Views Bangladesh Logo

চুকনগর গণহত্যা আর ‘মুল্লুক চলো’ হত্যাযজ্ঞের হাজারো শহীদকে স্মরণের দিন মঙ্গলবার

 VB  Desk

ভিবি ডেস্ক

মানব ইতিহাসের দুই বৃহত্তম ট্র্যাজেডি চুকনগর গণহত্যা এবং ‘মুল্লুক চলো’ হত্যাযজ্ঞের মাঝে ব্যবধান ৫০ বছরের। তবে বাংলাদেশের মাটিকে হাজারো শহীদের রক্তস্রোতে ভিজিয়ে কান্নাভেজা কালো অধ্যায় রচনা করেছে একই মাত্রার জেনোসাইড দুটি।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে খুলনা জেলার চুকনগরে গণহত্যার ৫৪ বছর এবং চাশ্রমিকদের ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন চলাকালে চাঁদপুরে হত্যাযজ্ঞের ১০৪ বছর পূর্তি হলো মঙ্গলবার (২০ মে)। ঘটনা দুটি এক মোহনায় মিশে আছে মুক্তিকামী ও সংগ্রামী মানুষের দেশমাতৃকার টানে চরম আত্মত্যাগের গৌরবগাথার সমকক্ষতায়।

ইতিহাসের স্বল্প সময়ে বৃহত্তম চুকনগর গণহত্যাটি হয়েছিল খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রাসহ আরও কয়েকটি সমুদ্রগামী নদীর মিলনস্থল চুকনগরে। একাত্তরের এদিনে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে মুক্তিকামী ১২ হাজারেরও বেশি মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।

অন্যদিকে মাতৃভূমিতে ফেরার আন্দোলন ‘মুল্লুক চলো’- এ অংশ নেয়ায় ১৯২১ সালের এদিনে চাঁদপুর রেলস্টেশনে কয়েক হাজার চাশ্রমিককে হত্যা করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের লেলিয়ে দেয়া সেনারা।

চুকনগর গণহত্যা
পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের একটি জনগোষ্ঠী জীবন বাঁচানোর তাগিদে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মে মাসের মাঝামাঝি সময় বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাট, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনা, ফরিদপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন।

ট্রানজিট হিসেবে তারা বেছে নেন ডুমুরিয়ার চুকনগরকে। পরদিন সকালে সাতক্ষীরা এবং কলারোয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে যেতে ১৯ মে রাতে সর্বস্ব নিয়ে সেখানে পৌঁছান লাখো মুক্তিকামী বাঙালি। চুকনগর বাজারের ঝাউতলা (তৎকালীন পাতখোলা) বিল, কাঁচাবাজার চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, কালী মন্দিরসহ বিভিন্ন শশ্মানে আশ্রয় নেন।

সারারাত নির্ঘুম কাটানো শরণার্থী হতে যাওয়া এসব মানুষেরা পরদিন সকালে বিশ্রাম সেরে ভাত রান্না বা চিড়ে-মুড়ি ও অন্য শুকনো খাবার দিয়ে শরীরে চলার শক্তি সঞ্চার করে নিচ্ছিলেন। দশটার দিকে তিনটি ট্রাকে করে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনারা চুকনগর বাজারের উপস্থিত হয়। স্থানীয় পাকিস্তানপন্থী ও অবাঙালি বাস ড্রাইভারদের কাছে খবর পেয়ে সাতক্ষীরা পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটি থেকে হালকা মেশিনগান ও সেমি-অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে এসেছিল তারা। আসে সাদা পোশাকে মুখঢাকা রাজাকাররাও। এরপর দুপুর তিনটা পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টা ধরে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে চলে যায় তারা।

হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচার আশায় নদীতে লাফিয়ে পড়লেও ডুবে মারা যান অনেকে। শহীদদের মরদেহের গন্ধে ভারী হয়ে যায় চুকনগর ও আশপাশের বাতাস। মাঠে, ক্ষেতে, খালে-বিলেও পড়ে থাকে অসংখ্য মরদেহ। বর্বর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ শেষে সমাহিত করার জায়গা না পেয়ে এসব মরদেহ নিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেন স্থানীয়রা। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটায় মাসখানেক পর্যন্ত ভাসতে থাকে অসংখ্য মরদেহ।

চুকনগরের ফসলি জমিগুলোতে আজও মেলে সেদিনের শহীদদের হাড়গোড়, তাদের শরীরে থাকা বিভিন্ন অলঙ্কার। চুকনগরে সেদিন সমবেত লক্ষাধিক বাঙালির মধ্যে গবেষকদের হিসেবে শহীদদের সংখ্যা অন্তত ১২ হাজার বলে ধরা হয়।

‘মুল্লুক চলো হত্যাযজ্ঞ’
ব্রিটিশশাসিত ভারতে তখন চা-চাষের বয়স প্রায় ৭০ বছরের কাছাকাছি। আসাম আর সুরমা উপত্যকা অধুনা বাংলাদেশের সিলেটের চাবাগানগুলোতে তখন শ্রমিকদের তীব্র অসন্তোষ চলছে। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে দালালের মাধ্যমে ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগনা, বিহার, ওডিশা, যুক্ত প্রদেশ (উত্তর প্রদেশ), অন্ধ্র প্রদেশ থেকে এসব হাজারো শ্রমিককে আনা হয়েছিল জনবিরল আসামে। তিন বছরের চুক্তিতে আনা হলেও বছরের পর বছর কেটে যাওয়ার পরও তাদের মুক্তির অনুমতি মিলছিল না। মানবেতর জীবনযাপনের পাশাপাশি এই শ্রমিকেরা ছিলেন যেন ক্রীতদাসও।

মাতৃভূমিতে ফিরতে ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন জোরদার হলে চাঁদপুর রেলস্টেশনে জড়ো হন কয়েক হাজার শ্রমিক। কিছু মানুষ গোয়ালন্দগামী জাহাজে উঠে পড়তে পারলেও অধিকাংশই ছিলেন ট্রেনযাত্রার অপেক্ষায়। হঠাৎ তৎকালীন ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি ম্যাকফরসন চাঁদপুর রেলস্টেশনে এসে হাজির হন। তার নির্দেশে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও মালিকপক্ষের ভাড়াটে বাহিনী গোর্খা সৈন্যরা স্টেশন ঘিরে ফেলে। ট্রেনের টিকিট বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়, জাহাজের পাটাতন তুলে দিয়ে যাত্রীদের মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়া হয়।

১৯ মে রাতের শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার পর স্টেশন থেকে রেলকর্মীদের সরিয়ে দেয়া হয়। চট্টগ্রামের ডিভিশনাল কমিশনার কিরণচন্দ্র দের সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েন ঘুমন্ত শ্রমিকদের ওপর। হাজার হাজার শ্রমিকের কালচে লাল রক্তে ছেয়ে যায় চাঁদপুর বড় স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। বেশি নিষ্ঠুরতা হয় পরদিন। জাহাজে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসেন আরও ৫০ জন গোর্খা সৈনিক। তাদের সঙ্গে ছিলেন সশস্ত্র ইউরোপীয় জুট মার্চেন্টরা। নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলে দিনভর। সব মিলে কয়েক হাজার শ্রমিক হতাহত হন।

তবে ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও আজও মাতৃভূমিতে ফিরতে পারেননি চাবাগানের শ্রমিকেরা। এখনও চলমান আইনে শোষণের শিকার তারা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ