Views Bangladesh Logo

ইরানে ইসরায়েলি হামলার ছায়ায় মধ্যপ্রাচ্যের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

০২৫ সালের জুন মাসে মধ্যপ্রাচ্য যেন তার দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতার এক নতুন, আরও রক্তক্ষয়ী এবং অনিশ্চিত অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। ইসরায়েল কর্তৃক পরিচালিত এই স্মরণকালের বৃহত্তম ও সর্বাত্মক বিমান হামলা কেবল ইরানের সামরিক কাঠামোকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়নি, বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক গভীর আদর্শিক, কূটনৈতিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক সংকট। এই হামলার তাৎপর্য কেবল বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়- বরং এটি এক সুপরিকল্পিত, বহুস্তরবিশিষ্ট এবং প্রতীকী আঘাত, যা ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্তিত্ব, আত্মপরিচয় এবং আঞ্চলিক নেতৃত্বের দাবি পর্যন্ত প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

প্রায় ২০০-এর বেশি যুদ্ধবিমান যখন ইরানের আকাশসীমা ভেদ করে অভাবনীয় সমন্বয় ও নিখুঁত লক্ষ্যে হামলা চালায়, তখন তা কেবল এক সামরিক অভিযান নয়- বরং এক কৌশলগত আধিপত্য প্রদর্শনের নিদর্শন হয়ে ওঠে। লক্ষ্যবস্তু ছিল শুধুই ঘাঁটি, রাডার, কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র কেন্দ্র নয়; বরং ইরানের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা- পারমাণবিক গবেষণাগার, বিজ্ঞানী, এবং উচ্চপদস্থ সামরিক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিকাঠামো। এই হামলার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক ছিল এর ‘প্রিসিশন’ বা নিখুঁততা। আধুনিক সাইবার ও গোয়েন্দা তথ্যের সহায়তায় পরিচালিত এই আক্রমণ দেখিয়েছে যে, যুদ্ধ আর শুধু শারীরিক নয়, এটি এখন মনস্তাত্ত্বিক ও তথ্য-নির্ভর এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।

ইরানের জন্য এই হামলা একটি বহুমাত্রিক ধাক্কা। এটি কেবল তার প্রতিরক্ষা দুর্বলতা উন্মোচন করেনি, বরং রাষ্ট্রের আত্মবিশ্বাস, জনগণের মধ্যে ঐক্য এবং শাসকদের নৈতিক কর্তৃত্বকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তাছাড়া, এই হামলা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী মতাদর্শগত সংঘাতকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখানে আর কূটনৈতিক পর্দা বা আঞ্চলিক সমঝোতার অবকাশ খুব কম। এটা ছিল এক নীরব ঘোষণা- যে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের নিরাপত্তা-চিন্তা ও প্রতিরোধমূলক নীতির সামনে ইরানের ‘তৌহিদি রাষ্ট্র’ মডেল এখন আর কার্যকর নয়। এই আক্রমণের অভিঘাত শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য এবং ভবিষ্যৎ জোট কাঠামোকেও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে।

ইরান আজ একা, আক্রান্ত, এবং প্রশ্নবিদ্ধ- এবং সেই প্রশ্নের উত্তর কেবল সামরিক নয়, আদর্শিক ও কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও খোঁজা জরুরি। এই সংঘাতের মূলে কেবল ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য নয়, আছে ইতিহাস, আদর্শ, ধর্ম ও জাতীয় চেতনার গহিন দ্বন্দ্ব। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরান নিজেকে মুসলিম বিশ্বের তৌহিদি রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করে এসেছে, যার লক্ষ্য পশ্চিমা দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। বিপরীতে, ইসরায়েল জন্ম থেকেই তার অস্তিত্ব রক্ষাকে ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে দেখেছে- একটি ইহুদি রাষ্ট্র, যা চিরস্থায়ী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ফলে, এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে চলমান সংঘর্ষ কোনো নির্দিষ্ট সীমান্ত বা সম্পদের ওপর নয়- এটি মূলত এক আদর্শিক ও অস্তিত্বের যুদ্ধ।

ফিলিস্তিন ইস্যু এই দ্বন্দ্বে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে পড়েছে। হামাস, ইসলামিক জিহাদ, হিজবুল্লাহসহ একাধিক গোষ্ঠীকে ইরানের সমর্থন ইসরায়েলের জন্য সরাসরি হুমকি। অপরদিকে, ফিলিস্তিনিদের ওপর অবরোধ, বসতি স্থাপন এবং দমননীতিকে ইরান দেখেছে মুসলিম জনতার ওপর এক প্রকার ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে। একদিকে ধর্মীয় নৈতিকতা, অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তার বাধ্যবাধকতা- এই দুই মেরুতে দণ্ডায়মান দ্বন্দ্ব কখনোই আপোসের মধ্যপন্থা গ্রহণ করেনি। এই সংঘাত কেবল ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো দ্বন্দ্ব নয়; এটি মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, বৈশ্বিক শক্তির ছায়াযুদ্ধ, এবং আধিপত্যের কৌশলের এক নির্মম উদ্ঘাটন। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক অভিযানের ব্যাপকতা এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু নির্বাচন এ কথাই প্রমাণ করে যে- এটি ছিল নিছক কোনো একক রাষ্ট্রের সামর্থ্য নয়; বরং একটি সুপরিকল্পিত, বহু-রাষ্ট্রীয় সমর্থনের ফসল।

এমন দুরূহ এবং প্রযুক্তিনির্ভর আক্রমণ বাস্তবায়ন সম্ভব হতো না যদি না পশ্চিমা শক্তির মৌন সম্মতি, প্রযুক্তিগত সহায়তা, কিংবা সরাসরি গোয়েন্দা সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত থাকত। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, এবং তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক উপস্থিতি ও তেলভিত্তিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক এক ধরনের ঘেরাও কৌশল সৃষ্টি করেছে- যা একদিকে ইরানকে কৌশলগতভাবে চতুর্দিক থেকে চেপে ধরেছে, অন্যদিকে ইসরায়েলকে দিয়েছে অপারেশনাল সুবিধার মুক্ত ছাড়পত্র। বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং এমনকি আফগানিস্তানে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলো এই কৌশলগত অবস্থানকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এর ফলে ইরান আজ শুধু আঞ্চলিকভাবে নয়, কৌশলগতভাবে এক গভীরভাবে বেষ্টিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে- যার প্রতিক্রিয়া বা প্রতিরোধমূলক সক্ষমতা দিনকে দিন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের ঐতিহাসিক মিত্রদের ভূমিকা- বা আরও স্পষ্টভাবে বললে, সেই ভূমিকার অনুপস্থিতি। একসময় যেসব রাষ্ট্র ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের আদর্শিক অনুপ্রেরণায় নিজেদের ভাগ দেখেছিল, আজ তারাই নীরব কিংবা সুযোগসন্ধানী। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অভ্যন্তরীণ চাপে জর্জরিত এবং মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আগের মতো সক্রিয় নয়। চীন এখন পর্যন্ত কেবল অর্থনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে নিজের আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহী; সরাসরি সামরিক সংঘাতে অংশ না নেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি নীতি থেকে বিচ্যুত হয়নি। আর পাকিস্তান- যে একসময় ইরানের সঙ্গে 'ভ্রাতৃত্বের' দাবি করত- আজ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি ও অর্থনৈতিক অনুগ্রহের কারণে একপ্রকার কৌশলগত নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছে। এর ফলে ইরান এক প্রকার কূটনৈতিক নিঃসঙ্গতায় পড়েছে- যা এক সময়ের আঞ্চলিক প্রভাবশালী রাষ্ট্রের জন্য এক দুঃখজনক পতনের ইঙ্গিত।

এই নিঃসঙ্গতা এবং সামরিক ধাক্কার চেয়েও অধিকতর গুরুত্বের দাবি রাখে ইরানের আদর্শিক কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন। একটি রাষ্ট্র যখন ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও মতাদর্শকে শাসনব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ধরে রাখে, তখন তা কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়- রাষ্ট্রের কৌশল, অর্থনীতি, শিক্ষা এবং বৈদেশিক সম্পর্ককেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। প্রশ্ন হলো, এই ধরনের ধর্মনির্ভর সিদ্ধান্ত কাঠামো কি আজকের বহুমাত্রিক, বৈজ্ঞানিক, এবং প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে বাস্তবিক অর্থে কার্যকর? ইরানের ইতিহাস এই প্রশ্নকে আরও গভীর করে তোলে। এক সময় এই ভূখণ্ড ছিল আল-বিরুনী, ইবনে সিনা, ফেরদৌসির মতো মনীষীদের কেন্দ্র- যেখান থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞান, গণিত, দর্শন, ও সাহিত্য বিশ্বকে আলোকিত করেছিল। অথচ আজ, সেই একই দেশ ধর্মীয় কঠোরতা, তথ্যের সীমাবদ্ধতা এবং সামরিক প্রতিশোধের মোহে নিজের ঐতিহাসিক পরিচয় থেকে বিচ্যুৎ হয়েছে।

ফলে রাষ্ট্রের আত্মপরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে- যেখানে আধুনিকতার সঙ্গে না চলার কারণে প্রযুক্তিগত পরিসরে তারা বারবার পিছিয়ে পড়ছে। এই বাস্তবতায় এমনকি পরমাণু অস্ত্রের সম্ভাবনাও একটি টেকসই নিরাপত্তা কাঠামো দিতে পারছে না। রাষ্ট্র যখন নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রতিরক্ষা কৌশলগুলোও আদর্শিক আবেগ দিয়ে পরিচালিত করে, তখন তা শত্রুর তুলনায় বেশি ক্ষতি করে নিজেদেরই। আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রের ক্ষমতা নির্ধারিত হয় তার জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, প্রযুক্তিনির্ভর সামরিক সক্ষমতা, কৌশলগত জোট, এবং কূটনৈতিক নমনীয়তার মাধ্যমে- শুধু ধর্মীয় আবেগ দিয়ে নয়। এই জ্ঞান ও প্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্নতা ইরানকে শুধু একঘরে করেনি, বরং একটি হতাশ, প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছে- যার প্রতিটি পদক্ষেপই এখন প্রতিরক্ষা নয়, টিকে থাকার লড়াই।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে- ইরানকে নিজের আদর্শিক কাঠামো নিয়ে গভীর আত্মসমালোচনামূলক চিন্তা করতে হবে। একটি রাষ্ট্রের পরিচয় তখনই টেকসই হয়, যখন তা মানুষের কল্যাণ, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, এবং বিশ্বমানবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। অন্যথায়, ধর্মীয় মৌলবাদ যতই প্রাচীন গৌরবের দোহাই দিক না কেন, তা ভবিষ্যতের বাস্তব সংকট মোকাবিলার উপযুক্ত নয়। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক অভিযানকে নিছক একটি যুদ্ধ হিসেবে দেখা ভুল হবে। এটি ইরানের জন্য একটি গভীর সংকেত এবং চূড়ান্ত আত্মবিশ্লেষণের আহ্বান। এই মুহূর্তে যুদ্ধ নয়, বরং ইরানের প্রয়োজন তার রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তিগুলোকে নতুন করে মূল্যায়ন করা এবং আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে একটি কার্যকর, আধুনিক ও মানবিক সংলাপের পথ খুঁজে বের করা।

আজকের মানবতা আরও বেশি সুশীল, গণতান্ত্রিক এবং বিজ্ঞাননির্ভর নেতৃত্ব প্রত্যাশা করে। তাই, 'তৌহিদি চেতনা' (একত্ববাদী আদর্শ) যদি আধুনিকতা, উদারতা, মানবাধিকার এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তার সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে, তবে তা কেবল আত্মপ্রবঞ্চনাই নয়, আত্মবিনাশের পথও হতে পারে। ইরান যদি তার আলোকোজ্জ্বল অতীতের দিকে ফিরে তাকায়- যেখানে তারা জ্ঞান, সভ্যতা ও চিন্তার ধারক ছিল- তবেই এই অন্ধকার অধ্যায়কে আলোর পথে রূপান্তর করা সম্ভব। যুদ্ধ ও সংঘাত নয়, বরং জ্ঞান এবং মানবতার মধ্য দিয়ে ইরান আবার বিশ্বের নেতৃত্বে আসুক- বর্তমান সংকটে এটাই হোক আমাদের সর্বজনীন আশা এবং প্রত্যাশা।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ