম ঋণের হার ১৯ শতাংশ। যা পরিস্থিতির জটিলতা তুলে ধরে। তবে গত ১০ মাসে এর প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কম ছিল, যা ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। পরামর্শ সভায় মত প্রকাশ করা হয়, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা অক্ষম ঋণের ব্যবস্থাপনায় জটিলতা তৈরি করতে পারে। এখন বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার নতুন যুক্ত হওয়া অক্ষম ঋণের কতটা উন্নত হিসাব প্রণয়ন পদ্ধতির ফলে চিহ্নিত হয়েছে এবং কতটা দেশের মন্দা ভাবাপন্ন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ফল। এই বিশ্লেষণ মুদ্রানীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি, যাতে প্রকৃত চিত্র স্পষ্টভাবে উঠে আসে।

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। রাজস্ব পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার মূলত নির্ভর করেছে তফসিলভুক্ত ব্যাংকগুলোর ওপর, যেখান থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, যা রাজস্ব আদায়ের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই ঘাটতি পরবর্তী অর্থবছরেও অব্যাহত থাকলে সরকারের ঋণ গ্রহণের ওপর চাপ আরও বেড়ে যাবে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের ঝুঁকি এড়িয়ে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত অর্থনীতিতে এর প্রকৃত প্রভাব মূল্যায়নের জন্য এসব সংবেদনশীল দিকগুলো বিবেচনায় নেওয়া। পাশাপাশি, সরকারের ক্রয়মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ায় অর্থের প্রয়োজনীয়তা আরও অনেক বেড়েছে।

বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক । ২০২৪ সালের জুলাইয়ে যেখানে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, সেখানে তা কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ২০২৬ সালের জুন নাগাদ এ হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে শ্রমের মজুরি বৃদ্ধির হার এখনও মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে নিচে, যা ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের সঙ্গে মিলে অর্থনীতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যপণ্যে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছ। প্রায় ১০% থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশে। যদিও এটি স্বস্তির বিষয়, তবে খাদ্যপণ্য হিসেবে গণ্য নয় এমন পণ্যে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। এটা সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি আরও কমিয়ে আনার পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুদের হার বর্তমানে তুলনামূলকভাবে বেশি, বিশেষ করে কুটির শিল্প, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য। এই পরিস্থিতিতে ঋণ সহায়তা সহজ করতে ক্রেডিট রিস্ক প্রাইসিং এবং নীতিগত নির্দেশক পুনর্বিন্যাসসহ ধারাবাহিক অপ্টিমাইজেশন-সংক্রান্ত নীতিগত উদ্ভাবন দ্রুত বাস্তবায়নের প্রয়োজন রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৫ সালের ১৯ মার্চ একটি নতুন মাস্টার সার্কুলার জারি করেছে, যেখানে অনানুষ্ঠানিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ওই সার্কুলারে সেবা ও ট্রেডিং খাতের জন্য ঋণসীমা উৎপাদন খাতের তুলনায় বেশি বাড়ানো হয়েছে। তবে বর্তমানে উচ্চ সুদের হার বিবেচনায় এই নীতিমালা পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে, যাতে উৎপাদন খাতের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা নিশ্চিত করা যায়। এছাড়া রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (এডিএফ)-এর পরিমাণ সম্প্রতি কমে গেছে। এর বিকল্প হিসেবে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতে নগদ প্রবাহ (ইএফপিএফএস) চালু করা হলেও, এটি রপ্তানিকারকদের মধ্যে তেমনভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি বা জনপ্রিয় হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে রপ্তানি খাতের জন্য একটি বাস্তবমুখী, কার্যকর এবং বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষণীয় অর্থায়ন কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে একাধিক নীতিমালা গ্রহণ করেছে। এসব নীতির আলোকে প্রতিবারই ঋণ টেকসইয়ের বিষয়টি মূল্যায়নের কথা বলা হয়। তবে বাস্তবে প্রধান উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ঋণ নয়, বরং রাজস্ব আয়। এই সংকট মোকাবেলায় সুশাসন ও প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বৈদেশিক ঋণ প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বাড়লেও তা এখনো পরিচালনযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে গেলে তা অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করতে পারে, সেজন্য এখন থেকেই সতর্ক হওয়া জরুরি।

সরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগের লাভ বা আর্থিক প্রতিফল যথাযথভাবে হিসাব করা প্রয়োজন, যেন তা বাস্তবসম্মত ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়। একই সঙ্গে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত সিদ্ধান্ত পরিহার করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে রাষ্ট্রের আর্থিক ভারসাম্য বিনষ্ট না হয়। স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য উন্মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার সহজলভ্যতা একটি ভালো লক্ষণ। বিনিময় হার স্থিতিশীল না থাকলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। আমাদের কৃষি ও জ্বালানি নীতি এখনো অক্ষত। ব্যাঘাত এবং অন্যান্য কারণে পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

উন্মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থায় বিদেশি মুদ্রার সহজলভ্যতা একটি আশাব্যঞ্জক দিক, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এ স্থিতিশীলতা টেকসই করতে হলে অবশ্যই বিনিময় হারের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। কারণ বিনিময় হার অস্থির হলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সম্প্রতি পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, যার পেছনে রয়েছে সরবরাহ বিঘ্ন, বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতা ও অন্যান্য কাঠামোগত কারণ। এসব মূল্যবৃদ্ধি দেশীয় উৎপাদন ব্যয় ও ভোক্তা পর্যায়ে খরচ বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসের দাম সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানয় এবং অন্যান্য কারণের ফলে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে দুই দফা নিলামের মাধ্যমে ৪৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা) কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। যা দেশের চলতি হিসাব ভারসাম্য পরিস্থিতি উন্নয়নের লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিতে লিকুইডিটি বা তরল অর্থের সরবরাহ বাড়ানো জরুরি, বিশেষ করে পুঁজিবাজারে। ইতিমধ্যে কিছু তরল অর্থ বাজারে ফিরতে শুরু করেছে, যা পুঁজিবাজারে সক্রিয়তা ও আস্থা ফেরাতে সহায়ক হতে পারে। তবে পুঁজিবাজারে টেকসই ইতিবাচক পরিবর্তন অনেকটাই নির্ভর করবে সামগ্রিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর- যেমন মুদ্রাস্ফীতি, বিনিময় হার, সুদের হার ও বিনিয়োগ পরিবেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ধরনের নীতি উদ্যোগ বাজারে স্থিতিশীলতা ও আস্থা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (এফডিএফ) সংক্রান্ত আলোচনায় উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির কারণে এফডিএফের পরিমাণ কমানো করা হয়েছে। রিজার্ভের অবনতিশীল অবস্থা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফকে আশ্বস্ত করেছে যে, রিজার্ভ আর কমবে না, এবং আইএমএফ-এর পরিমাণও আর কমানো হবে না। কারণ এটি রিজার্ভ ব্যবহারের সর্বোত্তম ও লাভজনক পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানিয়েছে, যখন রিজার্ভ ৬ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান কভারেজ অতিক্রম করবে, তখন আইএমএফের পরিমাণ এবং বিতরণ উভয়ই বাড়ানো হবে।

বর্তমানে ইডিএফ এবং রপ্তানি অর্থায়নের গ্যারান্টি প্রদানের জন্য এমআইজিএ-এর সাথে আলোচনা চলছে। হার কিছুটা বেশি হতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে টেকসই হলে বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করবে। এই পদক্ষেপগুলো রপ্তানি খাতে আস্থা ও অর্থায়নের গতি বাড়াতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ছয়টি ব্যাংকের সম্পদমান পর্যালোচনা (অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ) সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে তিনটি বড় ব্যাংককে একীভূতকরণের (মার্জার) জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। আরও আটটি ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ (ভালনারেবল) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি সামগ্রিক সম্পদমান পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রকৃত সমস্যাগুলো শনাক্ত করা সহজ হবে। ঋণ শ্রেণিকরণ কঠোর করায় প্রকৃত অবলোপনযোগ্য ঋণের (এনপিএল) চিত্র সামনে এসেছে। ব্যাংক তদারকিতে ঝুঁকিভিত্তিক পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, যাতে গুণগত পরিবর্তন আনা যায়। ইতোমধ্যে ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এসব পর্ষদকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে একটি ধারাবাহিক নজরদারি ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে।

ব্যাংক খাতের জন্য ছয়টি মৌলিক আইন খসড়া আকারে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঘোষিত ‘ব্যাংক রেজোলিউশন অর্ডিন্যান্স’ দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ (মার্জার) সহজ করবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি ‘ব্যাংক রেজোলিউশন বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও ধাপে ধাপে মার্জার প্রক্রিয়া চলবে, যেখানে পরিচালনা পর্ষদের সুশাসনের দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে (ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন) গুরুত্ব দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইন্টারঅপারেবিলিটি সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও প্রযুক্তিগত অভিযোজন (টেকনোলজিক্যাল অ্যাডাপটেশন) নিশ্চিত করা হবে।

এ লক্ষ্যে নতুন নতুন মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) চালু করা হবে, যেন অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নগদ টাকার ব্যবহার কমিয়ে একটি ‘ক্যাশলেস’ অর্থনীতি গড়ে তোলা যায়। প্রতি বছর কেবল নগদ ব্যবস্থাপনা চালাতে খরচ হয় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা, যা বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য একটি বড় ব্যয়। তাই প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক অন্তর্ভুক্তিই ভবিষ্যতের পথ। এছাড়া, একটি একক জাতীয় কিউআর কোড বাস্তবায়নের উদ্যোগ চলছে। প্রতিটি ট্রেড লাইসেন্সে বাধ্যতামূলকভাবে কিউআর কোড প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হলে নগদবিহীন লেনদেন সহজ হবে এবং ব্যবসায়িক নীতিমালার সরলীকরণে এটি একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আরো বড় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অপারেটরদের লাইসেন্স প্রদান করছে (বর্তমানে এমএফএস অপারেটরের সংখ্যা ২৭টি)। ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স পুনরায় চালু করা হবে। ক্রেডিট কার্ড ও ডেবিট কার্ড ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে কার্ড ব্যবহারের হার সবচেয়ে কম। ইতোমধ্যে গুগল পে চালু হয়েছে, যা ডিজিটাল লেনদেনে নতুনমাত্রা যোগ করেছে। এখন ব্যাংকগুলোর উচিত আরও ব্যবহারযোগ্য কার্ড সীমা প্রদান করা এবং কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া।

আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ২০২৫’ খসড়া করা হয়েছে, যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২’-এর অধীনে একটি ‘বডি করপোরেট’ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে এবং স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার কথা। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আনার জন্য নেওয়া এই সংস্কার উদ্যোগটি অত্যন্ত যথার্থ ও আশাব্যঞ্জক।

অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা যাচ্ছিল, যেমন রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কিছুটা বৃদ্ধি। তবে অর্থনীতিতে আমদানি প্রবণতা একটি বড় প্রভাবক। বিশেষ করে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস পেয়েছে, যা বিনিয়োগ প্রবাহের জন্য উদ্বেগজনক। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক-সংকট (tariff shock) বৈশ্বিকভাবে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের বিনিয়োগের গতি ধীর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের জন্য বিভিন্ন পণ্যের উপর ভিন্ন হারে শুল্ক আরোপ বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এক নজিরবিহীন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ৩৫% শুল্কহার পুনর্বিন্যাস নিয়ে আলোচনা চলছে, তবে তা এখনো নিশ্চিত নয়- যা অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত।

আগামী ছয় মাসে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার সম্ভাবনা রয়েছে। এই বিষয়গুলোর প্রতি আরো মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, কারণ এই সময়ে বাজারে চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে না। জ্বালানি ও অ-জ্বালানি পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কমতে শুরু করেছে, যা একটি স্বস্তিদায়ক ইঙ্গিত। পাশাপাশি, বিনিময় হার স্থিতিশীল করার বিষয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

দেশের ঋণ পরিশোধ (ডেট সার্ভিসিং) যথাযথভাবে করা হচ্ছে কি না, তা সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। বর্তমানে ঋণ পরিশোধের হিসাব পূর্বের মূল্যের ভিত্তিতে করা হয়, যার ফলে পরবর্তীতে নতুন করে নেওয়া ঋণের প্রকৃত পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম দেখানো হয়। ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাস্তবসম্মতভাবে পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। বাজেটে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা হলেও মূলধনের জন্য তেমন বিবেচনা করা হয় না। তাই প্রকৃত ঋণ-ভার বোঝার জন্য পুনরায় হিসাব ও কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও স্বচ্ছভাবে অর্থ সরবরাহ, চাহিদা এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপের প্রকৃত চিত্র নিরূপণ করতে পারবে।

অর্থনীতিতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক- উভয় ধরনের উপাদানই বিদ্যমান। তাই আসন্ন মুদ্রানীতিকে আরো হিসেব-নিকেশ করে, সুচিন্তিতভাবে প্রণয়ন করতে হবে, যেন আগাম চ্যালেঞ্জগুলো যথাযথভাবে মোকাবিলা করা যায়। বিশেষ করে বৈশ্বিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে রপ্তানি আয় এবং রাজস্ব আদায়ে কিছু বাধার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে মুদ্রানীতিতে যথাযথ কৌশল নির্ধারণ করা জরুরি।

ফেরদৌস আরা বেগম: অর্থনীতিবিদ এবং প্রধান নির্বাহী, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ