আল-জাজিরার প্রতিবেদন থেকে
যুক্তরাজ্য বর্ণবাদী এক দুঃস্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে
[২০২৪ সালর ২৯ জুলাই ঘটেছিল যুক্তরাজ্যের সাউথপোর্টে এক ভয়াবহ বর্ণবাদী হামলা। যুক্তরাজ্যের মার্সিসাইডের সাউথপোর্টের মেওলস কপ এলাকার একটি নাচের স্টুডিওতে মেয়ে শিশুদের লক্ষ্য করে একটি গণ ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলেই দুটো মেয়ে মারা যায়, ছয়জন আহত শিশু এবং দুইজন প্রাপ্তবয়স্ককে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরের দিন তৃতীয় আরেক মেয়ে মারা যায়। তিন কিশোরীকে ছুরিকাঘাতে হত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এক ১৮ বছর বয়সি তরুণ৷ তার নাম অ্যাক্সেল রুডাকুবানা৷ তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
এই অপরাধ পুরো যুক্তরাজ্য জুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এবং অনলাইনে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ে, যা দেশব্যাপী দাঙ্গার কারণ হয়৷ সেখানে দাবি করা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্য একজন মুসলিম আশ্রয়প্রার্থী দায়ী৷ এই সময়ে কট্টরপন্থিরা পুলিশ, দোকান, আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য ব্যবহৃত হোটেল, মসজিদ এবং একটি গ্রন্থাগারে হামলা চালায়৷ পরে শতাধিক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়৷
এই ঘটনার এক বছর পর লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা তারিক মাহমুদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরায় একটি প্রতিবেন লিখেছেন। ভিউজ বাংলাদেশ-এর পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হলো:]
সাউথপোর্ট হামলার এক বছর পেরিয়ে গেল। হামলার পর যুক্তরাজ্যের রাস্তায় শুরু হয়েছিল বর্ণবিদ্বেষী দাঙ্গা। মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে হামলাকারী একজন মুসলমান। সেই গুজবের কারণে ক্ষিপ্ত জনতা মসজিদ, মুসলমানদের দোকানপাট, বাড়িঘর ও যাকে মুসলমান মনে হয়েছে, তাকেই আক্রমণ করেছে।
এই দাঙ্গার সময় আমি আমার উপন্যাস দ্য সেকেন্ড কামিং শেষ করছিলাম। উপন্যাসের কাহিনি ভবিষ্যতের ইংল্যান্ড নিয়ে, যেখানে এক খ্রিস্টান মিলিশিয়া ইংরেজ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে লন্ডন দখল করে, ইসলাম নিষিদ্ধ করে এবং মুসলমানদের বার্মিংহামের উদ্বাস্তু শিবিরে পাঠিয়ে দেয়। শেষ অধ্যায়গুলো লিখতে লিখতে আমি বুঝতে পারলাম, আমার কল্পনার ভয়াবহ ভবিষ্যৎ আজকের বাস্তবের সঙ্গে কতটা মিলিয়ে গেছে।
এই কল্পিত জগৎ নির্মাণে আমি আমার শৈশবের ইংল্যান্ড থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছি, যেখানে বর্ণবাদী সহিংসতা ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা। সাদা বর্ণের কিশোরদের দল রাতের পাবে বন্ধের পর আমাদের খুঁজে বেড়াত; তারা একে বলতো ‘পাকি পেটানো’। ছুরি দিয়ে আক্রমণ বা পেট্রল বোমা ছোঁড়া তখন স্বাভাবিক বিষয় ছিল। ডানপন্থী দলগুলো-ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি- ঘন ঘন বলত, আমাদের মতো কালো বা অশ্বেতচর্মাদের, যারা ‘বিদেশি’, ফেরত পাঠাতে হবে।
স্কুলে যেতেও আতঙ্কে থাকতে হতো, কারণ রাস্তা পার হতে হতো বর্ণবাদী ছেলেমেয়েদের ভিড় পেরিয়ে। খেলার মাঠেও তারা আমাদের ঘিরে ধরে বর্ণবাদী গান গাইত। ছাত্রজীবনে কতবার মারধরের শিকার হয়েছি, তার হিসেব রাখা ছেড়ে দিয়েছিলাম। স্কুলে, রাস্তায়, পাবের ভিতরে-বাইরে- যেকোনো জায়গায় শারীরিক আক্রমণ ছিল নিয়মিত। আমি তখন পূর্ব লন্ডনে থাকতাম। ব্রিক লেনের তরুণদের সঙ্গে মিলে বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলি। শুধু ব্রিক লেনে নয়, দেশের নানা জায়গায় এ ধরনের দৃশ্য ঘটে- ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি শত শত মিছিল করে, যেগুলোতে সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী দলগুলোও অংশ নিত।
এই সময় আমার ও কয়েকজন বন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয় ‘বিস্ফোরক তৈরির ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে। দুধের বোতলে পেট্রল ভরে পাড়া-প্রতিবেশীদের রক্ষা করতে গিয়ে আমরা ধরা পড়েছিলাম। এই ঘটনা ‘ব্র্যাডফোর্ড ১২’ নামে পরিচিত। ব্রিক লেন ও ব্র্যাডফোর্ডের এই সংগ্রাম ছিল বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ, যার মূল লক্ষ্য ছিল বর্ণবৈষম্য ও ডানপন্থী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই।
তখনকার রাস্তায় চলা সহিংসতা ছিল ভয়াবহ, কিন্তু তা মূলত সমাজের প্রান্তিক অংশ থেকে উত্পন্ন। শাসক শ্রেণি পরোক্ষভাবে জড়িত থাকলেও প্রকাশ্যে এই দলগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ পেত না। ১৯৭৮ সালে কনজারভেটিভ দলের প্রধান মার্গারেট থ্যাচার বলেছিলেন- ‘মানুষ সত্যিই ভয় পাচ্ছে, মনে করছে এই দেশটা যেন অন্য সংস্কৃতির মানুষের দ্বারা প্লাবিত হয়ে যাবে।’ যদিও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি এসব দল থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতেন।
আজ সেই দূরত্ব নেই। লেবার পার্টির কেয়ার স্টারমারসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখন নিয়মিত ডানপন্থী ভাষা ব্যবহার করেন, আশ্রয়প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দেন। আগের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যানও একই রকম ছিলেন। ব্রেভারম্যান মিথ্যা দাবি করেছিলেন যে যৌন নিপীড়ন চক্রে প্রধানত ব্রিটিশ পাকিস্তানি পুরুষরাই জড়িত, যাদের মূল্যবোধ নাকি ব্রিটিশ মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
পুরোনো সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী বর্ণবাদ আজও বিদ্যমান, তবে সবচেয়ে কদর্য রূপ ধারণ করেছে ইসলামবিদ্বেষ। মনে হয় পুরনো ‘পাকি পেটানো’ গোষ্ঠী আজ এক নতুন ধর্মযুদ্ধের ঢেউয়ে পরিণত হয়েছে, যারা ইসলামকে সন্ত্রাসের প্রতীক মনে করে, পাকিস্তানিদের যৌন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে এবং আশ্রয়প্রার্থীদের দেশ ধ্বংসকারী পরজীবী হিসেবে দেখায়।
এই প্রেক্ষাপটে রিফর্ম পার্টি উত্থিত হয়েছে। তাদের সরল কিন্তু ঘৃণামূলক ভাষা—ইসলামবিদ্বেষ ও অভিবাসীবিরোধ- জনগণের কাছে ‘সত্যবাদী বিকল্প’ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এখন তারা ভোটে এগিয়ে, সমর্থন প্রায় ৩০ শতাংশ, যেখানে লেবার ২২ শতাংশ ও কনজারভেটিভ ১৭ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে, যখন দাঙ্গার বর্ষপূর্তি চলছে, ইকোনমিস্ট পত্রিকা একটি জরিপ প্রকাশ করেছে, যা অর্থনৈতিক মন্দা বা সামাজিক অবক্ষয়ের বদলে জাতিগত বিষয় নিয়ে। জরিপে দেখা গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ বহুসংস্কৃতিবাদ ক্ষতিকর মনে করে, আর ৭৩ শতাংশ আশঙ্কা করে নতুন জাতিগত দাঙ্গা হবে। দেশের এই সহিংসতা ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। আজকের বর্ণবাদ সেই পুরনো সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা থেকে জন্ম নিচ্ছে- ‘বর্বরদের’ বশ মানাতে হবে, যেভাবে ঔপনিবেশিক শাসনে ব্রিটেন করেছিল। তখন যে বর্ণবাদ সাম্রাজ্যকে একত্র করেছিল, আজ তা ফের ফিরে এসেছে।
এই চিন্তাধারা আজকের রাস্তায় মুসলিমবিরোধী হামলা, ফিলিস্তিন সমর্থকদের ওপর দমন-পীড়ন, গাজায় শিশু হত্যা ও হাসপাতাল ধ্বংসের মধ্যেও প্রতিফলিত হচ্ছে। ব্রিটেন তার সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে শিখেছে কীভাবে জনগোষ্ঠীকে অমানবিকভাবে দেখা যায়, কীভাবে লুটপাট, যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষকে ন্যায্যতা দেওয়া যায়। এজন্য আজ তারা গণহত্যাকারী ইসরায়েলের সঙ্গে একযোগে দাঁড়ায়।
এই প্রেক্ষাপটে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ এক হয়েছে। যদিও তারা গণহত্যা থামাতে পারেনি, শাসক শ্রেণির ভণ্ডামি প্রকাশ করেছে। শুধুমাত্র এই ঐক্য ও বর্ণবাদবিরোধী প্রতিরোধই আমার উপন্যাসের দুঃস্বপ্নের ভবিষ্যৎকে বাস্তবে রূপ নেয়া ঠেকাতে পারে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে