Views Bangladesh Logo

ট্রাম্প পুতিন বৈঠক: সফল ও বিফলের হিসাব

Mohshin  Habib

মহসীন হাবিব

৫ আগস্ট বাংলাদেশ সময় মধ্য রাতে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে যে বৈঠক হলো, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম লিখছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো সুরাহা হয়নি, কোনো সমঝোতা হয়নি, পুতিন-ট্রাম্প আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে ইত্যাদি। বৈঠকের ঘোষণার পর থেকেই এ বিষয়টি ছিল টক অব দি ওয়ার্ল্ড; কিন্তু এ আলোচনার এজেন্ডা কী ছিল, লক্ষ্য কী ছিল সেটা কেউ পরিষ্কার করে বলছেন না। প্রধানত ইউক্রেন নিয়ে আলোচনা বটে; কিন্তু কোনো সমঝোতা বা চুক্তির কথা ছিল না।

পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, এই আলোচনা হলো, ‘লিচেনিং এক্সারসাইজ’। অর্থাৎ কোনো সিদ্ধান্তে আসা নয়, বরং কথা শোনার একটা ধারা তৈরি করা। এ কথা তো ঠিক যে তিন বছর পার হয়ে গেলেও এই যুদ্ধের কোনো সমাধানের পদক্ষেপ না ইউরোপ নিতে পেরেছে, না রাশিয়া নিতে পেরেছে। সেই দিক বিবেচনা করলে এই আলোচনা খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে বলে আমরা মনে করতে পারি। দুই প্রেসিডেন্টই ছিলেন অসাধারণ উষ্ণ এবং আন্তরিক।

সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে তারা পরবর্তী একটি আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পুতিন হাসতে হাসতে বলেছেন, আগামী আলোচনাটা মস্কোতে হতে পারে। ট্রাম্প সঙ্গে সঙ্গে হেসে পুলকিত হয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। হতে পারে এটি শান্তির প্রয়োজনে কৌশল; কিন্তু পুতিনকে যে সম্মান এবং আন্তরিকতা দেখানো হয়েছে তা বিরল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে ‘ইয়াঙ্ক এন্ড পুল’ হ্যান্ডশেক করেন। এই ধরনের হ্যান্ডশেকের অন্যতম অর্থ হলো, কাউকে কাছে টেনে নেওয়া। এরপর চারটি যুদ্ধ বিমান এবং একটি বি-২ স্টিলথ বিমান উড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। এটি ছিল পুতিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন (অথচ অত্যন্ত আনাড়ি গণমাধ্যম বলতে চেষ্টা করেছে, যুক্তরাষ্ট্র পুতিনকে তাদের শক্তি দেখিয়েছে। এটি শুধু অনাড়িই নয়, হাস্যকর ব্যাখ্যা)। মোদ্দা কথা, পুতিনকে অভ্যর্থনা ছিল একটি ইতিবাচক দিক। হয়তো দুপক্ষের মধ্যে একটি বরফ গলানোর অংশ।

গণমাধ্যম বা ইউরোপীয় দেশগুলো যাই বলুক, ইউক্রেন-রাশিয়া একটি প্রক্সি ওয়ার চলছে। রাশিয়ান ফেডারেশন বনাম ন্যাটো। যুদ্ধটা শুধু ইউক্রেনের মাটিতে, এবং যুদ্ধে নিহতদের বেশির ভাগই ইউক্রেনের অথবা রাশিয়ার। তবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ থেকে। ইউরোপ গোপনে ভাড়া করা সৈন্য এবং কৌশলী পাঠাচ্ছে ইউক্রেনে। এ কথা পশ্চিমা দেশগুলোও এখন আর অস্বীকার করে না।

মহাভারতে একটি কথা আছে, হাতির পিঠে চড়ে যদি কোনো বানর বনের রাজা সিংহকে ভেংচি কাটে, তখন হাতিকে আর নির্দোষ বা পক্ষপাতহীন বলা যায় না। সুতরাং ইউরোপও যুক্তরাষ্ট্রকে ওই হাতির মতো ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে তা পরিষ্কার। তবে ট্রাম্প বেশ কিছুকাল ধরেই এ যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে খানিকটা পিছিয়েছে। এবং আরো বড় সত্য হল, এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র চালাতে না চাইলে, অথবা পেছন থেকে সরে গেলে ইউক্রেনের পরাজয় অনিবার্য। সেই সঙ্গে ইউরোপের বড় দেশগুলো যার যার পিঠ বাঁচাতে সরে যাবে। তাই তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত রাখতে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেন প্রশ্নে আলোচনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, এমনকি ইউরোপ ও ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনার চেয়েও।

মাত্র দু-দিন আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, যুদ্ধ থামাতে না চাইলে পুতিনকে পরিণতি ভোগ করতে হবে। আলাস্কায় আলোচনার শুরুর ঠিক আগে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইঙ্গিত দেয়, যদি আলোচনা ফলপ্রসূ না হয় তাহলে ট্রাম্প একাই সংবাদ সম্মেলনে থাকবেন, আর যদি ফলপ্রসূ হয় তাহলে দুই প্রেসিডেন্টই সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেবেন।

অবশেষে দেখা যায়, তারা দুজনই অতি আন্তরিকথার সঙ্গে সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কয়েক বার বলেছেন, কোনো যুদ্ধ বিরতি নয়, তিনি স্থায়ী শান্তি দেখতে চান। প্রতি নিয়ত দুপক্ষের মানুষ মরছে, সেটা তিনি বন্ধ করতে চান। আলাস্কায় বৈঠক শেষে সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে শুধু বলেছেন প্রতি সপ্তাহে কয়েক হাজার মানুষ জীবন দিচ্ছে। এর বেশি কিছু তিনি বলেননি। এবং সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন কোনো প্রেসিডেন্টই নেননি। এটা প্রমাণ করে ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক পূণবিবেচনাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন।

এখন প্রশ্ন হল, ফলপ্রসূ বলতে যুক্তরাষ্ট্র কী বুঝল, এবং ইউরোপ ও পশ্চিমা বেশির ভাগ গণমাধ্যম কী বোঝাতে চাইল, ইউরোপের নেতারাই বা কী বুঝছেন? বৈঠকের আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, একদল ব্যবসায়ী নিয়ে পুতিন সফরে আসছেন, এটা খুবই ভালো কথা। তিনি প্রেস কনফারেন্সেও বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে নানা বাণিজ্যিক সহযোগিতার কথা। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে আর্কটিক অঞ্চলে সহযোগিতার কথা হয়েছে, মহাকাশ সহযোগিতার কথা হয়েছে। এতে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে, কয়েকদিন ধরে যে রাশিয়ার উপর অধিক নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিচ্ছিলেন ট্রাম্প, সেটা থেকে সরে এসেছেন।

দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকজন ব্যবসায়ী নিয়ে গিয়েছিলেন পুতিন, যাদের মধ্যে দু-একজনের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাও আছে। এটাও প্রমাণ করে, এই বৈঠক রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা বৃদ্ধি নয়, বরং তা শিথিলের পথে হাঁটছে দুই দেশ। অবশ্য এই সব তথ্যের মধ্যে আমাদের মাথায় রাখতে হবে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক কথায় স্থির থাকেন না। এমনও দেখা যায়, তিনি সকালে এক কথা বলছেন, আবার রাতে আরেক। যেমন আলাস্কা থেকে ফিরেই একটু ঘোরানো কথা বলেছেন। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছেন, ১৮ আগস্ট তিনি ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনা করবেন।

বৈঠকের পর তিনি জেলেনস্কির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই ভয়ানক যুদ্ধ থামাতে সরাসরি জেলিনিস্কি এবং পুতিনের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি হওয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য, ট্রাম্প-পুতিন আলোচনার আগেই ইউরোপ এবং ইউক্রেন থেকে চেচামেচি শোনা যাচ্ছিল, জেলেনিস্কি তথা ইউক্রেনকে ছাড়া কোনো আলোচনা হতে পারে না। তাদের মধ্যে একটি প্রবণতা যুদ্ধের শুরু থেকেই লক্ষ্য করা যায় যে, সমরাস্ত্র দিয়ে রাশিয়াকে পরাস্ত করতে হবে, এবং সেটা করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। তারা কেবল পেছন থেকে কিছু সাহায্য করবে। এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ট্রাম্প যে একমত নন, তা পরিষ্কার হয়ে গেছে।

তবে এই আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্যে ট্রাম্পের একটি ব্যক্তিগত লক্ষ্যও আছে যে কথা আমি অন্য একটি লেখায় বলেছি। তাকে নোবেল পুরস্কারের জন্য লবিং চলছে। তিনি ইতোমধ্যেই কয়েকটি যুদ্ধ থামিয়েছেন বলে দাবি করছেন। ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশ তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাবও করেছে। এখন যদি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে তিনি সরাসরি উদ্যোগ না নেন, তাহলে নোবেলের দাবি কিছুটা খাটো হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, তিনি ব্যবসায়ী মানুষ। ব্যবসা তার নিজের এবং রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি। তিনি বেশ কিছুকাল ধরেই ইউরোপের ব্যাপারে এবং ন্যাটোর ব্যয় নিয়ে যথেষ্ট অসন্তোষ্ট। পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে তার একটি শীতল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে ন্যাটোর খরচ নিয়ে তা স্পষ্ট। আর শেষ কথা হল, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বাইডেনের সময়ে। এবং এ যুদ্ধে বাইডেন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকতে হান্টার বাইডেন ইউক্রেনের কোম্পানি বুরিশমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইউক্রেনে দুর্নীতির একটি মামলায় হান্টার যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তার করেন। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ট্রাম্প ছিলেন প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট।

অন্যদিকে ভলোদিমির জেলেনিস্কি ২০১৯ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে হান্টার বাইডেনের বিষয়ে তদন্ত করতে বলেন। কিন্তু জেলেনিস্কি সে তদন্ত করেননি। কারণ জেলেনস্কির ধারণা ছিল, আর কয়েক মাস পরেই বাইডেনের দল ডেমোক্র্যাটরাই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসবে। তাই হয়েছিল। বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলেন। এবং জেলেনিস্কি প্রায় বাইডেনের দ্বিতীয় পুত্রের মতো ইউক্রেন চালাতে থাকেন এবং ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তা অজানা নয়। তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল ওভাল অফিসে জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে।

মহসীন হাবিব: সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ