Views Bangladesh Logo

জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশন, ডিম নিক্ষেপ ও সচেতন নাগরিকদের কয়েকটি প্রশ্ন

প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে বসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (UNGA) বার্ষিক অধিবেশন। পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারপ্রধান সেখানে সমবেত হন। রাষ্ট্রপ্রধানরা নিজেদের দেশের অবস্থান, সংকট ও অগ্রাধিকার তুলে ধরেন, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন এবং নানা বৈঠকে অংশ নেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই সফর ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় সব সরকারই এই সফরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে।

কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একাধিক প্রশ্ন- আসলে এসব সফরের বাস্তবিক গুরুত্ব কতটা? কারা সফরসঙ্গী হন? এর ব্যয়ভার বহন করে কে? এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এ সফরগুলো আমাদের কী শেখায়?

এবারের সফরটি আরও আলোচিত হয়ে উঠেছে এনসিপি নেতা আখতার হোসেনকে লক্ষ্য করে ডিম ছোঁড়ার ঘটনার কারণে। কেউ কেউ প্রধান উপদেষ্টার সমালোচনা করেছেন। তাদের বক্তব্য, অতিথিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকার ও বাংলাদেশ মিশনেরই ছিল। ফ্লাইটে যাদের নিয়ে ছবি তোলা হলো, অবতরণের পর তাদের অরক্ষিত অবস্থায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া- এটা নিঃসন্দেহে অযৌক্তিক ও অবিবেচক সিদ্ধান্ত।

ডিম নিক্ষেপকারীদের নিন্দা জানাতেই হবে, কারণ এটা কোনো ভদ্র-সভ্য প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। একই সঙ্গে সরকারি দায়িত্বশীলদের অবহেলাও এখানে স্পষ্ট।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বাস্তবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা নয়, তবে এটি একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক মঞ্চ। এখানে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু বিশ্বজনমতের প্রতিফলন ঘটায়। প্যালেস্টাইন প্রশ্নে কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবগুলো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

বাংলাদেশের মতো উদীয়মান দেশের জন্য এ মঞ্চ জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন, শান্তিরক্ষা কার্যক্রম, শ্রম অভিবাসন বা টেকসই উন্নয়নের মতো ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হয়। সাইডলাইন বৈঠকগুলোই আসল আকর্ষণ, কারণ সেখানেই বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে বৈঠক ও সমঝোতার সুযোগ তৈরি হয়। অনেকেই UNGA-কে ‘বার্ষিক বিশ্বমেলা’ বলেন, যেখানে অংশগ্রহণ মানে রাষ্ট্রের উপস্থিতি দৃশ্যমান রাখা।

বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই সরকারপ্রধানরা জাতিসংঘ সফরে যান বিশাল প্রতিনিধিদল নিয়ে। এর মধ্যে থাকেন সরকারি কর্মকর্তা, কূটনীতিক, নিরাপত্তা কর্মী, মিডিয়া প্রতিনিধি, কখনো ব্যবসায়ী বা এনজিও প্রতিনিধিও; কিন্তু বাস্তবতা হলো- প্রায়ই দেখা যায় সফরসঙ্গী তালিকা সীমিত ঘোষণা করা হলেও প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হয়। কখনো কখনো আত্মীয়-স্বজন কিংবা রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠরাও এ সফরে যোগ দেন।

এগুলো রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ‘পলিটিক্যাল প্যাট্রোনেজ’ বা রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়ার একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়। ক্ষমতাসীনরা আন্তর্জাতিক সফরের সুযোগকে পুরস্কার ও আনুগত্য বণ্টনের উপায়ে পরিণত করেন।

২০২৫ সালের ইউনূস সরকারের সফরে চারজন রাজনৈতিক নেতাকে (বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি) সঙ্গে নেয়া হয়েছে- যা অভূতপূর্ব। এর মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক ধরনের ‘জাতীয় ঐকমত্যের’ চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছে। তবে এই পদক্ষেপও বিতর্ক উসকে দিয়েছে- কারণ বিরোধী নেতারা জানেন, সাধারণ পরিষদের কার্যক্রমে তাঁদের সরাসরি কোনো ভূমিকা নেই।

প্রায় সব দেশের ক্ষেত্রেই সরকারপ্রধান ও সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যয় রাষ্ট্র বহন করে। কিন্তু বিতর্ক তখনই ওঠে, যখন যাদের কোনো আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব নেই, তাঁরাও সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ করেন।

বাংলাদেশে সফরসঙ্গীদের জন্য বিজনেস ক্লাস বিমান ভ্রমণ, ফাইভ-স্টার হোটেলে থাকা, দৈনিক ভাতা, গাড়ি ও নিরাপত্তা খরচ বহন করে রাষ্ট্র। কিন্তু এই খরচের বিস্তারিত কখনো প্রকাশ করা হয় না। সাংবাদিকরাও এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন না, কারণ অনেক সময় তাঁরাও একই সুবিধা পান। ফলে জবাবদিহির জায়গা পুরোপুরি ফাঁকা থেকে যায়।

এখানেই রাজনৈতিক অর্থনীতির আরেকটি তত্ত্ব সামনে আসে- এলিট ক্যাপচার। রাষ্ট্রের সম্পদ ও সুযোগ সুবিধা একটি ছোট গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, আর জনগণের করের টাকা ব্যবহার হয় তাদের ভোগ-বিলাসে। জাতিসংঘ সফরের মতো ঘটনা এই তত্ত্বের বাস্তব রূপ।

দুর্নীতি মানে শুধু ঘুষ নেওয়া নয়; রাষ্ট্রের অর্থ অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যবহার করাও দুর্নীতি। কোনো রাজনৈতিক নেতা যখন জানেন তার জাতিসংঘ অধিবেশনে কোনো ভূমিকা নেই, তবুও সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ করেন- তখন সেটিও দুর্নীতি হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। এখানেই বড় প্রশ্ন ওঠে: যদি বিএনপি বা জামায়াত নিজেদের সৎ ও নীতিবান বলে প্রচার করে, তবে তারা কেন নিজের খরচে যান না? কেন জনগণের টাকায় বিলাসী সফরে সম্মতি দেন?

দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই একই অভিজ্ঞতা। পাকিস্তান, নেপাল বা শ্রীলঙ্কায়ও দেখা যায়- ক্ষমতাসীনরা সফরের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঘনিষ্ঠদের পুরস্কৃত করেন। ভারতের নরেন্দ্র মোদি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে UNGA-তে যাননি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও কখনো যান, কখনো যান না। অর্থাৎ বড় দেশগুলোর জন্য এ সফর অপরিহার্য নয়। কিন্তু ছোট দেশগুলো এটিকে রাজনৈতিক বৈধতা প্রদর্শনের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে।

ভবিষ্যতের জাতিসংঘ সফর নিয়ে বিতর্ক কমাতে হলে কিছু নীতিগত পদক্ষেপ জরুরি- সফরসঙ্গীদের পূর্ণ তালিকা আগে থেকেই প্রকাশ করতে হবে; প্রত্যেকের ভূমিকা উল্লেখ করতে হবে; খরচের বিস্তারিত সংসদে বা জনসমক্ষে হাজির করতে হবে; সাংবাদিকদের উচিত ‘কে কী বললেন’ এর বাইরে গিয়ে ‘কতজন গেছেন, কেন গেছেন, কত খরচ হলো’- এসব প্রশ্ন তোলা; জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মঞ্চ। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এটি জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন, উন্নয়ন সহযোগিতা কিংবা শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলার সুযোগ এনে দেয়; কিন্তু একই সঙ্গে এই সফরগুলোকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়, তা স্পষ্ট করে দেয়- আমাদের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে রাজনৈতিক অভিজাতদের ভোগ-বিলাসের আয়োজন। এ যেন রাষ্ট্র পরিচালনার চেয়ে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর সুবিধা বণ্টনের এক রকম প্রদর্শনী।

আমরা সত্যিই জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গড়তে চাই, তবে প্রথমেই প্রশ্ন তুলতে হবে- কেন জনগণের ট্যাক্সের অর্থ দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের বিলাসী সফর মেটানো হবে? কেন পুরো তালিকা ও খরচ গোপন রাখা হবে? কেন সাংবাদিকরা নীরব থাকবে? এবং কেন বিরোধী নেতারাও এ সুবিধা গ্রহণে আগ্রহী হবেন?

জাতিসংঘ সফরের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু এটিকে যখন রাজনৈতিক পর্যটনে পরিণত করা হয়, তখন তা দুর্নীতিরই সমান হয়ে দাঁড়ায়। এই দুর্নীতি আর লুটপাটের সংস্কৃতি ভাঙতে হলে সচেতন নাগরিকদের ভূমিকা অপরিহার্য। জনমত ও নাগরিক চাপে রাজনৈতিক অভিজাতরা জানুক- জনগণ চুপচাপ আর সবকিছু মেনে নেবে না।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষা যেমন জরুরি, তেমনি দেশের ভেতরে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি আর সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যদি রাষ্ট্রপ্রধানরা সত্যিই জনগণের প্রতিনিধি হয়ে বিশ্বদরবারে দাঁড়াতে চান, তবে প্রথমে জনগণের সামনে স্বচ্ছ হতে হবে। আর সেটিই হবে প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মাঝে আস্থার সেতুবন্ধন।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ