Views Bangladesh Logo

শিশুদের মুখে গান না থাকলে, মনে কি যুদ্ধ জন্মাবে?

'না না না, পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না/ওকে গাইতে দাও/ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/ওর গানই যে ফুল ফোঁটার প্রেরণা,'- শিশুদের মুখে গানই তো জীবনের প্রথম রোদ্দুর। শিশুরা যখন গাইতে শেখে, তখন তারা শুধু কণ্ঠে সুর তোলে না, সেই সাথে শেখে ভালোবাসতে, মায়া জন্মায় তাদের কোমল মনে। গান শুধু নিছক বিনোদন বা শিল্প নয়, মানবতারও পাঠ।

এ কারণেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শেখানোর পাঠ বন্ধ করা-মনকে ভারাক্রান্ত করে। এটি নিছক কোনও প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়, বরং এক গভীর সাংস্কৃতিক অভিঘাতও বটে। ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’ প্রকাশের মাত্র দুই মাসের মাথায় সরকার সেটি সংশোধন করে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ বাদ দিয়েছে।

আগস্টের বিধিমালায় বলা হয়েছিল চার ধরনের শিক্ষক থাকবে- প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক (সংগীত) ও সহকারী শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষা)। কিন্তু সংশোধিত বিধিমালায় রাখা হয়েছে কেবল প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক। ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দলের চাপ ও আন্দোলনের হুমকির পরেই আসে এই পরিবর্তন।

সরকার বলেছে, ‘এত অল্পসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে কার্যকর সুফল দেবে না, বরং বৈষম্য সৃষ্টি করবে। ভবিষ্যতে অর্থের সংস্থান হলে সব স্কুলে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো - এই বিবেচনার সময় এখন না তো কখন? ততদিনে অরাজক এই পৃথিবীতে কোমলমতির প্রাণ বিষিয়ে উঠবে না তো?

এই বাংলার মাটি গানেই জন্মেছে, গানেই বেড়ে উঠেছে। জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, নজরুল, রবীন্দ্র, দ্বিজেন্দ্র এসব নাম শুধু ঐতিহ্য নয়, আমাদের আত্মার সুরের প্রতিধ্বনি। ছোটবেলায় মুখে বোল ফোটার আগেই শিশুর সুর ফোটে- মা দোলনায় দুলে গুনগুনিয়ে ঘুম পড়ান সন্তানকে, গান শুধু বিনোদন নয়, শিশুর মানসিক বিকাশের অন্যতম হাতিয়ারও। গান শেখা মানে শব্দ, সুর, তাল, মন ও মেধার সমন্বয় শেখা। শিশুরা যখন গান শেখে, তারা সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা, মানবিকতাও শেখে।

নদীর দেশ বাংলাদেশে মাঝি যখন দাড় বাইতে বাইতে 'পদ্মার ঢেউরে' বলে সুর তোলে, তখন তার শরীর ও মনে শক্তি দ্বিগুণ হয়। এই যে জীবনের সঙ্গে সুরের বন্ধন এটাই তো আমাদের সংস্কৃতির প্রাণ।

যে জাতির মুক্তিযুদ্ধে গান ছিল প্রেরণার অন্যতম শক্তি। তাহলে কেন এমন সিদ্ধান্ত? কেন এমন এক দেশে, যার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার আছে, সেখানে মৌলবাদী দাবির কাছে নতি স্বীকার? আমরা কট্টর হতে চাই না, কারও ধর্মে আঘাতও দিতে চাই না, কিন্তু সংস্কৃতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।

এই সহিংস সময়ের মধ্যে যদি শিশুদের মুখে গান না থাকে, তবে সেখান থেকে কি জন্ম নেবে? যুদ্ধ? হিংসা? আর বিভাজন? গান মানুষকে কোমল করে, শান্ত করে, শেখায় ভালোবাসা। সংগীত শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত না করা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনের প্রশস্ত দ্বারকে রোধ করা।

গান হলো জীবনের স্বরলিপি। শুধু কেবল শিল্প নয়, মানসিক সুস্থতার ও ভিত্তি। প্রাথমিক শিক্ষায় গান শেখানোর সিদ্ধান্ত বন্ধ করা মানে শিশুদের আনন্দ, মানবতা ও সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত করাও বটে।

তাই বলছি- না না না পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না /ওকে গাইতে দাও/ কারণ ওর গানই তো ফুল ফোঁটার প্রেরণা। আমাদের শিশুদের মুখেও সেই গান ফুটতে দাও, যেখানে গান থাকে সেখানে ঘৃণা নয়, ভালোবাসাই জন্ম নেয়। আমরা সুরহীন শৈশব চাই না।


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ