মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির মতো বিশ্বে আরও যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন ট্র্যাজেডি ঘটেছে
গতকাল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে গেছে তার খবর ইতোমধ্যে সারা পৃথিবীতে পৌঁছে গেছে। বিশ্বের সব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে খবরটি প্রকাশ করেছে। বিমান দুর্ঘটনা এমনিতেই খুব স্পর্শকাতর সংবাদ। বিমান দুর্ঘটনার খবর শোনামাত্রই সবাই এক মুহূর্তে কেঁপে ওঠেন। প্রথম আশঙ্কাই থাকে হতাহতের সংখ্যা কত হলো তা নিয়ে।
সবাই জানেন বিমান ভূপাতিত হলে বিমানের পাইলট, ক্রু, যাত্রী সবারই মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে মাটিতে থাকা মানুষও মারা যায়। তাই বিমান দুর্ঘটনার খবর সবসময়ই খুব উদ্বেগজনক। এই পরিস্থিতে কেউ যদি শুনেন কোনো স্কুলের ওপর বিমান আছড়ে পড়েছে তা হলে যে কারও কলিজা কেঁপে উঠবে। বাংলাদেশের একটি স্কুলে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে, এই খবরে তাই দেশবাসীর মতো বিশ্ববাসীও বিমূঢ় হয়ে গেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩১, আর আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাহীন আছে ১৬৫ জন, যাদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। অনেকের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত দেহ পুড়ে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে।
বিমান দুর্ঘটনায় সব যাত্রী নিহত হলেও, দুইশ-তিনশ যাত্রী মারা গেলেও এমন হাহাকার তৈরি হয় না- যতটা বাংলাদেশের স্কুলে বিমান বিধ্বংস হওয়ার পর হয়েছে। এর কারণ এখানে মারা গেছে ফুলের মতো শিশুরা। যাদের স্কুল একটু পরেই ছুটি হতো, তারা বাসায় খেয়েদেয়ে ঘুমাত বা খেলত- এসব শিশু অনেকে স্বর্গে চলে গেছে। কেউ-বা দগ্ধ দেহ নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। অনেক বাবা-মা আদরের সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায়। সমগ্র দেশের মানুষ ওই স্বর্গের শিশুদের জন্য, ওই সন্তানহারা পিতা-মাতার জন্য আর্তনাদ করছে। আমরা জানি না আজ পৃথিবীর কোন প্রান্তের মানুষ কাঁদছে বাংলাদেশের এই কোমলমতি শিশুদের জন্য।
পৃথিবী আজ থেকে সাক্ষী হয়ে গেল এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার। বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাসে ২১ জুলাই, ২০২৫ লেখা থাকবে বেদনার অশ্রুজলে। অন্তর্জাল ঘেটে দেখা গেছে বাংলাদেশের মতো এমন ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা পৃথিবীর কোনো স্কুলে আর ঘটেনি। স্কুলে, স্কুল প্রাঙ্গণে বা স্কুলের কাছাকাছি আরও কয়েকটি বিমান আছড়ে পড়েছে, তাতে হয়তো যাত্রী সবাই মারা গেছেন; কিন্তু; স্কুলের শিক্ষার্থী তেমন মারা যায়নি। এরকম কয়েকটি ঘটনার বিবরণ ইন্টারনেটে পাওয়া গেল:
১. পার্ক স্লোপ বিমান দুর্ঘটনা, নিউইয়র্ক (১৯৬০)
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৬০। তুষারে ঢাকা নিউইয়র্কের শীতের সকাল। টিডব্লিউএ ফ্লাইটটি ওহাইও থেকে লা গার্ডিয়া বিমানবন্দরে আসছিল এবং ইউনাইটেড ফ্লাইটটি আসছিল শিকাগো থেকে নিউইয়র্কে। খারাপ আবহাওয়া, কারিগরি ত্রুটি এবং যোগাযোগ বিভ্রাটের ফলে শিকাগো থেকে আসা ডিসি-৪ বিমানটি নির্ধারিত পথ থেকে সরে যায়। ফলে আকাশে সংঘর্ষ ঘটে দুটি বিমানের। টিডব্লিউএ বিমানটি স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে একটি সামুদ্রিক অঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়, আর ইউনাইটেডের বিমানটি ব্রুকলিনের পার্ক স্লোপ এলাকায় আছড়ে পড়ে। পার্ক স্লোপের কাছেই ছিল ‘হোলি নেম অফ জেসাস ক্যাথলিক স্কুল’ এবং একটি গির্জা। বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের আবাসিক এলাকায়, স্কুল চত্বর এবং গির্জার চারপাশে। আগুন ধরে যায় সঙ্গে সঙ্গেই। বহু ঘরবাড়ি, যানবাহন ও ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় ১৩৪ জনের মৃত্যু হয়- যার মধ্যে উভয় বিমানের যাত্রী ও ক্রু সদস্য এবং মাটিতে থাকা সাধারণ মানুষও ছিল। স্কুল প্রাঙ্গণে তখন অনেক শিক্ষার্থী খেলছিল। বিমানের ভাঙা অংশের আঘাতে একজন ছাত্র মারা যায়। এই দুর্ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২. সেরিটোস দুর্ঘটনা, ক্যালিফোর্নিয়া (১৯৮৬)
৩১ আগস্ট, ১৯৮৬। মেক্সিকোর মেক্সিকো সিটি থেকে ফ্লাইট ৪৯৮ লস অ্যাঞ্জেলেস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিল। অপরদিকে পাইপার চেরোকি নামের হালকা একটি ব্যক্তিগত বিমান একটি ব্যক্তিগত বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করেছিল। কোনো অনুমতি ছাড়াই নিয়ন্ত্রিত আকাশসীমায় প্রবেশ করে। এতে দুটি বিমানের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটে। সংঘর্ষের পর মেক্সিকোর বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে আছড়ে পড়ে সেরিটোস শহরের আবাসিক এলাকায়। পাইপার বিমানটির ধ্বংসাবশেষও একই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। দুর্ঘটনার স্থানটি ছিল ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা- স্কুল, ঘরবাড়ি ও খেলার মাঠে ঘেরা। ভাগ্য ভালো বিমান দুটো ধ্বংসাবশেষ কোনো স্কুলে সরাসরি ধাক্কা খায়নি। তবে কাছাকাছি স্কুলগুলোর শ্রেণিকক্ষে ধোঁয়া ও ধ্বংসাবশেষ প্রবেশ করেছিল। কিছু শিশু শিক্ষার্থী ওই মুহূর্তে বাইরে খেলছিল বা জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল। তারা পুরো ঘটনাটি চোখের সামনে দেখেছে। এদের অনেকেই পরবর্তীতে ট্রমার শিকার হয়। শিক্ষকদের দ্রুত পদক্ষেপে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছিল।
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ৮২ জনের মৃত্যু ঘটে। এর মধ্যে দুটি বিমানের সব যাত্রী, ক্রুসহ দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের আবাসিক এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা ছিলেন। ভাগ্য ভালো কোনো শিক্ষার্থী নিহত হয়নি; কিন্তু দুর্ঘটনা চোখের সামনে দেখেই তারা যে পরিমাণ ট্রমার শিকার হয়েছিল, যার কারণে তাদের পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয়।
এবার ভাবুন আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের কথা। যারা এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার সরাসরি শিকার হয়েছে। যারা চোখের সামনে প্রিয় বন্ধুদের আগুনে পুড়ে মারা যেতে দেখেছে তাদের কী অবস্থা হবে!
৩. পিএসএ ফ্লাইট ১৮২ দুর্ঘটনা, সান ডিয়েগো (১৯৭৮)
১৯৭৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সকালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো শহরের আকাশে ঘটেছিল এক ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক বিমান দুর্ঘটনা। প্যাসিফিক সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান- পিএসএ ফ্লাইট ১৮২, বোয়িং ৭২৭ মডেলের বিমানটি একটি ছোট প্রশিক্ষণ বিমানের সঙ্গে মাঝ আকাশে সংঘর্ষ হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশাল যাত্রীবাহী বিমানটি আগুন জ্বলতে জ্বলতে সান ডিয়েগোর ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা ‘নর্থ পার্ক’-এ বিধ্বস্ত হয়।
এ দুর্ঘটনায় মুহূর্তেই মৃত্যু ঘটে ১৩৫ জন যাত্রী ও ক্রু সদস্য, ছোট বিমানের ২ জন প্রশিক্ষণার্থী এবং নিচে থাকা ৭ জন স্থানীয় বাসিন্দার। সব মিলিয়ে ১৪৪ জন প্রাণ হারান, যা তখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিমানটি যেখানটায় পড়ে, তার আশপাশেই ছিল ঘরবাড়ি, গলি, পার্কিং লট এবং স্কুল। যদিও কোনো স্কুল সরাসরি ধ্বংসের শিকার হয়নি, তবে অদূরে থাকা স্কুলগুলোতে তীব্র ধোঁয়া ঢুকে পড়ে শ্রেণিকক্ষে, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে। অনেক শিশু জানালা দিয়ে এই ভয়াল দৃশ্য দেখতে পায়। আকাশ থেকে জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষ ছিটকে পড়ে নিচের দিকের বাড়িগুলোর ওপর, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আগুন ও ধ্বংস।
এই দুর্ঘটনার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে আকাশপথে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসে। টিসিএস (ট্রাফিক কোলিশন এভয়ডেন্স সিস্টেম) চালু করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে মাঝ আকাশে সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়।
এরকম আরও কয়েকটি বিমান দুর্ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়, যেখানে স্কুল প্রাঙ্গণে বা স্কুলের কাছাকাছি বিমান আছড়ে পড়েছে; কিন্তু ভাগ্যক্রমে স্কুলের কোনো শিক্ষার্থী একজনের অধিক নিহত হয়নি। তাই বাংলাদেশের স্কুলে বিমান বিধ্বংসের ঘটনাটিই এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ, মর্মান্তিক ঘটনা। এই দুর্ঘটনা বাংলাদেশের শিশুদের মনে কতদিন পর্যন্ত দাগ কেটে থাকবে বলা যায় না। আজ অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীরা আতঙ্কজনক সময় কাটিয়েছে বলে জানা গেছে। আকাশ দিয়ে বিমান উড়ে যেতে দেখলেই তারা ভয় পেয়ে তাকাচ্ছে!
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে