জাতিসংঘ : ভাঙনের প্রান্তে নাকি সংস্কারের দ্বারপ্রান্তে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে মানবতার শান্তি, ন্যায় ও নিরাপত্তার আশায় ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের জন্ম। এর লক্ষ্য ছিল- একটি বৈশ্বিক মঞ্চ তৈরি করা, যেখানে সকল রাষ্ট্র সমানভাবে অংশ নেবে এবং বিরোধ মীমাংসা হবে আলোচনার মাধ্যমে, কেউ কথা রাখেনি। কিন্তু প্রায় আট দশক পর প্রশ্ন উঠছে- জাতিসংঘ কি তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পেরেছে, নাকি এটি আজ ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে?
আমি ব্যক্তিগতভাবে গত কয়েক বছরে সুইডেনসহ বিশ্বের নানা দেশে এ বিষয়ে প্রতিবাদ করেছি এবং এই প্রসঙ্গে বহু নিবন্ধ লিখেছি। কারণ কথা ছিল- একটি বিশ্ব, যেখানে রাষ্ট্রগুলো সমানভাবে অংশ নেবে, যুদ্ধে নয় বরং আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা করা হবে, এবং মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার নিশ্চয়তা থাকবে। সেই স্বপ্নের নাম ছিল জাতিসংঘ। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর, নিউইয়র্কে এর প্রতিষ্ঠা ঘটে, যেখানে প্রাথমিক ৫১টি রাষ্ট্র বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার রক্ষা করার সাধারণ লক্ষ্যকে সামনে রেখে একত্রিত হয়। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা বর্তমানে ১৯৩।
প্রতিষ্ঠার সময় সংস্থার কাঠামো এবং লক্ষ্য স্পষ্ট ছিল। সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, আন্তর্জাতিক আদালত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ- এসব অঙ্গ সংস্থা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি হয়েছিল। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের জন্য ভেটো ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা তখন বিশ্বাস করা হতো যে তা বড় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সংঘাত প্রতিরোধ করবে।
প্রায় আট দশক পর প্রশ্ন উঠেছে- জাতিসংঘ কি সেই মূল লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পেরেছে? এই প্রসঙ্গে, ২০২৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি তীব্র সমালোচনামূলক ভাষণ দেন। তিনি সংস্থাটিকে ‘বিকল’ এবং “অকার্যকর” হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এটি “বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ”। এছাড়া, তিনি অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত সমস্যার উদাহরণ হিসেবে একটি ভাঙা এস্কালেটর এবং টেলিপ্রম্পটারের ত্রুটি তুলে ধরেন, যদিও জাতিসংঘের মুখপাত্র স্পষ্ট করেন যে এসব ত্রুটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের কারণে হয়েছে। ট্রাম্পের বক্তৃতায় অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বিষয়গুলোও উঠে আসে। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসন নীতি ও সবুজ জ্বালানি প্রকল্পের সমালোচনা করেন, জলবায়ু পরিবর্তনকে “বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতারণা” হিসেবে অভিহিত করেন, এবং ন্যাটো দেশগুলোর রাশিয়ার জ্বালানি ক্রয়কে দ্বৈত নীতি হিসেবে উল্লেখ করেন।
তার বক্তব্য বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেন, যা ট্রাম্পের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা ট্রাম্পের একতরফা পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেন, এগুলো ব্রাজিলের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ট্রাম্পের সমালোচনার পর বলেন, সংস্থাটি শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশা প্রকাশ করেন।
বাস্তবতায় দেখা যায়, কখনও কখনও সংস্থার কার্যক্রম শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের অঙ্গীকারে বাধাগ্রস্ত হয়। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় ২০২৪ সালের গাজা সংকট। নিরাপত্তা পরিষদে মানবিক ত্রাণ প্রেরণের প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল, যা শিশু, বৃদ্ধ এবং সাধারণ নাগরিকদের জীবন রক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিন্তু এক স্থায়ী সদস্যের ভেটো প্রস্তাবকে স্থগিত করে, ফলে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ মানবিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়। শুধু গাজা নয়, ইউক্রেন, মিয়ানমার, আফগানিস্তান বা হাইতির মতো দেশগুলোতেও জাতিসংঘের কাঠামো এবং নীতি প্রণয়নের সীমাবদ্ধতা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও ন্যায়ের স্বার্থ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাতিসংঘের প্রধান কাঠামোগুলো হলো সাধারণ পরিষদ, যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র সমান ভোটাধিকার পায়; নিরাপত্তা পরিষদ, যা শান্তি বজায় রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত; অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, যা উন্নয়ন নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করে; সচিবালয়, যা প্রশাসনিক কার্যক্রম সম্পাদন করে; আন্তর্জাতিক আদালত, যা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করে; এবং ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল, যা উপনিবেশ ও দাসপ্রথা পর্যবেক্ষণ করত, বর্তমানে নিষ্ক্রিয়।
কাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি বড় সমস্যা- নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ভেটো ক্ষমতা। ভেটো ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রতিহত করা; কিন্তু বাস্তবে এটি মানবিক সংকট ও যুদ্ধাপরাধ প্রতিরোধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণ হিসেবে গাজা ২০২৪ সালে মানবিক ত্রাণ প্রেরণের প্রস্তাব ভেটোর কারণে ব্যর্থ হয়। ইউক্রেন যুদ্ধ (২০২২-বর্তমান) ও মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানও নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচায়ক।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনকে সাফল্য হিসেবে দেখায়। আফ্রিকা, হাইতি, কঙ্গোসহ বহু দেশে শান্তিরক্ষা সৈন্য পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ এতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে বাস্তবতা কঠোর- হাইতিতে শান্তিরক্ষা বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন ও শিশুশোষণের অভিযোগ উঠেছে। শান্তিরক্ষা বাহিনী প্রায়ই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আনতে ব্যর্থ, এবং ২০১০ সালে হাইতিতে চোলেরা মহামারির সঙ্গে তাদের সংযোগ নিশ্চিত হয়নি।
জাতিসংঘের বাজেট আসে সদস্য রাষ্ট্রের অবদানের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্র একাই প্রায় ২২ শতাংশ বাজেট দেয়, যার কারণে নীতিনির্ধারণে তার প্রভাব অত্যধিক। ছোট রাষ্ট্রগুলোর কণ্ঠস্বর প্রান্তিক হয়ে পড়ে। মানবাধিকার কাউন্সিলও দ্বিমুখী নীতি প্রদর্শন করে- ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনে নীরবতা, কিন্তু শক্তিধর রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক আদালত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রভাবশালী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কার্যকর হতে ব্যর্থ, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন ICC-এর বিচার মানতে অস্বীকার করে।
সাম্প্রতিক উদাহরণগুলো চোখে পড়ে- গাজা ২০২৪ সালে ভেটোর কারণে মানবিক ত্রাণ বিলম্ব; ইউক্রেনে নিরাপত্তা পরিষদ নিষ্ক্রিয়; মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান ও রোহিঙ্গা সংকটের সময় চীনের ভেটো আশঙ্কা; হাইতিতে শান্তিরক্ষা মিশনের দুর্নীতি ও চোলেরা মহামারি। গাজায় এক পরিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে, শিশু ও বয়স্কদের খাবার নেই, অথচ মানবিক ত্রাণ প্রস্তাব ভেটোর কারণে আটকে থাকে। এই প্রতিটি ঘটনা হাজার হাজার মানুষের বাস্তব জীবনকে প্রভাবিত করছে।
সংস্কারের প্রস্তাবনা হলো- ভেটো সংস্কার, মহাসচিব নির্বাচনে স্বচ্ছতা, অর্থায়নে ভারসাম্য, শান্তিরক্ষা মিশনে জবাবদিহি, মানবাধিকার কাউন্সিলের সংস্কার এবং বিকেন্দ্রীকরণ ও বিশ্ব নাগরিক অংশগ্রহণ।
জাতিসংঘ আধুনিক ইতিহাসে এক অমূল্য প্রতিষ্ঠান। দুর্যোগে ত্রাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রকল্পে এর অবদান অপরিসীম; কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো, অর্থায়নে অসমতা, শান্তিরক্ষা মিশনের দুর্বলতা ও মানবাধিকার কাউন্সিলের দ্বৈত মানদণ্ড সংস্থাটিকে প্রায় অচল করেছে। আজ জাতিসংঘ ভাঙনের প্রান্তে নয়, বরং সংস্কারের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। সংস্কার ছাড়া বিশ্ব শান্তি, মানবাধিকার ও ন্যায়ের স্বপ্ন ঝুঁকির মুখে পড়বে। সংস্কার হলো একমাত্র পথ যা এটিকে আবারও বিশ্বজনীন শান্তি ও ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
জাতিসংঘ আধুনিক বিশ্বের শান্তি ও ন্যায়ের এক অমূল্য প্রতিষ্ঠান। তবুও ভেটো ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, অর্থায়নের অসমতা এবং দ্বৈত নীতি সংস্থার কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করছে। বাস্তব সংস্কার, সমন্বিত উদ্যোগ এবং বৈশ্বিক সংহতি ছাড়া বিশ্ব শান্তি, মানবাধিকার ও ন্যায়ের স্বপ্ন ঝুঁকির মুখে। এটি শুধু জাতিসংঘের জন্য নয়- বিশেষ করে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও এক শক্তিশালী আহ্বান। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সীমান্ত সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, রোহিঙ্গা সংকট এবং দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতা দেশের জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে হুমকির মুখে ফেলে। বৈশ্বিক সংহতি ও কার্যকর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিশ্ববাসীর দায়িত্ব হলো সংস্থাটিকে পুনরায় বিশ্বজনীন শান্তি, ন্যায্যতা এবং মানবাধিকারের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা- সংস্কারই একমাত্র পথ।
রহমান মৃধা: গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে