Views Bangladesh Logo

জাতীয় সংসদ নির্বাচন জরিপের সত্য-মিথ্যা

Amin Al  Rasheed

আমীন আল রশীদ

গামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দেবেন ১২ শতাংশ মানুষ। জামায়াতকে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিকে ভোট দেবেন ২ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষ। আর যদি আওয়ামী লীগ ভোটে অংশ নিতে পারে তাহলে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ মানুষ তাদের ভোট দেবেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি পাবে শূন্য দশমিক ৩০ এবং অন্যান্য ইসলামী দল শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ ভোট। সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) একটি জরিপে উঠে এসেছে এই চিত্র। এতে গ্রাম ও শহরের নানা শ্রেণি-পেশার ৫ হাজার ৪৮৯ জন মানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে।

এর আগে গত জুলাই মাসে প্রকাশিত বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের জরিপে বলা হয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৩৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট পাবে বলে মনে করেন তরুণরা। জরিপে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জামায়াত। দলটি পাবে ২১ দশমিক ৪৫ শতাংশ ভোট। অন্যান্য ধর্মীয় দলগুলো পাবে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ভোট। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ, জাতীয় পার্টি ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং অন্যান্য দল শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ ভোট পাবে বলে তরুণরা মনে করেন। সানেমের এই জরিপে আরও উঠে আসে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি পেলে আওয়ামী লীগ পাবে ১৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ ভোট। দেশের সব কয়টি বিভাগের ওপর চালানো এ জরিপে অংশ নেন ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ২ হাজার মানুষ।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এ মুহূর্তে দেশে ভোটারের সংখ্যা ১২ কোটি ৭৮ লাখ। আর অনানুষ্ঠানিকভাবে দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। প্রশ্ন হলো, দুই থেকে ৫ হাজার মানুষের ওপর জরিপে ১২ কোটি ভোটার এবং ২০ কোটি মানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটে? দ্বিতীয়ত, জরিপে বাস্তবতার কতটুকু প্রতিফলন ঘটে?

বলা হয়, মিথ্যা তিন প্রকার। ১. মিথ্যা, ২. ডাহা মিথ্যা, ৩. জরিপ। জরিপ সম্পর্কে এই রসিকতা বা নেতিবাচক ধারণা গড়ে ওঠার পেছনে নানা কারণ আছে। কারা কখন কোন উদ্দেশ্যে কাদের মধ্যে জরিপ করছে এবং সেই জরিপের মধ্য দিয়ে তারা কী তুলে আনতে চায় তথা মানুষের সামনে কোন তথ্যটি উপস্থাপন করতে চায়- সেটি চট করে অনেক সময় বোঝা যায় না। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অনেক প্রতিষ্ঠান জরিপ চালায়- যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে কার কতটা সমর্থন ও জনপ্রিয়তা আছে, সেটি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। বিভিন্ন দল তাদের জনপ্রিয়তা বেশি দেখানোর জন্যও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে জরিপ পরিচালনা করে। অর্থাৎ ফলাফল ঠিক করেই অনেক সময় জরিপ করা হয়।

২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আরডিসি) দ্বারা পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফল উদ্ধৃত করে আওয়ামী লীগ দাবি করেছিল, একাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা ১৬৮ থেকে ২২০টি আসনে জয়লাভ করবে। বিতর্কিত ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৩৪টি আসন। তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি পেয়েছিল মাত্র ৯টি আসন। তবে অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হলে দেশের প্রধান দুটি দলের ভোটের ব্যবধান কত হতো এবং কারা সরকার গঠন করতো, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা বিএনপির মতো একটি দল মাত্র ৯টি আসনে জয়ী হবে, এটি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুতরাং কোন প্রতিষ্ঠান কার পারপাস সার্ভ করার জন্য জরিপ করে, সেটি বড় প্রশ্ন।

গত জুন মাসে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী দাবি করেছিলেন, বিএনপির এখন যে পরিস্থিতি, তারা ৫০ থেকে ১০০টির বেশি আসন পাবে না। কাছাকাছি সময়ে তিনি বলেছিলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী আগামীতে সংসদের আসন সংখ্যা ৪০০ হলে তার মধ্যে ৩০০ আসনে এনসিপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে। নাসীরুদ্দীন কীসের ভিত্তিতে এই সংখ্যাটি বলেছিলেন, তা তিনি ভালো জানেন। তবে তিনি কোনো জরিপের ঊধ্বৃতি দেননি। এনসিপি নিজেও কোনো জরিপ করেছে বলে শোনা যায়নি। তবে বাস্তবতা হলো, এনসিপি ৩০০ আসনে জয়ী হবে বলে দলের একজন শীর্ষ নেতা দাবি করলেও সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, তাদেরকে মাত্র ২ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষ ভোট দেবেন। আর গত জুলাইয়ে সানেমের জরিপে বলা হয়েছিল, ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ তরুণ এনসিপিকে ভোট দেবেন। অর্থাৎ দুটি জরিপের মধ্যে সংখ্যার পার্থক্য অনেক। যে কারণে কখন কোন প্রতিষ্ঠান কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য জরিপ চালায়, সেটিও বোঝা দরকার।

বিআইজিডির সবশেষ জরিপের ফলাফলে দেখানো হয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দেবেন ১২ শতাংশ মানুষ আর জামায়াতকে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অতীত অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক দলগুলোর জনভিত্তি ও জনপ্রিয়তা- সব মিলিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের ভোটের পার্থক্য মাত্র দেড় শতাংশ, এটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিএনপি ও জামায়াতের ভোট কাছাকাছি- এই ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই জরিপটি চালানো হলো কি না, সে প্রশ্নও অনেকের মনে আছে।

জরিপে বলা হয়েছে, যদি আওয়ামী লীগ ভোটে অংশ নিতে পারে তাহলে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ মানুষ তাদের ভোট দেবেন। বিগত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন বাদ দিলেও অতীতের তুলনামূলক ভালো নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ভোট ৩০ শতাংশের বেশি। যদিও টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা এবং নানাবিধ কর্মকাণ্ডের কারণে আওয়ামী লীগের ভোট কমেছে কি না, সেটি নিশ্চিত নয়।

জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা তরুণদের দল এনসিপি গঠনের আগে থেকেই তাদের নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক চলছে। অনেকেই মনে করেন, তরুণদের বিরাট অংশ এনসিপিকে ভোট দেবেন। যদি তাই হয় তাহলে তাদের ভোট কী করে তিন শতাংশেরও কম হয়? অবশ্য আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে এনসিপি অংশ নেবে কি না, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে জাতীয় যুব সম্মেলনে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘নির্বাচনের ডেট ঘোষণা হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে; ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না।’ এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয়, আমার যে ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিল, রক্ত দিয়েছিল সংস্কারের জন্য, তাহলে কবরে গিয়ে তার লাশটা ফেরত দিতে হবে এই সরকারকে।’

বিআইজিডির এই জরিপে অংশ নেওয়া ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ আগামী নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেন, সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেননি। প্রশ্ন হলো, এই ৪৮ শতাংশ মানুষ কেন এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি বা কেন এ বিষয়ে মতামত দিতে চাননি? তারা কি দেশের নির্বাচনি হাওয়া বোঝার চেষ্টা করছেন, নাকি তারা ‘না’ ভোট দেবেন? যদিও এবার যে পদ্ধতিতে ‘না’ ভোট ফিরিয়ে আনার কথা নির্বাচন কমিশন বলছে, তাতে সব আসনে এই বিধান থাকবে না। বরং যেসব আসনে একজন প্রার্থী থাকবেন, শুধু সেসব আসনেই ‘না’ ভোট থাকবে। সুতরাং সব আসনের ভোটাররা চাইলেও ‘না’ ভোট দিতে পারবেন না। অর্থাৎ যদি নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালের নির্বাচনের আলোকে ‘না’ ভোট ফিরিয়ে না আনে, তাহলে ওই ৪৮ শতাংশ মানুষ চাইলেও ‘না’ ভোট দিতে পারবেন না।

এই জরিপের একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো, ৫১ শতাংশ মানুষ ‘ভালো মতো’ সংস্কারের পরে ভোট চান। প্রশ্ন হলো, ভালো মতো সংস্কার বলতে কী বোঝানো হচ্ছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কতটুকু পরিবর্তন ও অর্জনকে ‘ভালো মতো’ সংস্কার বলে বিবেচনা করা হবে? একজন রাজনৈতিক কর্মীর কাছে সংস্কারের যে সংজ্ঞা, একজন পেশাজীবী, দিনমজুর বা সাধারণ গৃহিণীর কাছে সংস্কারের অর্থ এক নাও হতে পারে। আবার সংস্কার বলতে যদি একটি বিরাট পরিবর্তনকে বোঝানো হয়, তাহলে সেটি আগামী ফেব্রুয়ারির আগে কি সম্পন্ন করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় তাহলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কী করে? ৫১ শতাংশ মানুষ ভালো মতো সংস্কারের আগে ভোট চান না মানে দেশের অধিকাংশ মানুষই অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় দেখতে চান- এটি প্রতিষ্ঠিত করা বা এই বার্তা দেওয়ার জন্যই কি এই জরিপ?

মোদ্দাকথা, জরিপের ফলাফল সব সময় সত্য নাও হতে পারে। বাস্তবতার সঙ্গে অনেক ফারাক থাকতে পারে। ফলে আগামী নির্বাচনে কোন দল কত ভোট পাবে, বা কোন দলের জনপ্রিয়তা কেমন, সেটি যাচাইয়ের একমাত্র উপায় হচ্ছে একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ এবং সাজানো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কখনোই কোনো দলের জনপ্রিয়তা যাচাই করা যায় না। অতএব আগামী জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হোক বা তার আগে-পরে, জনগণের প্রত্যাশা হলো, সেই নির্বাচনটি বিগত তিনটি নির্বাচনের মতো হবে না।

যদি না হয় তাহলেই কেবল বোঝা যাবে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি বা অন্য দলগুলোর জনসমর্থন কতটা আছে। আর যদি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, তাহলেও দেখা যাবে যে অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে তার জনসমর্থনের কী হাল! অর্থাৎ জরিপের ফল যাই হোক না কেন, একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ছাড়া জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন সম্ভব নয়। আগামী নির্বাচনের জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে- এটিই প্রত্যাশা।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ