থ্রিআই/অ্যাটলাস: ধূমকেতু না কি এলিয়েনশিপ?
সোশ্যাল মিডিয়া নয়, জানতে নির্ভরযোগ্য সূত্রে চোখ রাখুন
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি গুজব ছড়িয়েছে, থ্রিআই/অ্যাটলাস নামের বিশাল এক ধূমকেতু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। এটি মানবজাতির জন্য ধ্বংস নিয়ে আসবে। অনেকে আলোচনা করছেন, পৃথিবীতে আঘাত করা থেকে এটিকে কীভাবে সরানো যায়। কিছু পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক স্তরে সামরিক প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। পুরো বিষয়টি মানুষের মধ্যে তৈরি করেছে চরম আতঙ্ক।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে, নাসার একটি টেলিস্কোপে ধরা পড়ে এক রহস্যময় ছায়া। ছায়াটি এসেছে সৌরজগতের বাইরে থেকে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দেন থ্রিআই/অ্যাটলাস (3I/ATLAS)। ‘ওউমুয়ামুয়া’ ও ‘বরিসভ’-এর পর এটি আমাদের সৌরজগতে আসা তৃতীয় পরিচিত আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু। তবে থ্রিআই/অ্যাটলাস অন্যদের মতো নয়- এটি অবিশ্বাস্যভাবে বড়, ভারী এবং অদ্ভুতভাবে চলমান। শুরু থেকেই এর গতি ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করছেন হার্ভার্ডের অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট অ্যাভি লোয়েব ও তার দল।
থ্রিআই/অ্যাটলাস নিয়ে এলিয়েস সম্পৃক্ততার আলোচনা সূত্রপাত হয় ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এ নিউইয়র্ক পোস্টের একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে। যার শিরোনাম ছিল: ‘বিশাল’ এক ধূমকেতু ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। যা আগের ধারণার চেয়েও বড়। এটি ভিনগ্রহের প্রযুক্তি হতে পারে, বলছেন বিজ্ঞানীরা: ‘এটি আমাদের জন্য সবকিছু বদলে দিতে পারে।’
এরপর এক্স (সাবেক টুইটার)-এ ছড়িয়ে পড়ে নানা তথ্য: স্টিভেন গ্রিনস্ট্রিট বলেছেন, “বিজ্ঞানীরা বলছেন একটি বিশাল এলিয়েন মহাকাশযান পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। এ নিয়ে মানুষ কেন আরও বেশি কথা বলছে না?” ডক্টর ডিসক্লোজার বলেন, “এ কারণেই সব জেনারেলরা একত্রিত হচ্ছেন!” - যার পোস্টে মার্কিন সামরিক নেতাদের বৈঠক উল্লেখ করা হয়, প্রায় ৫ লাখ ভিউ।
রিচার্ড রোপর বলেছেন, “একটি বিশাল ধূমকেতু না কি ঘণ্টায় ১ লাখ ৩০ হাজার মাইল বেগে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে! আমরা কি এটাকে থামাতে পারব? শুনেছি, দুটি মিশন চলছে - একটিতে রয়েছে মেসিয়া ক্রু আর অন্যটিতে দুটি দল, ‘ফ্রিডম টিম’ এবং ‘ইনডিপেনডেন্স টিম’।
তবে, বিজ্ঞানীরা এও বলছেন, ‘চিন্তা নেই - আমরা এটা সামলে নেব!’ এই আলোচনাকে উসকে দেন হার্ভার্ডের অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট অ্যাভি লোয়েব ও তার দল। তারা মনে করেন- এই বস্তুর অস্বাভাবিক গতি ও ত্বরণ দেখে এটিকে প্রাকৃতিক বস্তু বলে ব্যাখ্যা করা কঠিন। কারণ এই বস্তুর ভর ৩৩ বিলিয়ন টনেরও বেশি এবং এর কেন্দ্রের ব্যাস ৩ দশমিক ১ মাইলের বেশি। ঘণ্টায় প্রায় ২ লাখ কিলোমিটার বেগে ছুটছে এটি। যা সৌরজগতে আসা কোনো বস্তুর জন্য রেকর্ড সর্বোচ্চ। এটি সৌরজগতের সাধারণ ধূমকেতু বা গ্রহাণুর মতো নয়। এর কক্ষপথ, ঘূর্ণন ও গঠন- সবই এক রহস্য।
১৭ জুলাই প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, থ্রিআই/অ্যাটলাস হয়তো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নয় - এটি হতে পারে কোনো ভিনগ্রহের সভ্যতা তৈরির প্রযুক্তিগত বস্তু। এই তত্ত্বের ভিত্তি হলো এর অস্বাভাবিক অ-গ্র্যাভিটেশনাল ত্বরণ। শুক্র, মঙ্গল ও বৃহস্পতির কাছ দিয়ে অপ্রত্যাশিত গতিপথে অতিক্রম করবে এটি। বিজ্ঞানীদের আরও যা বিস্মিত করেছে - তা হলো এর কম রেট্রোগ্রেড টিল্ট, মানে এটি সৌরজগতের অধিকাংশ বস্তুর বিপরীত দিকে ঘূর্ণায়মান।
দিকনির্দেশনা দেখে মনে হচ্ছে কোনো বাধা ছাড়াই এটি পৃথিবীর কাছাকাছি এসে পড়বে। লোয়েবের মতে, এমন কক্ষপথ বেছে নেয়ার মাধ্যমে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী যদি এর মধ্যে থাকে, তবে তারা গ্রহগুলোর কক্ষপথ ও ভর পরিমাপ করে সৌরজগতের আদর্শ গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে। তাদের মতে, হয়তো এটি কোনো ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রজাতির অনুসন্ধান যান যা আমাদের সৌরজগৎ পর্যবেক্ষণ করছে। আমাদের সভ্যতাকে মাপছে।
লর্ড বেবো নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে মার্কিন পদার্থবিদ মিচিও কাকুর নামে মিথ্যা উদ্ধৃতি শেয়ার করেছে। এতে বলা হয় বস্তুটি পৃথিবীতে ‘পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে, যার উদ্দেশ্য শত্রুতামূলক হতে পারে।’ এটি প্রায় ৩ লাখ ভিউ পায়।
অ্যাস্ট্রোনমি ভাইবস লিখেছে: ‘যদিও বেশিরভাগ বিজ্ঞানী মনে করেন এটি একটি অদ্ভুত ধূমকেতু। কিছু সাহসী কণ্ঠস্বর বলছে, এটি হয়তো অন্য কোনো সভ্যতা থেকে পাঠানো যান।’ থ্রিআই/অ্যাটলাসের ভেতরে কী আছে তা হয়তো আমরা জানব না; কিন্তু এটা পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসছে কিনা- বা পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ কি না এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা খুব পরিষ্কার কথা বলেছেন। সেগুলো সামনে আসছে না। বরং আসছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে মিথ্যা সব তথ্য।
আলজাজিরার ফ্যাক্ট-চেক সংস্থা এসএএনএডির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, নাসা এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইএসএ) নিশ্চিত করেছে, থ্রিআই/অ্যাটলাস পৃথিবীর জন্য কোনো হুমকি নয়। ২১ জুলাই, ২০২৫-এ পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব ছিল প্রায় ২৭ কোটি কিলোমিটার যা পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যবর্তী দূরত্বের চেয়ে আড়াই গুণেরও বেশি। এটি সূর্যের কাছে পৌঁছাবে ৩০ অক্টোবর, ২০২৫-এ। তখনো পৃথিবীর নিরাপদ দূরত্ব বজায় থাকবে। তখন এর দূরত্বের পরিমাণ হবে ২১ কোটি কিলোমিটার।
সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে যে, ‘ইলন মাস্ক বলেছেন থ্রিআই/অ্যাটলাস পৃথিবীর দিকে আসছে। বা ‘নাসা সতর্কবার্তা দিয়েছে’- এই দাবিগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। ইলন মাস্ক তার ভেরিফায়েড এক্স (টুইটার) অ্যাকাউন্টে এই বিষয়ে কোনো পোস্ট করেননি এবং নাসা বা অন্য কোনো বৈজ্ঞানিক সংস্থা পৃথিবীর জন্য বিপদ ঘোষণা করেনি। আর পদার্থবিদ মিচিও কাকু না কি বলেছেন “এটা এলিয়েন যান”? যা সম্পূর্ণ মিথ্যা! আলজাজিরার ফ্যাক্ট-চেক সংস্থা এসএএনএডি প্রমাণ করেছে- উক্তিগুলো বানানো ও ছবিগুলো ২০২৫ তারিখের একটি পুরোনো সাক্ষাৎকারের। এগুলো থ্রিআই/অ্যাটলাস ধূমকেতু আবিষ্কারের অনেক আগের ঘটনা।
মোট কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় যা-ই দাবি করা হোক না কেন, থ্রিআই/অ্যাটলাস ধূমকেতুটি মানবজাতির জন্য কোনো হুমকি নয়। অ্যাভি লোয়েবের এলিয়েন ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এটি শুধুই অনুমান। অন্যদিকে যেটা সত্য ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে থ্রিআই/অ্যাটলাস মহাকাশ বিজ্ঞানীদের জন্য গবেষণার একটি বিরল সুযোগ। কারণ এটি আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুর প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাই থ্রিআই/অ্যাটলাস নিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের বিরল সুযোগকে আমাদের আতঙ্ক নয়- আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করা উচিত। আর এই উপভোগের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো গুজব থেকে নিজেকে দূরে রাখা। সুতরাং, বৈজ্ঞানিক তথ্যের জন্য ব্যক্তিগত কারও সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে নয়- নির্ভরযোগ্য সূত্রের ওপর ভরসা রাখুন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে