Views Bangladesh Logo

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অননুমোদিত ইশতেহার

Bakul   Ashraf

বকুল আশরাফ

শতেহার যদি মানুষের নীতিগত অবস্থানকে প্রকাশ করে, কীভাবে একটি সমস্যার সমাধান করবে তার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দেয় কিংবা কীভাবে এগিয়ে যাবে তার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে যা জনগণের অথবা সে সময়ের আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেয় তবে আবু সাঈদের (২০০১-১৬ জুলাই ২০২৪) কথাগুলোর মধ্যে কী ইশতেহারের প্রাণ ভোমরা নেই? দেখি কি লিখেছিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ শামসুজ্জোহাকে (১৯৩৪-১৯৬৯) উদ্দেশ্য করে বেরোবির শিক্ষার্থী আবু সাঈদ স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিল, সবাই তো মরে গেছে; কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত।

নিহত আবু সাঈদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলন সমন্বয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তার ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে দেখা যায়, মৃত্যুর একদিন আগে (১৫ জুলাই, ২০২৪) তিনি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আদনান আবিরকে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, ‘যদি আজ শহীদ হই, তবে আমার নিথর দেহটা রাজপথে ফেলে রাখবেন। ছাত্রসমাজ যখন বিজয় মিছিল নিয়ে ঘরে ফিরবে, তখন আমাকেও বিজয়ী ঘোষণা করে দাফন করবেন। একজন পরাজিতের লাশ কখনও তার মা-বাবা গ্রহণ করবে না।’

সোমবার (১৫ জুলাই, ২০২৪) ১২টা ৩৭ মিনিটে আরেকটি স্ট্যাটাস দেন আবু সাঈদ। স্ট্যাটাসে সংযুক্ত ছবিতে ছিল গণঅভ্যুত্থানে শহীদ শামসুজ্জোহার একটি বিখ্যাত মন্তব্য। মন্তব্যটি ছিল এমন, ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এরপর কোনো গুলি হলে আমার ছাত্রদের গায়ে লাগার আগে যেন আমার গায়ে লাগে।’

এই যে একজন শিক্ষকের দৃঢ়তাসহ ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা তা কজন শিক্ষকের আছে। আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ শামসুজ্জোহার প্রতিফলন দেখেছি গুটিকয়েকজন হাতেগোনা সাহসী, সময়কে ধারণকারী শিক্ষকদের মধ্যে যদিও এই বিপ্লবের কোনো সুসংবদ্ধ ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রস্তুতি ছিল না। তবুও তারা নিজেদের বিবেকের তাড়নায় ছাত্র-জনতার সহযোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।

‘মা আমার জন্য দোয়া করো। আমি মারা গেলে আমার লাশ রাজপথে রেখে দিও। দাবি আদায় হওয়ার পর দেশ শান্ত হলে আমার লাশ রাজপথ থেকে এনে দাফন করো।’ -ফাহমিন জাফর।

কোটাবিরোধী আন্দোলনে যাওয়ার আগে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মাকে শেষ কথা হিসেবে এসব কথা বলে গেছেন ঢাকার উত্তরায় নিহত টঙ্গী সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র শেখ ফাহমিন জাফর ১৮ জুলাই, ২০২৪। দাবি আদায় হওয়ার পর দেশ শান্ত হলে আমার লাশ রাজপথ থেকে এনে দাফন করো। আমার মতো অনেকের মৃত্যু হলে সবার লাশ রাজপথে থাকবে। অনেক মা তোমাকে সহযোগিতা করবে, চিন্তা করো না। এটাই ছিল মায়ের সঙ্গে ছেলে ফাহমিনের শেষ কথা।

শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের (২০০৭ - ৪ আগস্ট ২০২৪) বয়স হয়েছিল ১৭ বছর। সে তার পরিবারের সদস্যদের বলতো, বড় হয়ে এমন কিছু করবে, যার জন্য পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে গর্ব করবেন। আন্দোলনে ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় গুলিতে নিহত হয় আহনাফ। রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল আহনাফ। আহনাফ তার মা আর খালাকে বলত, তোমাদের মতো ভিতু মা-খালাদের জন্য ছেলেমেয়েরা আন্দোলনে যেতে পারছে না। ১৯৭১ সালে তোমাদের মতো মা-খালারা থাকলে দেশ আর স্বাধীন হতো না।’

একজন ১৭ বছর বয়সের ছেলে আহনাফের মধ্যে লুকিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার অভিপ্রকাশ। যুদ্ধে রক্ত দিতে হয়, জীবনকে বাজি রাখতে হয় একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য। এ লক্ষ্যই তো হয়ে ওঠে একটি অলিখিত ইশতেহার। এখানে কোনোরকম তত্ত্বায়ন ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্ম ছিল না; কিন্তু একটি লক্ষ্য অবচেতনভাবেই তরুণদের মধ্যে কাজ করেছে যে, জীবন দিয়ে হলেও দাবি আদায় করে ছাড়বো। আসল কথা তরুণদের মধ্যে সংগ্রামের বীজ বপিত হয়েছিল যে, বহুদিনের ক্ষমতায় থাকা ফ্যাসিস্টের পতন ঘটতেই হবে। এই আন্দোলনে জুলাইয়ের প্রথম দিকে শুরু হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী স্লোগানে: ‘মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা / সংবিধানের মূলকথা, সুযোগের সমতা।’

আন্দোলনের শুরু করেছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকে সামনে রেখে, আমরা দেখি তাদের স্লোগানের মধ্যে ছিল: ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই।’

এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য এবং গতি-প্রকৃতির দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়, ‘কোটা’র সমতা আন্দোলন বাঁক নেয় ৭ জুলাই, ২০২৪ বাংলা ব্লকেডের মাধ্যমে। ১০ জুলাই আন্দোলন আরেকটু ধারালো হয়ে বাঁক নেয় সর্বাত্মক ব্লকেডে। সে সময় স্লোগানের ধারাও ভিন্ন গতি পায়। আন্দোলনকারীরা ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের চেতনার স্লোগান সামনে তুলে আনে: ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম।’

পরবর্তীকালে শুরু হয় সারা দেশে সকাল সন্ধ্যা বাংলা ব্লকেড, রেলপথ অবরোধ। আন্দোলনে পুলিশ এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষক ছাত্রলীগ হামলা চালায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। এতে আন্দোলনকারীরা তাদের স্লোগানে হামলা এবং পুলিশ এই শব্দটি যুক্ত করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ বলা যায়, সরকারি প্রশাসন তাদের দমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের আরও সঙ্ঘবদ্ধ হতে সাহায্য করে। শিক্ষার্থীরা স্লোগানে যুক্ত করে, ‘পুলিশ দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না, / দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ।’

ছাত্রদের সাহস, ত্যাগ, তিতিক্ষা, আন্দোলনের কৌশল, সংগ্রামী ঐক্য এবং জনতাকে একীভূত করতে পারা- এসব কঠিন আকাঙ্ক্ষার সঠিক চিত্রটি চোখে না দেখলে বাইরে থেকে কল্পনা করার কোনো সুযোগ নেই, কেননা সেটা তো কোনো নিখুঁত কল্পনাকেও হার মানাতে বাধ্য। এখানেই লুকায়িত রয়েছে আপসহীন অলিখিত ইশতেহার। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি একজন কিশোর নিরস্ত্রভাবে সশস্ত্র বাহিনীর সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে গেছে। এতো এতো টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, গুলি উপেক্ষা করে পুলিশের ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে গেছে ছাত্ররা। আমরা দেখেছি, একতার দিক থেকে ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশ বাহিনীর চাইতেও অনেক বেশি শক্তিশালী এবং সংঘটিত হয়ে উঠেছিল। তারা ন্যায়ের পথে, স্বৈরাচারীর পতনের স্বপক্ষে, বৈষম্যহীন নীতির স্বপক্ষে থেকে লড়াইয়ে নেমেছিল। তাদের এই লড়াই পৃথিবীতে এক বিরল ঘটনা হিসেবে চিরদিনের জন্য ইতিহাস হয়ে রইল।

গণহত্যা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে শুরু হয় মার্চ ফর জাস্টিজ এবং শিক্ষার্থী ও জনতা যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের উদ্দেশ্যে শুরু হয় রিমেম্বারিং দ্য হিরোস। এর পর আমরা দেখি সমগ্র আন্দোলন রূপান্তরিত হয় মাত্র এক দফায়। কর্মসূচি দিক পরিবর্তন করে লংমার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। শত-শত, হাজার-হাজার, লাখ-লাখ জনতার প্রতিবাদে ৩৬ জুলাই রক্তসমুদ্রে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের পতন ঘটে।

৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি চলাকালে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় গুলিতে নিহত হয় ১৬ বছর ৯ মাস বয়সী শাহারিয়ার খান আনাস। ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শাহারিয়ার কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়েছিল। সে বাসায় মায়ের জন্য একটি চিঠি রেখে গিয়েছিল।

মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান তোমার কথা অমান্য করে বের হলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারবো না। আমাদের ভাইরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে সংগ্রাম করছে। একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, ৭ বছরের বাচ্চা, ল্যাংড়া মানুষ যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেন বসে থাকব ঘরে। একদিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় করে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয় সে-ই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই। -আনাস।

এই চিঠিতে বীরত্বের কথা লেখা আছে, স্বার্থপরতাহীন জীবনের কথা লেখা আছে, লেখা আছে জীবন উৎসর্গের কথা, সংগ্রামের কথা লেখা আছে, রাজপথের কথা লেখা আছে, সুনির্দিষ্ট আন্দোলনের কথা লেখা আছে, আপামর জনতার কথা লেখা আছে। ১৬ বছর বয়সী এই কিশোর সমগ্র বাংলাদেশের মানুষকে অংশীজন করে নিয়েছে তার এই চিরকুটসম ইশতেহার দিয়ে। যদিও ইশতেহার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত হয়। এই চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়ায় পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন অংশীজনকে তাদের মতামত প্রদানের সুযোগ দেয়া হয়। এই চিঠিটি বাংলাদেশ কেন পৃথিবীতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে থেকে যাবে একটি রক্তাক্ত দলিল হিসেবে, একটি চিরকুটসম ইশতেহার হিসেবে।

বকুল আশরাফ: কবি ও প্রাবন্ধিক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ